কলকাতার প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বরাক ভাষা দিবস উদযাপন
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা: ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার স্বাধিকার রক্ষার লড়াই করতে এক মহিলা সহ যে ১১ জন শহীদ হয়েছেন তাদে শ্রদ্ধা জানিয়ে বরাক ভাষা দিবস পালন করল কলকাতার বাংলা ভাষা মঞ্চ। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের
এ কে বসাক অডিটোরিয়ামে ১৯ মে সর্ব ভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চ, ঐকতান গবেষণা পত্র ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ভারতে বাংলা ভাষা দিবস ১৯শে মে পালিত হল। বরাকের ভাষা আন্দোলন ১৯শে মে-র শিক্ষা ও আমাদের ভাষা আন্দোলন– বিষয়ে আলোচনা চক্র, সঙ্গীত ও কবি সম্মেলনের বিশাল সে আয়োজনে নন্দিত ছিল এ ভাষা দিবস। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মঞ্চের প্রবীণ রাজ্য সম্পাদক ডাঃ দুলালকৃষ্ণ দাস ও কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি শ্রী গোপাল চক্রবর্তী। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সমাজ ভাষা গবেষক নীতীশ বিশ্বাস,(বাংলা ভাষা মঞ্চের কেন্দ্রীয় সম্পাদক) প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এসিস্টট্যান্ট প্রোফেসর ড.শান্তি সরেন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েরন বাংলা বিভাগীয় প্রধান, অধ্যাপক উত্তম কুমার বিশ্বাস ও মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রবীণ নেতৃত্ব কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শ্রী অঞ্জন ঘোষ এবং বিশেষ আমন্ত্রিত অধ্যাপক শ্যামল গন ( অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী জন্ম শত বর্ষ কমিটি), আর কবি সম্মেলন উদ্বোধক প্রবীণ কবি অধ্যাপক পরিমল ঘোষ।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কুমারী বৈমিত্রা ঘোষ, রূপকথা মন্ডল, বৃষ্টি শীল, অদ্রিজা দাশ-এর সুগীত সমবেত সঙ্গীতে সৃষ্ট এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে ১৯শের একাদশ শহিদ ও অন্যান্য ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
সমগ্র অনুষ্ঠানটি সুন্দর ভাবে সঞ্চালনা করেন কবি দিলীপ পাল ও অধাপিকা যূথিকা পান্ডে। আবৃত্তিতে অংশ নেন বাক্ শিল্পী রনেন ধাড়া, পারমিতা বিশ্বাস, ইন্দিরা ব্যানার্জি, জয়ন্ত সরকার, সৃজিতা রায়, জয়স্মিতা ঘোষ ও সজল শ্যাম।
স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন কবি শোভা মণ্ডল, কল্যাণী ঠাকুর, দেবাশিস মন্ডল, , রাধেশ্যাম সরদার, ইরা চক্রবর্তী,বিশ্বজিৎ সিনহা, দীপঙ্কর বিশ্বাস, তাপসী আচার্য, সীমা সোম, শৈবাল চট্টোপাধ্যায়,অর্চনা মন্ডল, বৈশালী বিশ্বাস, আব্দুর রহমান, কামাখ্যা রঞ্জন দাস, ও চিন্ময়ী বিশ্বাস।
সঙ্গীতে অংশনেন , ড.দেবাশিস দত্ত, অরুণ ভট্টাচার্য, সীমা মজুমদার, অপরাজিতা হালদার, রত্নদীপ চক্রবর্তী, সাধনা গোলদার, ও যাদবপুর ঐকতানের শিল্পী নূপুর লোধ, মুনমুন সাহা, সীমা চ্যাটার্জি, ও লতিকা মন্ডল।
সূচকবক্তা নীতীশ বিশ্বাস বলেন,ভারতে ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সফল ও রক্ত দায়ী সংগ্রামের মহান স্মারক ১৯৬১-র ১৯শে’মে। কংগ্রেসের তীব্র বিরোধিতা ও পদেপদে ভ্রান্ত নীতির জন্য সুভাষচন্দ্রের বাংলা ও বাঙালি আজও নিষ্পেষিত হচ্ছে। আর এখন তো সে আক্রমণ সর্বগ্রাসী। তার বিরুদ্ধে দরিদ্রশ্রেণিকে সচেতন করে সংগঠিত না করতে পারলে বনেদী ও ধনী বাঙালিরা তাদের শ্রেণী চরিত্রের জন্যই ভাষা গণতন্ত্রের পক্ষে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াবে না । তা সত্ত্বেও আমাদের রবীন্দ্র নজরুলের আদর্শে ভাষার জন্য সমবেত ভাবে রাস্তায় নামতে হবে। ভাষা রাজনীতি ও ভাষা অর্থনীতির যুদ্ধে দরিদ্র ও দলিতের যুথ বদ্ধ আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে হবে।
অধ্যাপক উত্তম বিশ্বাস বলেন, প্রান্তিক মানুষের জন্যই বাংলা ভাষা এ রাজ্যে এখনও বেঁচে আছে। বাংলা ভাষা মঞ্চ তার পূর্ব সংগঠন সহমর্মীর মাধ্যমে ২০০১ সালে উত্তর খণ্ড-উত্তর প্রদেশের বাঙালি বিতাড়নের তথা তাদের পরে জারি হওয়া আসামের বাইরে প্রথম (NRC ) এন আর সি-র সফল প্রতিরোধ করে। আজও বাংলা ভাষা মঞ্চ রেলে বাংলা ভাষা ব্যবহার, চাকুরিতে বাংলার অধিকার , আকাশবাণীর দিল্লি থেকে সংবাদ বিভাগ তুলে দেবার প্রতিবাদে, দূর দর্শনে বাংলা ভাষা, বাংলাগান ও সিনেমার নিয়মিত সম্প্রচার বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। তামিল নাড়ু,কেরল সহ দক্ষিণ ভারতের মতো একটি ভাষা হিসেবে বাংলাকে সবধরনের স্কুলে আবশ্যিক করার সকারী ঘোষণা অবিলম্বে কার্যকর করার আন্দোলনে ভাষা মঞ্চ সর্বাগ্রে। এ সবই ১৯শের ঐতিহ্যের সার্থক অনুসরণ।
অধ্যাপিক শান্তি সরেন বলেন ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের সামনে ১৯৫২-র ঢাকার আর ১৯৬১র শিলচরের আন্দোলন। আমাদের মানভূম আন্দোলনের দুটি দিক । এক তার ভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন আর অন্যটি তার ভূ-ভাগ রক্ষার আন্দোলন,। তিনি বলেন নরওয়ে বা সুইডেনে বসবাস কারী সব ভাষার মানুষকে তার মাতৃভাষা আবশ্যিক ভাবে পড়তে হয়। যা আমাদের মতো উন্নত ভাষার মানুষও সব সময় পড়েন না। এটা যে কোনও জাতির পক্ষে চরম দুর্বলতা।
সভাকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক শ্যামল কুমার গন । তিনি বলেন কলকাতা ১৯৬১-র ২৪শে মে অধ্যাপক দিলীপ চক্রর বর্তী নেতৃত্বে আয়জিত হয় সুদীর্ঘ মৌণ মিছিল ও আর সতস্ফূর্ত ভাবে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। সেটাই ছিলো কলকাতায় প্রথম ১৯শে উদযাপন; যা কলকাতার এক উজ্জ্বল ইতিহাস। অনুষ্ঠানের সহাপতি ডা. দুলাল কৃষ্ণ দাস আহবান জানান বাংলা ভাষার এই মহা সংকটের দিনে নানা মত ও পথের মানুষকে একত্রিত ভাবে ১৯শের আত্ম ত্যাগকে স্মরণে রেখে মাতৃ ভাষার জন্য আন্দোলনে সক্রিয় হতে হবে। বাংলা ভাষা মঞ্চ যে সংকীর্ণতাহীন ও মাতৃভাষার জন্য নিবিড় সংগ্রামে নিবেদিত তার সঙ্গে সব সুস্থ মনের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
কবি সম্মেলনের উদ্বোধক অধ্যাপক পরিমল ঘোষ বলেন কবি ছাড়া জয় বৃথ। কবি হচ্ছে সময়ের প্রহরী । সে কখনো রবীন্দ্র নাথের দার্শনিকতায় কখনো নজরুল ইসলামের বিপ্লবী আহ্বানে আর সুকান্তের মতো তীব্র রাজনোতিক দ্যোতনায় ব্যক্ত করে তারত আনন্দ বেদনা । আজকের কবিকেও এই অনাচার , এই আগ্রাসন আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কলম তুলে নিতে হবে। ঘরের কবিকে পরের কবি বা রাস্তার কবিও হতে হবে। তি নি বলেন, ভাষা মঞ্চের একটি স্লোগান আছে “ নদী শুকাইয়া গেলে মাঝি সোনার নৌকা ভাসাইবেন কোথায় ? “ কবিরা একথা টি ভুলবেন না, এই আবেদন।।
দ্বিতীয় পর্বের সভাপতি শ্রী গোপাল চক্রবর্তী বলেন, ভাষাই জাতির মূল পরিচয়। ভাষা তার মানবিক আবেগ। কোনও জাতিকে দুর্বল করতে চাইলে তার ভাষাকে দুর্বল ও হরণ করতে হয়। আমাদের স্বাধীনদেশে তা সুচতুর ভাবে করে যাচ্ছে, আমাদের শাসক শ্রেণী। মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হলে শিক্ষায় ও জীবিকায় মাতৃভাষা আবশ্যিককরতে হবে । নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাষা আন্দোলনকে সঞ্চারিত করার মাধ্যমেই ১৯শে মে বেঁচে থাকবে।