ওয়াকফ সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি শেষ, আগামীকাল ফের শুনানি! আইনজীবীরা কী বললেন? প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, জানতে হলে ক্লিক করুন
বাংলার জনরব ডেস্ক : মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১ টা থেকে সুপ্রিম কোর্টে শুরু হয়েছে সংশোধিত ওয়াকফ আইনের উপর শুনানি। শুনানির প্রথম পর্বে ই কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয় পূর্বে যে তিনটি বিষয়ের উপর কেন্দ্র হলফনামা জমা দিয়েছে, সেই বিষয়গুলির উপরেই মামলাকে সীমিত রাখার। যদিও তাতে আপত্তি জানান মামলাকারী পক্ষের আইনজীবী কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিরা।
এরপরেই প্রধান বিচারপতি বিআর গবই এবং বিচারপতি এজি মাসিহের বেঞ্চ জানায়, ওয়াকফ সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে যে সব আবেদন জমা পড়েছে আদালতে, তা শোনা হবে। তার পরেই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে, সংশোধনী আইনে স্থগিতাদেশ দেওয়া হবে কি না।
এরপরই প্রখ্যাত আইনজীবী কপিল সিব্বাল সুপ্রিম কোর্ট কে বলেন, আইনটি ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তিকে দখল করার জন্য আইনটি তৈরি হয়েছে। আইনটি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে কোনও প্রক্রিয়া ছাড়াই ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে নেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, ওয়াকফ সম্পত্তি হল দান করা সম্পত্তি। এটি অন্য কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। এক বার যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি হয়ে যায়, সেটি ওয়াকফই থাকে।
সিব্বল আরও জানান, দেশের সংবিধান অনুসারে কোনও সরকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ দিতে পারে না। মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ দিতে পারে না রাষ্ট্র। ব্যক্তিগত সম্পত্তি দিয়ে একটি কবরস্থান তৈরি করতে হয়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ তাঁদের জীবনের শেষ অধ্যায়ে নিজেদের সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে উৎসর্গ করেন।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি দান প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি গবই বলেন, “এমনটা তো মন্দিরেও হয়। আমি দরগায় যাই, সেখানেও এমন হয়।”
খাজুরাহোও তো সংরক্ষিত সৌধ, প্রার্থনাও হয়: প্রধান বিচারপতি
আগের আইনের থেকে বর্তমানের আইনের ফারাক বোঝাতে গিয়ে সিব্বল জানান, কোনও প্রাচীন সৌধকে সংরক্ষিত করা হলেও সেটির পরিচয় বদল করা হয়নি আগে। যেটি ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত ছিল, সেটি তেমনই রাখা হয়েছিল। সেটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। সে কথা শুনে প্রধান বিচারপতি বলেন, “খাজুরাহো মন্দির একটি প্রাচীন সৌধ হিসাবে সংরক্ষিত রয়েছে। তবু লোকে সেখানে প্রার্থনা করতে যায়।” প্রধান বিচারপতি গবইয়ের প্রশ্ন, “এটি কি আপনার প্রার্থনার অধিকার কেড়ে নিতে পারে?” এই প্রশ্নের জবাবে সিব্বল জানান, ১৯৫৮ সাল অনুসারে যেগুলিকে প্রাচীর সৌধ বা সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলি আর নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না। সে ক্ষেত্রে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য না হলে সেখানে প্রার্থনা করা যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্য নিয়ে প্রশ্ন সিব্বলের
শুনানিতে সিব্বল জানান, এই আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সিংহভাগ সদস্যকেই অমুসলিম রাখার কথা বলা হচ্ছে। নতুন আইনের ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউন্সিলে মুসলিম সদস্য থাকবেন ১০ জন এবং অমুসলিম সদস্য থাকবেন ১২ জন। আগে সকলেই মুসলিম ছিলেন।
ওয়াকফকে সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে কেন শর্ত? সওয়াল সিব্বলের
সিব্বলের বক্তব্য, “নতুন আইন অনুসারে ওয়াকফকে সম্পত্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত চাপানো হয়েছে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সম্পত্তি দানের আগে পাঁচ বছর মুসলিম ধর্ম পালন করতে হবে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নেবেন? যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় শায়িত থাকেন এবং ওয়াকফকে সম্পত্তি দান করতে চান, তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি মুসলিম ধর্ম পালন করছেন! এটি তো অসাংবিধানিক।”
সংশোধিত ওয়াকফ আইনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন সিব্বলের
শুনানির একটি পর্যায়ে সিব্বল জানান, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপের উদ্দেশ্য কখনোই ছিল না ওয়াকফ সংক্রান্ত আগের আইনগুলিতে। কিন্তু ২০২৫ সালের নতুন আইনে সেটি সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে বলে জানান সিব্বল।
‘মামলা না-হলে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারে না’
প্রধান বিচারপতি গবই শুনানির একটি পর্যায়ে বলেন, “ধরে নেওয়া যেতে পারে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা আছে। নির্দিষ্ট কোনও মামলা না-হলে আদালত তাতে কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কলেজ থেকে আমাদের এটাই শেখানো হচ্ছে… অন্যথায়, আমরা জানি কী ঘটছে।”
আইনের দু’টি ধারা মূল বিলে ছিল না! দাবি সিব্বলের
বিরতির পর প্রধান বিচারপতির এজলাস বসলে আবার সওয়াল শুরু করেন সিব্বল। আদালতে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া একটি তালিকা দেখিয়ে তিনি বলেন, “একবার সম্পত্তিগুলি সংরক্ষিত হয়ে গেলে সেগুলির আর ওয়াকফ বলে বিবেচিত হবে না। এর মধ্যে সম্ভলের জামা মসজিদও রয়েছে। কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব তৈরি হলেই সেটিকে আর ওয়াকফ বলে বিবেচনা হবে না। যে তালিকাটি রয়েছে সেটিও সম্পূর্ণ নয়।” পাশাপাশি নতুন আইনের ৩ডি এবং ৩ই ধারায় যেগুলি উল্লেখ রয়েছে, সেটি প্রকৃত বিলে উল্লেখ ছিল না বলেও দাবি সিব্বলের। তাঁর বক্তব্য, যৌথ সংসদীয় কমিটিতেও এগুলি নিয়ে আলোচনা হয়নি।
সংসদেও আলোচনা হয়নি ওই দুই ধারায়? প্রশ্ন প্রধান বিচারপতির
আইনের দু’টি ধারার প্রসঙ্গে সিব্বলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি গবই জানতে চান, সংসদেও এই নিয়ে আলোচনা হয়নি? বিচারপতি মাসিহও বলেন, “সংসদে তো ভোটাভুটি হয়েছিল”। তখন সিব্বল জানান, নিশ্চয়ই ভোটাভুটির ঠিক আগে এটি যুক্ত করা হয়েছিল।
উঠল বুদ্ধগয়ার প্রসঙ্গ
ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলিম সদস্যদের কেন রাখা হচ্ছে, তা নিয়ে আবারও আদালতে প্রশ্ন তোলেন সিব্বল। তাঁর বক্তব্য, আগে এই কাউন্সিলে সকলেই মুসলিম ছিলেন, কিন্তু এখন সিংহভাগ সদস্যই অমুসলিম রাখার কথা হচ্ছে। এই অবস্থায় বুদ্ধগয়ার প্রসঙ্গ তোলেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর প্রশ্ন, “বুদ্ধগয়া নিয়ে কী বলবেন? সেখানে তো সকলে হিন্দু।” তখন সিব্বলের বক্তব্য, “কারণ, সেটি হিন্দু এবং বৌদ্ধ উভয়েরই উপাসনাস্থল। বুদ্ধগয়া আইনেও এ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্ন করবেন।”
‘ব্রিটিশেরাও সংজ্ঞা বদল করেনি’
সিব্বলের সওয়ালের রেশ ধরেই সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী রাজীব ধাওয়ান। তাঁর বক্তব্য, ধর্মীয় সম্পত্তির বিষয়ে এ ভাবে ব্যাখ্যা আগে কখনও করা হয়নি। তিনি বলেন, “ব্রিটিশেরাও ধর্মীয় সম্পত্তির সংজ্ঞা পরিবর্তন করেনি। ওয়াকফের ধারণার এই ব্যাপক পরিবর্তনের কারণ কী ছিল?”
উঠল ধর্মনিরপেক্ষতার কথা
ধওয়ান বলেন, “আমরা এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বাস করি। আমার এক মক্কেল আছেন, তিনি শিখ। তিনি বলছেন, ওয়াকফে সম্পত্তি দিতে চান। আমি আশা করি ওই সম্মত্তি কেড়ে নেওয়া হবে না।”
আদৌ কি ওয়াকফের সম্পত্তি বৃদ্ধি পেয়েছে, সংশয় সিঙ্ঘভির
ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ কি আদৌ বৃদ্ধি পেয়েছে? সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আইনজীবী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। তাঁর বক্তব্য, ২০১৩ সাল থেকে ওয়াকফগুলি একটি পোর্টালে নিবন্ধীকরণ শুরু হয়েছিল। পোর্টালের তালিকায় সেই বৃদ্ধিকে ওয়াকফের পরিমাণ বৃদ্ধি বলে কেন্দ্র দেখাতে চাইছে বলে দাবি সিঙ্ঘভির। যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “২৮টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৫টি রাজ্যে সমীক্ষা হয়েছে। ৯.৩ শতাংশ সমীক্ষা হয়েছে।”
আইনের ৩ডি ধারায় পূর্ণ স্থগিতাদেশের আর্জি
সংশোধিত ওয়াকফ আইনের ৩ডি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মামলাকারী পক্ষের অপর আইনজীবী হাফেজ়া আহমদিও। তাঁরও বক্তব্য, “সংবিধানের ৩ডি ধারার মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। বহু পুরনো মসজিদে এর প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” আইনের এই ধারার উপর সম্পূর্ণ স্থগিতাদেশের আর্জি জানান তিনি। ওয়াকফের সম্পত্তি দানের ক্ষেত্রে ৫ বছর ইসলাম ধর্ম পালনের যে শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে আইনে, তা নিয়েও প্রশ্ন আহমেদির। কেউ পাঁচ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কি না, তা যাচাই করার মাপকাঠি কোথায় উল্লেখিত রয়েছে? প্রশ্ন আইনজীবীর।
আগামীকাল পুনরায় শুনানি শুরু হবে বুধবার বেলা সাড়ে 11 টায়। এ পর্যন্ত আগের নির্দেশ বহাল থাকবে বলে জানা গেছে। আগামীকাল এ বিষয়ে সরকারপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনবেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ।