সুফি সাধক হযরত সৈয়দ মুরশেদ আল কাদেরীর ১২৩ তম উরুস উপলক্ষে মেদিনীপুর শহর সাজো সাজো রব, বাংলাদেশ থেকে আসছে বিশেষ ট্রেন
মুস্তাক আহমেদ চৌধুরী : উনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক ‘মওলা পাক’- নামে খ্যাত হযরত সৈয়দ শাহ মুরশেদ আলী আল কাদেরী-র ১২৩ তম বার্ষিক উরস উৎসব আগামী শনিবার বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৪ই ফাল্গুন পালিত হতে চলেছে। এই উপলক্ষ্যে মেদিনীপুর শহরের জোড়া মসজিদে মওলা পাকের মাযার শরীফে, তাঁর খানকাহ শরীফ দায়রা পাকে ও সাধনস্থল কাঁসাই নদীর তীরে অবস্থিত ইস্ত্রীগঞ্জ পাকে কয়েকদিন আগে থেকেই ভক্ত ও পুণ্যার্থীদের ঢ্ল নেমেছে।
এই আন্তর্জাতিক উৎসবের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার পুণ্যার্থী নিয়ে স্পেশ্যাল ট্রেনের সরাসরি মেদিনীপুর স্টেশনে আগমন। নিঃসন্দেহে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

এ বছর বাংলাদেশের রাজবাড়ী জেলার রাজবাড়ী স্টেশন থেকে আজ ১৪ তারিখ বুধবার রাত ১০ টা নাগাদ ২৪ কোচের বিশাল ট্রেন মোট ২২৬০ জন পুণ্যার্থী(পুরুষ – ১৩২০, মহিলা – ৮৫৫, অপ্রাপ্তবয়স্ক – ৮৫) নিয়ে রওয়ানা হয়েছে। ট্রেনটি বাংলাদেশের দর্শনা বর্ডার হয়ে পরের দিন সকালে ভারতের গেদে বর্ডারে পৌঁছাবে। সেখান থেকে বিকেলে রওয়ানা হয়ে রানাঘাট ও দমদম হয়ে পরের দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ভোর ৫ টা নাগাদ মেদিনীপুর স্টেশনে এসে পৌঁছাবে।
পূর্ববঙ্গে মওলা পাকের অসংখ্য ভক্ত থাকার কারণে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের ৪ই ফাল্গুন(১৯০১) মওলা পাকের ‘বেসালে হক’ এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯০২ সালের প্রথম উরস থেকেই তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার পূর্ব বঙ্গের রাজবাড়ী জেলা থেকে এই স্পেশাল ট্রেন প্রতি বছর মেদিনীপুর আসতে শুরু করে। ভারত স্বাধীন হওয়া এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরেও এই ঐতিহ্য সমানে চলে আসছে।
আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে এই বংশের মহান পুরুষ হযরত সৈয়দ শাহ আব্দুল্লাহ আল জিলী আল বাগদাদী বাগদাদ শরীফ থেকে হিন্দুস্থানে তশরিফ আনেন। তিনি বড় পীর সাহেব হযরত আব্দুল কাদের জিলানী-র ১৫ তম বংশধর। বর্ধমানের মঙ্গলকোটে কিছু দিন অবস্থান করার পরে তিনি ফিরে গেলেও দুই পুত্রকে রেখে যান। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ‘গওসে সানী পাক’ নামে পরিচিত হযরত সৈয়দ শাহ যাকের আলী আলকাদেরী মঙ্গলকোটেই থেকে যান। সেখানে প্রতি বছর ৫ ই যিলহজ তাঁর উরস পালিত হয়। অপর শাহযাদা ‘কুতুবে বারী পাক’ নামে খ্যাত হযরত সৈয়দ শাহ রওশন আলী আলকাদেরী বিহারের পূর্ণিয়া জেলার হযরত রওশনগঞ্জে চলে যান। সেখানেই তাঁর মাযার পাক রয়েছে। স্থানীয় হিন্দি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩রা ফাগুন তাঁর উরস পালিত হয়। এই দুটি স্থানেই বর্তমানে সুদৃশ্য মসজিদ ও খানকাহ শরীফ নির্মিত হয়েছে।
তাঁদের পৌত্র ‘আলা হুযুর পাক’ নামে খ্যাত হযরত সৈয়দ শাহ মেহের আলী আলকাদেরী-র আমল থেকেই মেদিনীপুর তাঁদের সাধনস্থল হয়ে ওঠে। তাঁর ই পুত্র ও পরবর্তী সাজ্জাদানশীন এই ‘মওলা পাক’।
প্রত্যেক যুগে এই মহান বংশ থেকে একজন মহাপুরুষ সুফি জগতের সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকেন ও সর্বময় দায়িত্ব ও কতৃত্ব পালন করে থাকেন- তাঁকে ‘সাজ্জাদানশিন’ বলা হয়। ‘সিলসিলা এ কাদেরিয়া’-র ঐতিহ্য অনুসারে পরিবারের জৈষ্ঠ পুত্র এই পদ অলংকৃত করেন। ‘মওলা পাকের’ পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন হযরত সৈয়দ শাহ এরশাদ আলী আলকাদেরী যিনি ‘পীর ও মুর্শিদ পাক’ নামে পরিচিত। তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান হযরত সৈয়দ শাহ মুস্তারশিদ আলী আলকাদেরী কে – যাঁকে বলা হয় ‘সানী মওলা পাক’। তাঁর পরবর্তী সাজ্জাদানশিন হন ‘বড় হুযুর পাক’ নামে খ্যাত হযরত সৈয়দ শাহ রশীদ আলী আলকাদেরী। তাঁর সময়েই কলকাতার ৪ নম্বর হাজী মুহাম্মদ মহসিন স্কোয়ারের দরবার তাঁদের বাসস্থান হয়।
২০২১ সালের ১৬ ই আগস্ট ‘মওলা পাক’ এর প্রপৌত্র ‘বড় হুযুর পাকের’ বেসালে হক এর পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত সাজ্জাদানশিন এবং সেইসঙ্গে মেদিনীপুর জোড়া মসজিদ ও মাযার শরীফের মুতাওয়াল্লী হন হযরত সৈয়দ শাহ ইয়াসূব আলী আলকাদেরী। তাঁর পরিচালনায় ও তত্ত্বাবধানে বর্তমানে এই উরস পালিত হচ্ছে।
গওস পাকের দরবারের সেই একই ফায়েয- একই ঐতিহ্য সমানে চলে আসছে। এখানে উচ্চ-নীচ, ধনী -দরিদ্র কোন ভেদাভেদ নেই। এই দরবার জাতি- ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য অবারিত। তাই কলকাতার ৪ নম্বর হাজি মুহাম্মদ মহসিন স্কোয়ারের দরবার পাকে সারা বছরই পাপী-তাপী, অসহায় ও বিপদগ্রস্ত মানুষের ভীড় লেগে থাকে।