কলকাতা বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

দেশ-কাল সময়ের অনন্য-ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে আগামী দিনে চিহ্নিত হবে মুহাম্মদ আবদুল মোমেনের ‘বাংলায় মাদ্রাসা ছাত্র-আন্দোলন’

শেয়ার করুন

সেখ ইবাদুল ইসলাম : বেগম রোকেয়া সাখায়াত হোসেন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘ শুনতে পাই বাংলা মুলুকে প্রায় পৌনে তিন কোটি মুসলমানের বাস , এঁরা সেই তিন কুঁড়ে,-নড়াচড়া,চলাফেরা কিছু করেন না;কেবল কুম্ভকর্ণের মতো শুয়ে শুয়ে ঘুম পাড়েন।” রোকেয়ার এই আক্ষেপ হয়তো আর থাকত না যদি তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারতেন এই রাজ্যের বাঙালি মুসলিমদের দ্বারা পরিচালিত একটি ছাত্র সংগঠন পশ্চিমবাংলার রাজনীতির ইতিহাসকেই বার বার বদলে দিয়েছে।

আসলে ছাত্র-যুবরা দেশের মূল কান্ডারি । সুকান্তের ভাষায় বলতে হয় , যৌবনের দুত । এই দুত কোনো বাধা মানে না । যেকোনো প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে পারে এই শক্তি । স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তখনই সাফল্য এসেছে যখন ছাত্র-যুবরা আন্দোলনে অংশ নিয়েছে । কিন্ত দুঃখের হলেও সত্য, আমরা ছাত্র আন্দোলন বলতে বুঝি রাজনৈতিক দলগুলির মদতে যে আন্দোলন হয় । এর বাইরে অ-রাজনৈতিকভাবে যেসব আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে তার মূল্য আমরা সেভাবে দিই না । কারণ অধিকাংশ আন্দোলনের নেপথ্যে রাজনৈতিক শক্তির পরিবর্তন হয় । ফলে কখনও বামেদের পক্ষে আবার কখনও ডানপন্থীদের পক্ষে সওয়াল করা হয় । এটাই আমাদের দেশের ট্রাডিশন । সম্প্রতি সিএএ নিয়ে সমগ্র দেশজুড়ে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার ইতিহাস কী আমরা লিপিবদ্ধ করেছি ? কিন্ত এই অ-রাজনৈতিক আন্দোলন দেশের শাসক শ্রেণিকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছে । সম্প্রতি কৃষকদের অ-রাজনৈতিক আন্দোলন মোদীর মতো ব্যক্তিকেও পিছু হঠতে বাধ্য করেছে । কারণ নরেন্দ্র মোদী একমাত্র প্রশাসক যিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা আর প্রত্যাহার করেননি । দেখা গেল কৃষকদের চাপে কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী । অন্যদিকে, মুখে না বললেও সিএএ আইন কার্যকর করতে কেন এখনও পর্যন্ত পারলেন না মোদী সরকার তা সকলের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেছে ।

Advertisement

ঠিক এই ভাবে পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানদের সমস্যা অনেক আছে । সেই সমস্যার সমাধান হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে । আর এই সব সমস্যার সমাধান না হওয়ার নেপথ্যে কতটা সরকার দায়ী কতটা এই রাজ্যের সংখ্যালঘু নেতারা দায়ী তা আমাদেরকে গবেষণা করে দেখতে হবে । একথা স্বীকার করতেই হবে বাঙালি মুসলিম ছাত্রদের দ্বারা পরিচালিত মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়ন এই রাজ্যের রাজনৈতিক পালা বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে । একথা স্বীকার করতে হবে , এই রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জান-মালের নিরাপত্তা যখনই বিঘ্নিত হয়েছে তখনই বাঙালি মুসলিম সমাজের আলেমরা গর্জে উঠেছে । মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব উঠে এসেছে । এমনকি এই রাজ্যে অনেক মুসলিম শাসক দলের সাংসদ কিংবা বিধায়ক হওয়ার নেপথ্যে মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না ।

আর এই কথাগুলিকেই শব্দের পর শব্দ দিয়ে জুড়েছেন মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মোমেন । তিনি নিজেও মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সারির নেতা ছিলেন । তাই বিগত বিশ বছর ধরে যে আন্দোলন মাদ্রাসার ছাত্ররা করেছে তার তিনি প্রত্যক্ষ সাক্ষী । সুতরাং তাঁর এই বইটির মধ্যে বিশ্লেষণ খুব ভাল হয়েছে । কোথায় কোথায় নেতৃত্বের খামতি ছিল, সেসব যেমন উঠে এসেছে একইভাবে মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নকে কাজে লগিয়ে কারা কীভাবে কাজ করেছে তারও সুনিপুণ বর্ণনা আমরা এই বইতে পেয়েছি ।

তবে কিছু অসম্পূর্ণ থেকে গেছে । শহীদুল ইসলামরা মাদ্রাসা নিয়ে যে আন্দোলন করেছিলেন তারই ফলে সিদ্ধার্থের জামানায় মাত্র ২/৩ বছরের মধ্যে ২৩৫টি মাদ্রাসা অনুমোদন পেয়েছিল । এখানে লেখক বলেছেন,এই আন্দোলনকারীরা সরকারের সঙ্গে সর্ম্পক বজায় রেখে আন্দোলন করেছিলেন । এতে আমার মনে হয় আন্দোলনকারীদের একটু খাটো করা হয়েছে । কারণ মনে রাখতে হবে সিদ্ধার্থের জামানায় সংখ্যালঘু মুসলিমরা যে আবেদন নিয়ে সরকারের কাছে হাজির হয়েছে তার সবটা না হলেও বেশ খানিকটা পূরণ করতে সচেষ্ট হতেন স্বয়ং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী । এই রকম মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে যদি শহীদুল ইসলামরা আন্দোলন করে থাকেন তাহলে তার পুরো কৃতিত্বটাই আন্দোলনকারীদেরকেই দিতে হবে । আর একটি তথ্য লেখক ভুল দিয়েছেন, সেটা হলো কৃষিমন্ত্রী আবদুস সাত্তারের মাদ্রাসা মন্ত্রী হওয়ার কাহিনীটি । আমি নিজে ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে যা শুনেছি তা সত্য হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি । প্রথমে আবদুস সাত্তারকে মাদ্রাসার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি । রাহাতপুর হাইমাদ্রাসার অনুমোদনের ফাইল বেশ কয়েক মাস আটকে ছিল, সেই সময় শহীদুল ইসলামরা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেন । এরপরেই মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় বৈঠক ডাকেন । সেই বৈঠকে ডিপিআই এবং শিক্ষামন্ত্রী মৃত্যুজ্ঞয় বন্দ্যোপাধ্যায়কেও(যিনি সেই সময় মাদ্রাসার দায়িত্বে ছিলেন) ডাকা হয় । কিন্ত বৈঠক শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর ডিপিআই এই বৈঠকে যোগ দেন । এরপরেই সিদ্ধার্থ শংকর রায় আবদুস সাত্তারকে মাদ্রাসার অনুমোদনের বিষয়টিকে দেখার দায়িত্ব দেন ।

বাকী আরও কিছু বিষয় এখানে উল্লেখ্ করা হয়নি । তবে মোজ্জাফফর হোসেনের পর থেকে মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলনের ধারাবহিক ইতিহাস খুব ভালভাবেই বর্ণিত হয়েছে । মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান সাহেব এবং মাওলানা মুহাম্মদ আহাদ সাহেবের ইতিহাস আর একটু বিস্তারিত তুলে ধরলে ভাল হতো । তবে বানান ভুল অনেক সময় পাঠককে বিব্রত করেছে , এদিকে লেখক ও প্রকাশক সজাগ দৃষ্টি দিলে আরও ভাল হতো । সব মিলিয়ে স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে মুহাম্মদ আবদুল মোমেনের ‘বাংলায় মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলন’ এক কথায় ঐতিহাসিক মূল্যবান দলিল হিসাবে আগামী দিনে চিহ্নিত হবে । বাংলার রাজনৈতিক-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসার ছাত্রদের যে বিরাট ভূমিকা ছিল তা এই গ্রন্থ পড়ে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস । আগামী দিনে গবেষকদের কাছে এই গ্রন্থটি মূল্যবান বিষয় হয়ে যে উঠবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না ।

বাংলায় মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলন

লেখক : মুহাম্মদ আবদুল মোমেন

প্রকাশক : মশাল পাবলিকেশন

মূল্য: ২৫০ টাকা মাত্র


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ