জনতার প্রতিবাদ : সরদার আমজাদ আলী
ভারতের রাজনীতির প্রকৃত নিয়ন্ত্রক কে ? স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকে স্বাধীনোত্তর ভারতের রাজনৈতিক উত্থান পতনের প্রকৃত নায়ক কারা ? তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও প্রাক্তন সাংসদ সরদার আমজাদ আলী । আজ থেকে বাংলার জনরব-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই বিশ্লেষণ । দেশকালের প্রেক্ষাপটে যা আগামী দিনে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে চিহ্নিত হবে ।
একটা রাজনৈতিক পদ্ধতি প্রকৃতির অনুদান নয় । সেটা অবশ্যই মানুষের তৈরি । এই পদ্ধতির যারা স্রষ্টা তারা তাদের নিজেদের বিশ্বাস মতই সেটা তৈরি করে তাদের জন্য , যারা প্রকৃতভাবে সেই পদ্ধতির অনুসারীর উপভোক্তা।
কিন্ত সেই স্রষ্টা কারা ? এ প্রশ্নের জবাব সর্বাত্মকভাবে দেওয়া যায় না । রাজনীতির ইতিহাসে সেই সব স্রষ্টাদের পরিচিতি হল-কেউ সম্রাট ,কেউ ফ্যাসিস্ট, কেউ সমাজবাদী , কেউ গণতন্ত্রবাদী ইত্যাদি ।
পদ্ধতির বৈচিত্র্য যাইহোক হোক না কেন , ব্যক্তি বিশেষের ভূমিকা সেই পদ্ধতির অলকৃতকরনের ক্ষেত্রে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবুও, সেই রকম কোনও এক পদ্ধতির বিবর্তনে , একটা মুখ্য নিয়ম এই যে , একটা সামগ্রিক সমাজ সেই পদ্ধতিকে আবাহন জানায় না । জানায় কিছু সংখ্যক উৎসাহী সমর্থক যারা আগ্রহী হয় যাতে সমাজের সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দ সেই পদ্ধতিকে সমর্থন করে এবং সেই ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে ওই পদ্ধতির সমর্থক হয়ে উঠুক । সেই আবহের বিরুদ্ধবাদী কন্ঠ অন্তত সাময়িকভাবে সর্বস্তরে সর্বগ্রাহ্য হয়ে ওঠে না এটাই পরম্পরা । পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত রাজনৈতিক পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে , সর্বক্ষেত্রেই সেই সব পদ্ধতির চিন্তার বৈরিতা কিংবা নির্ধারিত কোনও বিশেষ পদ্ধতির ভাববৈচিত্র্যের বিবর্তনের ইতিহাস সর্বকালের ।
এই মুহূর্তে ভারতে আমরা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত – সেই ব্যবস্থার কুশীলব এবং সাধারণ নাগরিকদের ভূমিকার একটা তুলনামূলক দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষনের প্রাসঙ্গিতা অবশ্যই রয়েছে । গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের এই অধিষ্ঠানের মূলে যে এক সাম্রাজ্যবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে আপামর দেশবাসীর সামগ্রীক যুদ্ধ –সেটা বলাই বাহুল্য । কারণ ইতিহাসগতভাবে আমরা ভারতীয় জনগন ধর্ম-বর্ণ সংস্কার – ভাষা এবং সাকারবাদী তত্বে ভিন্ন হলেও , সকলেই সম্মিলিতভাবে এক ঔপনিবেশিক শক্তির লুঠতরাজ এবং দাসত্বের উপযোগী জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না । ফলে সেই দূর্বিসহ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সঞ্জাত একটা যৌথ ঘৃণাজনিত বিদ্বেষ এবং সেই অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তির সার্বিক আগ্রহ আমাদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই জাগ্রত হয়েছিল । ভিন্নতা ছাড়াও এক সমধর্মী আগ্রহ আমাদের মানসিকতায় দেশাত্মবোধের বীজ অঙ্কুরিত করতে সহায়ক হয়েছে ।
পৃথিবীর কোনো দেশেই লুন্ঠন এবং নিপীড়নকারী অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে আমজনতা স্বতঃস্ফূতভাবে নিজেদের আগ্রহে বা উৎসাহে সেই রকম কোনও ব্যবস্থার নিধনযজ্ঞে সামিল হতে পারেনি , যতক্ষণ পর্যন্ত কিছু বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সেই বিক্ষুদ্ধ জনতাকে নেতৃত্ব দিতে না এগিয়ে এসেছে । অসীম আগ্রহে এবং ঐক্যবদ্ধ দৃঢ় প্রত্যয়ে , সমস্ত প্রতিকূলতাকে অবজ্ঞা করে আমজনতা সেই সব অগ্রণী ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীকে আবাহন জানিয়েছে এবং তাদের অনুসরন করেছে ।
তত্ত্বগত বিরোধীতা ছিল এমন গোষ্ঠীও যারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিতর্কিত ভূমিকায় অবস্থান নিয়েছিল , স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের প্রতি দেশের সাধারন নাগরিকদের সাথে তারাও সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেনি , যদিও তাত্বিক বৈপরীত্য থেকে তারা মুক্ত হতে পারেনি। তা সত্ত্বে বলা চলে , কংগ্রেস যে দিশায় দেশকে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হয়েছিল তার স্বীকৃতি ছিল সর্বজনীন । এর কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে একদিকে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিগত নিষ্ঠা , স্বচ্ছতা এবং সততা অন্যদিকে দেশকে শান্তি ,প্রগতি এবং ঐক্যের পথে নিয়ে যেতে তাঁদের দৃঢ় সংকল্পের সাথে বিশ্বভ্রাতৃত্ব , সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অংগীকারে মানুষ বিশ্বাস রাখতে পেরেছিল । এই পরম্পরা বলা যেতে পারে ইন্দিরা জামানা পর্যন্ত অটুট ছিল ।—.
( চলবে)