বাংলায় কংগ্রেসের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে হাই কমান্ড নয় অধীরের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে সোনিয়া ও রাহুলকে
সেখ ইবাদুল ইসলাম : পঞ্চম দফার নির্বাচন শুরুর আগেই পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেস দলের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন কেন্দ্রে ইন্ডিয়া জোট ক্ষমতায় এলে তারা বাইরে থেকে সমর্থন করবে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কৌশলকে চালাকি বলে মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যিনি নিজে ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন। তিনি যে পরে জোটকে সমর্থন করবেন। এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অধীর চৌধুরীর ভাষায়, ‘‘উনি (মমতা) জোট থেকে পালিয়ে গিয়েছেন। ওঁর কোনও কথায় আমি ভরসা করি না। এখন দেখছেন হাওয়া বদলাচ্ছে। তাই এ দিকে ভিড়তে চাইছেন। বিজেপির দিকে পাল্লা ভারী দেখলে ও দিকে যাবেন।’’
এটাতো অবিশ্বাস করার জায়গা নেই এই কয়েকদিন আগে পর্যন্ত যে ভাষায় কংগ্রেস এবং সিপিএমকে তৃণমূল নেত্রী আক্রমণ করেছেন তা এই রাজ্যের কংগ্রেস কর্মী এবং সিপিএম কর্মীরা মেনে নিতে পারবেন না। এই রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটকে টিকিয়ে রাখার জন্য যারা চেষ্টার অন্ত করলো না তাদের দিকে না তাকিয়ে যেভাবে কংগ্রেস হাই কমান্ড হঠাৎ মমতা প্রীতি শুরু করে দিল তার প্রতিক্রিয়া শুরু হতে বাধ্য।
কংগ্রেসকে মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র কংগ্রেস হাই কমান্ডের দ্বিচারিতার জন্যই এই রাজ্যে কংগ্রেসের শক্তি বৃদ্ধি হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হওয়ার নেপথ্যে ছিল কংগ্রেসের অবদান। যে সকল কংগ্রেস কর্মী এই রাজ্যের কংগ্রেসের পতাকাকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাদেরকে কেন মর্যাদা দেওয়া হবে না? কোন অধিকারে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে অধীর চৌধুরীর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন ? এটার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত বলে এই রাজ্যের কংগ্রেস কর্মীরা মনে করছেন।
কংগ্রেস হাইকমান্ডের মনে রাখা উচিত এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা ক্রমশই কমছে তারা যদি মনে করে থাকেন যে মমতা ব্যানার্জির উপর ভর দিয়ে দিল্লির মসনদ তারা দখল করবেন সেটা ভুল করছেন। কারণ এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেটুকু আসন পাবেন তার নেপথ্যে থাকবে সিপিএমের অবদান। বামপন্থীরা যদি বিজেপির ভোট ভালোভাবে কাটতে পারে তবেই এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে না হলে কোনভাবেই সম্ভবনা নেই। কারণ এ কথা স্বীকার করতেই হবে এই রাজ্যে আরএসএস বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রমরমার নেপথ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি প্রশাসন কর্তাদের নির্দেশ দেন যে আরএসএস প্রধানকে মিষ্টি পাঠানোর সেই রাজ্যের শাসক দল যে বিজেপির বিরোধিতা করতে পারবে না এটা নিয়ে কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
সুতরাং অধীর চৌধুরী যা বলেছেন তার দলকে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলেছেন এর জন্য কংগ্রেস হাই কমান্ডের উচিত অধীরের পাশে দাঁড়ানো। কারণ এ রাজ্যের ভেঙে পড়া কংগ্রেস কর্মীদের মনবলকে চাঙ্গা করতে হলে একমাত্র তৃণমূলের তীব্র বিরোধিতা করতে হবে। কারণ কংগ্রেসের কাছে বিপদ সিপিএম বা বিজেপি নয় এই রাজ্যের কংগ্রেসের কাছে বড় বিপদ হল তৃণমূল কংগ্রেস। যেভাবে একের পর এক কংগ্রেস এম এল এদের ভাঙিয়ে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস তার ফলে এই রাজ্যের কংগ্রেসের সংগঠনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
আর এই কারনেই অধীর চৌধুরীকে বলতে হয়েছে, ‘‘কংগ্রেসকে কেউ খতম করবে, আমি তাঁকে খাতির করব, তা তো হতে পারে না। দলের সৈনিক হিসেবে এই লড়াই আমি থামাতে পারব না।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আমার বিরোধিতা নৈতিক বিরোধিতা। আমার বিরোধিতায় কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। পশ্চিমবঙ্গে আমার পার্টি রক্ষা করার লড়াই করছি।’’
অধীরের আগের করা মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস সভাপতি যা বলেছিলেন তা হলো,‘‘হয় হাইকমান্ডের কথা মানতে হবে, তাদের সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে হবে, না হলে বাইরে যেতে হবে।’’ এবং এ-ও বলেছেন, ভোটের পর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে কী হবে না হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধীর চৌধুরী কেউ নন। সেটা ঠিক করবে হাইকমান্ড। এর দু ঘন্টা পরেই উপরোক্ত মন্তব্যটি করেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী
আসলে অধীরের এই মন্তব্য করার পেছনে অবশ্যই যুক্তি রয়েছে এই রাজ্যের কংগ্রেস দলকে টিকিয়ে রাখতে হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমালোচনা করা প্রয়োজন রয়েছে। কারণ দিল্লিতে দাঁড়িয়ে ইন্ডিয়া জোটের কথা বললেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে বিজেপির চেয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন কংগ্রেসের। বিজেপির কোন নেতাকে জেলবন্দী করা হয়নি অথচ কংগ্রেসের ভালো ভালো নেতাদের বিধায়কদের জেলে পাঠানোর হুমকি দিয়ে দলত্যাগ করানো হয়েছে। এক কথায় এই রাজ্যে কংগ্রেস দলকে কার্যত শূন্য করে দেওয়ার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে দায়ী করা যেতে পারে। আর কংগ্রেস হাই কমান্ড সবকিছু জেনেও নীরব থেকেছেন যার ফলে এই রাজ্যে কংগ্রেসকর্মীরা হতাশায় ভুগছে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
এর ফল কি হতে পারে ?এর ফল হতে পারে আর একটা ১৯৯৮ সাল। আপনাদের মনে আছে যে সিপিএমের তীব্র বিরোধিতা করে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূলের জন্ম দিয়েছিলেন মুকুল রায় অজিত পাঁজা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই তৃণমূল কংগ্রেস কংগ্রেসের সব ভোটটা কংগ্রেসের সব সমর্থনটা। নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়েছে। আর কংগ্রেস দল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে থেকে গেছে। কংগ্রেস হাইকমান্ড যদি এরপরেও ক্রমাগত অধীরকে বিরক্ত করতে থাকেন তাহলে একদিন দেখা যাবে কংগ্রেস দল আবারো ভাঙবে এখানে তৈরি হবে নতুন একটা রাজনৈতিক দল যারা এই রাজ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে গিয়ে পৌঁছাবে। অতএ ব কংগ্রেস দলকে অটুট রাখতে হলে কংগ্রেস হাইকমান্ডকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। না হলে আগামী দিনে এই রাজ্যে আবারো যে নতুন একটা রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হবে, তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর বাংলায় বিজেপির আসার পেছনে যেমন মমতার অবদান থাকবে একইভাবে অবদান থাকবে কংগ্রেস হাই কমান্ডের। এখন কংগ্রেস হাইকমান্ডকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি করবে? দলের স্বার্থ দেখবেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বার্থে দেখবেন সেটা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে কংগ্রেস হাইকমান্ডকে।