জেলা 

১৯টি ব্লক নিয়ে সুন্দরবন জেলার দাবীতে সোচ্চার হচ্ছে দুই ২৪ পরগণা জেলার আদিবাসী-মূলনিবাসী সমাজ

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

শরদিন্দু বিশ্বাস, গড়িয়া : উত্তর ২৪ পরগণা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুন্দরবনকে আলাদা জেলা করার কথা ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, উত্তর ২৪ পরগণার সুন্দরবন অঞ্চলের হিঙ্গলগঞ্জ-১, হিঙ্গলগঞ্জ-২, মিনাখাঁ, সন্দেশখালি-১, সন্দেশখালি-২ এবং হাসনাবাদ প্রভৃতি ৬টি ব্লককে বসিরহাটের সঙ্গে যুক্ত করে আলাদা জেলা গঠন করা হবে। প্রশাসনিক ভাবে সুন্দরবনকে এই ভাবে খন্ডিত করা এবং জনসংখ্যা বিন্যাসের পরিবর্তিত করার এই প্রক্রিয়াকে সুন্দরবনের ভুমিসন্তান তথা আদিবাসী-মূলনিবাসী সমাজ মেনে নিতে পারছে না। তাঁরা মনে করছেন যে প্রশাসনের এই ভুল পদক্ষেপের ফলে শুধু জনসংখ্যার পরিবর্তন ঘটাবে তাই নয়, পৃথিবীর সব থেকে বড় বাইয়োস্ফিয়ার বনভুমির একটি অংশ চিরকালের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে ভারতে অবস্থিত সুন্দরবনের পরিধিও ছোট হয়ে যাবে এবং কালক্রমে মুছে যাবে সুন্দরবনের ইতিহাস। তাই উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার আদিবাসী-মূলনিবাসী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে ভারতে অবস্থিত সুন্দরবনের ১৯টি ব্লক নিয়ে একটি আলাদা জেলা গঠনের দাবী উঠে আসছে।

উল্লেখ থাকে যে ১৮১৭ সালের ২৩ নং রেগুলেশন অনুসারে সুন্দরবনের শাসন ব্যবস্থাকে পৃথক ভাবে দেখানো হয়। এই বিধান অনুসারে একটি “ Commisioner’s of Sundarbans” পদের সৃষ্টি হয় এবং সুন্দরবনকে এই কমিশনারের অধীনে এনে একটি স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ১৮২২ -৩০ সালের মধ্যে লেফটেন্যান্ট হ্যাজেস এবং উইলিয়াম ডাম্পিয়ার সুন্দর বনের পরিধি নির্ধারণ করে জরিপ করেন এবং একটি মানচিত্র নির্মাণ করেন। অখণ্ড ভারতে সুন্দরবনকে চিহ্নিত করার জন্য এই সীমা নির্দেশিকা ডাম্পিয়ার-হজেস লাইন নামে পরিচিত। বর্তমান ভারতের ১৫টি থানা নিয়ে এই সুন্দরবনের আয়তন ছিল ৯,৬২৯.৯ বর্গ কিলোমিটার। সেই সময়ে কলকাতার আলিপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অখণ্ড সুন্দরবনের হেডকোয়ার্টার।

Advertisement

১৮ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সুন্দরবনের আয়তন কলকাতার উপকন্ঠ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৭৭৩ সালে মিঃ ক্লড রাসেল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ জঙ্গল হাসিল করে ইজারা দেবার বন্দোবস্ত করেন। এর আগে পর্যন্ত সুন্দরবন ছিল সাধারণের সম্পত্তি (community forest)। ১৭৮৫ সালে টিলম্যান হেংকেল সাহেব সুন্দরবন নামক বাদাবনকে আবাদ ভূমিতে পরিবর্তিত করার জন্য “হেংকেলগঞ্জ” নামে একটি নগরের পত্তন করেন। এই হেংকেলগঞ্জের বর্তমান নাম হিঙ্গলগঞ্জ। তিনি সুন্দরবনের অঞ্চলগুলিকে লট(Lot) নামে ১৬৭ ভাগে ভাগ করেন এবং ৯৯ বছরের জন্য লটদারদের লিজ দেবার বন্দোবস্ত করেন। ১৮৩০ সালে আবার একটি জরিপ করে জমিদারী পত্তনের কাজ শুরু হয়। এই আইনে বলা হয় যে লীজ গ্রহীতাদের প্রদত্ত জমির ৮% জমি জঙ্গল হাসিল করে কৃষি কাজের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। ১৯০৫ সালে সুন্দরবন –আইন (Bengal Act. I) কার্যকরী হওয়াতে সুন্দরবন কমিশনারের পদটি বাতিল হয়ে যায়।

১৯ শতকের গোড়ার দিক থেকেই জঙ্গল হাসিল করে জমিকে কৃষি কাজের উপযুক্ত করে তোলার কাজে শক্তপোক্ত পরিশ্রমী মানুষের অভিবাসন শুরু হয়। এই কাজে আদিবাসী-মূলনিবাসী মানুষদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিলকা মাঝির শালগিরা, সিধু-কানুর হুলমাহা এবং বিরসার উল্গুলানের পর ইংরেজ এবং দেশি জোতদার, জমিদারেরা বুঝতে পারনে যে আদিবাসীদের জনবিন্যাসে পরিবর্তন না ঘটালে এঁরা আবার একত্রিত হয়ে বিদ্রোহ করবে। তাই চা বাগান পত্তনের নামে এবং জঙ্গল হাসিলের নামে শুরু হয় অভিবাসন। রাঁচি, হাজারীবাগ, দুমকা, গয়া ময়ূরভঞ্জ, সরাইকেল্লা, গঞ্জাম, চাইবাসা, সম্বলপুর, রায়পুর, জব্বলপুর এবং দেশের বিভিন্ন আদি জনপদগুলি থকে নিয়ে আসা হয় আদিবাসী-মূলনিবাসী সমাজের মানুষদের। অকল্পনীয় কায়িক শ্রমের মাধ্যমে তাঁরাই হেঁতাল, বোগড়ার ঝোপঝাড়, গরান, বাইন, ক্যাওড়া, সুন্দরী গছের জঙ্গলকে সাফ করে বিস্তীর্ণ এলাকাকে চাষযোগ্য এবং বাসযোগ্য করে তোলে এবং ২৪ পরগনা জেলাকে শস্যশ্যামলে পরিণত করে।

ভারত বিভাজনের ফলে সুন্দরবনের অধিকাংশ অঞ্চলই পূর্ব পাকিস্তানের( বর্তমান বাংলাদেশ) মধ্যে চলে যায়। সুন্দরবনের যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে পড়ে তার নামকরণ হয় ২৪ পরগণা জেলা। বঙ্গ বিভাজনের প্রভাবে সুন্দরবনের স্বতন্ত্র শাসন ব্যবস্থা খানিকটা শিথিল হয়ে পড়লেও ১৯৫১ সালের ১লা এপ্রিল প্রশাসনিক কাজকর্ম চালিয়ে যাবার জন্য ২৪ পরগণার জন্য বন অধিকর্তা (Director of Forest) নিয়োজিত হয়। ১৯৮৩ সালে ডঃ অশোক মিত্রের পরামর্শে ২৪ পরগণা জেলাকে আবার ভাগ করে উত্তর ২৪ পরগণা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা নামে দুটি জেলাতে পরিণত করা হয়। এই বিভাজনের ফলে সুন্দরবনের মোট ১৯টি ব্লকের ৬টি ব্লক চলে যায় উত্তর ২৪ পরগণায় এবং ১৩টি ব্লক দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সাথে যুক্ত হয়। প্রশাসনিক এই বিভাজনের ফলে আদিবাসী-মূলনিবাসীদের জনবিন্যাসও খন্ডিত হয়ে যায়। অবিভক্ত ২৪ পরগণায় সুন্দরবন অঞ্চলে এসসিদের জনসংখ্যা ছিল ৩৬% এবং এসটিদের সংখ্যা ছিল ৫% কিন্তু বিভাজিত অবস্থায় উত্তর ২৪ পরগনার সুন্দরবন অঞ্চলে এসসি সংখ্যা মোটামুটি একই থাকলেও এসটিদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১.৮১%। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এসসিদের সংখ্যা হয় ৩৫.৪৪% কিন্তু এসটিদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২.৪১%।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী দক্ষিণ ২৪ পরগণার ১৩টি ব্লক নিয়ে যে সুন্দরবন জেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন সেই বনাঞ্চলে এসটিদের সংখ্যা হবে মাত্র ২.৪১%। আদিবাসীরা মনে করছেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠ এসটিদের বসিরহাট জেলার সঙ্গে যুক্ত করে তাঁদেরকে বনাধিকার আইন-২০০৬ থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পাশাপাশি সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকেও চিরকালের জন্য ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

আমাদের মনে রাখা দরকার যে ১৯৮৭ সালে যে অখণ্ড সুন্দরবনকে ইউনেস্কো “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ” বলে আখ্যা দিয়েছে এবং ১৯৮৯ “ম্যান এন্ড বাইয়োস্ফিয়ার প্রোগ্রামের” আওতায় সুন্দরবনকে “বাইয়োস্ফিয়ার রিজার্ভ” বলে স্বীকৃতি দিয়েছে তার অধীনেই রয়েছে সুন্দরবনের এসটি এবং আদার ট্র্যাডিশনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স কমিউনিটি। কোন ভাবেই পৃথক প্রশাসনিক বিভাজন করে সুন্দরবনের এক বিশাল অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় না এবং জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসটি এবং আদার ট্র্যাডিশনাল ফরেস্ট ডোয়েলার্স কমিউনিটিদের বনাধিকার আইন-২০০৬ থেকে বঞ্চিত করা যায় না। তাই প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য যদি পৃথক জেলা গঠনের প্রয়োজন হয় তবে ১৯ ব্লক নিয়ে সুন্দরবনকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়া হোক।

সুন্দরবনের আদিবাসীদের দাবীঃ

১)সুন্দরবনের নামে জেলা করতে চাইলে সুন্দরবনের পরিবেশ সুরক্ষা ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে সুন্দরবনের ১৯টি ব্লক নিয়েই “সুন্দরবন জেলা” গঠন করতে হবে।…”সুন্দরবন জেলা” গঠন করতে গিয়ে সুন্দরবনের কোন অংশ থেকেই সুন্দরবনের নাম মুছে ফেলা যাবে না।

২)অবিলম্বে সাগর থেকে হিঙ্গলগঞ্জ পর্যন্ত রেল সহ উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

৩)সুন্দরবনের ১৯টি ব্লকেই নিবিড় বনসৃজন বা সবুজায়ন প্রকল্প রূপায়ন করতে হবে।

৪)সুন্দরবনের আদিবাসীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে “সুন্দরবন আদিবাসী উন্নয়ন পর্ষদ” গঠন করতে হবে।

৫)অবিলম্বে সুন্দরবনের সমস্ত ফেক এস.টি.দের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৬)হাড়োয়া ব্লক সহ সুন্দরবনের অন্যান্য ব্লকের আদিবাসীদের হাজার হাজার বিঘা জমির অবিলম্বে পাট্টা সমস্যা সমাধান করতে হবে।

৭)সুন্দরবনের আদিবাসীদের কাছ থেকে ছলে বলে কলে কৌশলে কেড়ে নেওয়া সমস্ত ফেরতযোগ্য জমি অবিলম্বে ফেরত চাই।

৮)সুন্দরবনের সন্দেশখালী-২ব্লকে অবিলম্বে বিরসা মুণ্ডার নামে একটি ডিগ্রী কলেজ চাই।

৯)ক্যানিং টাউনে অবিলম্বে “সুন্দরবন বিশ্ববিদ্যালয়” চাই।

১০)সুন্দরবনের প্রতিটি নদী বাঁধ উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গড়ে তুলতে হবে।

১১)সুন্দরবনের পরিবেশ বাঁচাতে অবিলম্বে পরিবেশ ধ্বংসকারী সমস্ত অবৈধ লোনা ফিশারী ও ইটভাটা বন্ধ করতে হবে।

১২)সুন্দরবনের চাষযোগ্য জমিকে তিন ফসলীর উপযোগী করে তুলতে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

১৪)জেলা গঠনের অজুহাতে সুন্দরবনকে খণ্ডিত করে সুন্দরবনের পরিবেশ ধ্বংস করা চলবে না।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ