শারদীয় উৎসব উপলক্ষে বাংলার জনরব এর বিশেষ সাহিত্যের ডালি /৪
আজ মহাসপ্তমী। সমগ্র বাঙালি সমাজ উৎসবের মেজাজে। আর এই উৎসবের দিনে আর পাঁচ দিনের মতো সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চায় বাঙালি সমাজ। সেদিকে তাকিয়ে বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালের উদ্যোগে প্রকাশিত হচ্ছে বিশেষ সাহিত্য সংখ্যা। এই সাহিত্যের পাতায় লিখেছেন বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপিকা যুথিকা পাণ্ডের একটি প্রবন্ধ ‘সাম্প্রদায়িকতাহীন মানবিক পৃথিবী’। রয়েছে উপেক্ষিতা শর্মার দুটি কবিতা,’সেদিন চুম্বনের আগে’ ও ‘নিষিদ্ধ প্রেম’। কবি বন্দনা মালিকের লেখা কবিতা ‘কলমের কালিমা’।
অপর্না হালদারের লেখা কবিতা ‘তুমি আসবে বলে’।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ফারহানা শারমিন জেনির লেখা কবিতা ‘শরৎ উৎসব’।
কবি মধুসূদন পালের ‘দীনের দুর্গোৎসব’। কবি সুশান্ত পাড়ুই এর লেখা কবিতা ‘লিখব না আর ছড়া’।
শেখ আব্দুল মান্নানের কবিতা ‘এসো কবিতা লিখি’।
প্রখ্যাত কবি আফ্রুজা খাতুনের লেখা কবিতা ‘আঁধারে আলো’।
মুকুল রঞ্জন দাসের লেখা কবিতা ‘পূজার মজা’। আশা করি পাঠকদের আমাদেরই এই উপহার ভালো লাগবে। সবাইকে জানাই শারদীয়া উৎসবের শুভেচ্ছা এবং আগামী দিন সকলের ভালো কাটুক এই কামনা করি। সম্পাদক, বাংলার জনরব।
————————————————————–
সাম্প্রদায়িকতাহীন মানবিক পৃথিবী
যূথিকা পান্ডে
সংস্কৃতির মূল কথা হলো মৈত্রী ও সংহতি। আর ভারতীয় দর্শনের মূল কথাই হল মৈত্রী তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি।ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় প্রাচীন কাল থেকেই শক, হুন,পাঠান প্রভৃতি জাতি এই উপমহাদেশে এসেছে বারে বারে। ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতি, ধর্ম বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা, জীবনাচরণ, সামাজিক প্রথা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভাস প্রভৃতি বিষয়ে পার্থক্য থাকলেও সকলের স্বাতন্ত্র্যকে জায়গা করে সামঞ্জস্য ও ঐক্য স্থাপন করেছে।ভারতবর্ষ বৈচিত্র্যময় দেশ তায় তার জনগোষ্ঠীর বিচিত্রতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে পেরেছিলেন —
“হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন,
শক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।”
আমরা প্রত্যেকে দেশমাতৃকার সন্তান, দেশকে ভালো না বাসলে দেশের উন্নতি কখনো সম্ভব নয়। তাই আবার কবির কথায় যেতে হয় –“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।” যারা দেশকে ভালোবাসবে তাদের প্রত্যেকের লেখায় এই কথাই উঠে আসবে। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছিলেন –“আমরা জন্ম থেকে দেশের জন্য বলি প্রদত্ত।” কারণ মানুষ যেখানে জন্ম নেয় তখন থেকেই সে দেশের সন্তান। তাই দেশকে উন্নত করার জন্য আমাদের ই সর্বাগ্রে এগোতে হবে। দেশ উন্নত হলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি হবে। তবেই একটি সুঠাম দেশ গঠন হবে।
সাম্প্রতিককালে কিছু মানুষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। যেমন ১৯৭১ সালে বা তার আগে পাকিস্তান থেকে অনেক বাঙালি পরিবার ছিন্নমূল হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম এমনকি উত্তরপ্রদেশে আশ্রয় নিয়ে পরিশ্রমে বেঁচে থাকার রসদ যুগিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখতে পাই রোহিঙ্গাদের ওপর যে লাঞ্ছনা যা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে তোলে, মানুষের সামান্যতম চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান পায় না অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে তখনই তারা বিরূপ আকৃতি ধারণ করে। ভারতীয় নাগরিক যেকোনো অঞ্চলে বাস করুক না কেন, যেকোন স্থানে তাদের বসবাস করার অধিকার আছে এটা জেনেও আমরা দেখতে পাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় বহু প্রাণ ও দেশের বহু সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে বা হচ্ছে যা প্রায়শই দেখা যায়। বিশেষ করে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে, বর্তমানে ভারতবর্ষে সামাজিক বা রাজনৈতিক যে কোন কারনেই হোক দ্বন্দ্ব সংহতি রক্তপাত অরাজকতায় ভরে উঠেছে। কিছু মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিদ্বেষের বিষবাষ্পে ভরে উঠেছে।এইভাবে রাজ্য বা দেশ চলতে পারেনা। তাই বর্তমানে সম্প্রীতির কথা তুলে ধরতে হবে ভারতীয় নাগরিককে। মনে করতে হবে তারাও দেশের সন্তান, ভারতমাতা তার মা, তার নিজের দেশের প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করতে হবে। বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে জীবনে বেঁচে থাকতে হবে আর সেই সমস্যাকে অতিক্রম করাই মানুষের কাজ। তা চরম হিংসার দ্বারা নয় সঠিক বার্তা বিনিময় এর দ্বারা। আর আমরা এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের মধ্যে হিংসা ভেদাভেদ মৌলবাদ আঞ্চলিকতা গত সমস্যা থেকেই গেছে আমরা যতই শিক্ষিত হইনা কেন? এইসব উপাদান যতদিন না নিঃশেষ করা যাবে ততদিন আমাদের উন্নতি সম্ভব নয়, দেশের উন্নতি সম্ভব নয়। বিশ্বায়নের যুগে আমাদের অনেক সামাজিক সমস্যা রয়েছে সেই সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরলাম মাত্র। সবটাই আপামর মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হলে সমস্যাগুলোর সমস্যা বলেই মনে হবে না। তাই আবারো বলবো আমাদের মানসিকতার, মানবিকতার উন্নতি হলে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি হবে না। দেশ এগিয়ে যাবে।।
লেখিকা: ক্যালকাটা গার্লস কলেজের অধ্যাপিকা।
উপেক্ষিত শর্মার দুটি কবিতা
১.
সেদিন চুম্বনের আগে
কলমি গাছে ঘর বেঁধেছি
কাঁচপোকাদের মাপে,
ভেজা ফ্রক কাঁপতে কাঁপতে
চমকে ওঠে তাপে।
আকাশ জানে আমরা দুজন
হাড়হাভাতের হদ্দ,
শীতের বুকে দুধ জমতেই
শিউলি হল পদ্ম।
ঠোঁটের নীচে হৃদকম্প
লাভাস্রোতে ছাই,
ক্ষণস্থায়ী সেই চুমুটা
আজও পরিযায়ী।
২.
নিষিদ্ধ প্রেম?
ছেলেটাই সাহস।
ছেলেটাই নড়বড়ে সিঁড়ি।
ছেলেটাই রুগ্ন বাতাসের আড়কাঠি।
মেয়েটাও আয়নায় ধূপধুনো জ্বালে,
মূদ্রাদোষে বুকে বাঁধে রোম্যান্টিক হুক।
আড় চোখে দেখে নেয়
বন্ধ জানালার সঙ্গম সমাধি।
ছেলেটা আর মেয়েটা
অ্যাসফাল্ট রোদে রোদে
হাতে হাত রাখে , নখে নখ।
…………………………………………….
কলমের কালিমা
বন্দনা মালিক
ব্যবধানের ক্রমবর্ধমানে
কলমেরা আজ দুরাত্মা,
শোষকের তালু বন্দি হয়ে
লিখে যায় শোষণের মহাকাব্য।
দূর্ণীতিবাজের বুকের সুগন্ধি মেখে
মেনে নেয় নীতিহীন নৈরাজ্যের,
বুকের কালো রক্ত ঢেলে দিয়ে
ছবি আঁকে বিধ্বস্থ পৃথিবীর।
বিশ্বশান্তির অন্তরায় হয়ে
মধ্যস্ততা করে সন্ত্রাসবাদী কলম,
কালো ইতিহাসের সাক্ষী হয়
বিচারপতির অনৈতিক স্বাক্ষরে।
হে কলম! তুমি বিপ্লব করো
কবিকূল তোমায় সঙ্গ দেবে,
হিমালয়ের বরফখন্ড লুটিয়ে পড়বে
তোমার রাতুল চরণে।
………………………………………
তুমি আসবে বলে
অপর্ণা হালদার
মাগো তুমি আসবে বলে, শরৎরানী
প্রকৃতিকে রামধনু রঙে সাজিয়েছে
আকাশে ভাসিয়েছে মেঘের পেঁজা
তার মধ্যে পাখা বিলিয়েছে
লাল নীল সবুজ ঘুড়ির পত্র।
তুমি আসবে বলে, দিঘির জল
কলকলিয়ে শব্দ তুলে ছুটে চলেছে
তাই দেখে শাপলা শালুক
রোদের পরশ মেখে লাজুক হেসে
লুটিয়ে পড়ছে দিঘির কোলে।
তুমি আসবে বলে, কিশোরী শিউলি
আড়মোরা ভেঙে সুবাস ছড়িয়ে চারপাশ
মাটির সঙ্গে মিশে সেই গন্ধে
পটুয়া গড়ে তুলছে তোমার মুখের আদল
শুধু তুমি আসবে বলে মাগো।
শরৎ উৎসব
ফারহানা শারমিন জেনী
(বাংলাদেশ)
চপল মেঘের ভেলায় চড়ে
স্বপ্নগুলো আসছে দুলে
কাশের বনে নদীর কুলে
মনভূবনের দোলায় দুলে।
শিউলি ফুলে পথ বিছানো
শিশির ভেজা পায়ের পাতা
নাচছে হৃদয় অলিক সুখে
মহোৎসবের দেয় বারতা।
…………………………
দীনের দুর্গোৎসব
মধু সূদন পাল
শরতের আকাশ নীলাভ রঙের
ফুলে ফুলে ভরেছে বন।
পাখিদের গানে সুমধুর টানে
মা দুর্গার আগমন।
ঘরে ঘরে রকমারি সাজে
নতুনত্ব পোশাকের বাজার।
বাবুরা সব আনন্দে মশগুল
মিটিয়ে টাকা হাজার।
আমাদের ঘরে ছেঁড়া পোশাক
জোটেনা জামা গায়ে।
রাতটা কাটে গাছের তলায়
থাকেনা চটি পায়ে।
খিদের জ্বালায় কখনো যদি
পাতি আমাদের হাত।
জুটেছে হাজার লাঞ্ছনা তবু
দেয়নি কেউ ভাত।
আমরা শিশু অন্নহারা
কেউ দেখেনা চোখে।
অবশিষ্ট ফেলছে তবু
দেয়না খেতে লোকে।
এভাবেই শত দুঃখ নিয়ে
না খেয়েই পুজো কাটে।
বাবুরা সব ব্যস্ত দেখি
পুজোই মেতে ওঠে।
……………………………
লিখব না আর ছড়া
সুশান্ত পাড়ুই
বাগিয়ে কলম যেই ধরেছি
ছড়ার খাতা কষে
আজব কথা রবি ঠাকুর
খাতার পাশে বসে।
বললে হেসে লিখবি কি রে
গর্ধপ তুই বোকা
কোন্ কথা যে লিখব খাতায়
খাচ্ছি আমি ধোঁকা।
থিম প্যান্ডেল ড্রিম লাইটে
হাল-ফ্যাসানের পোশাক
বুড়ো খোকার হাফ প্যান্টুন
জ্বলছে মাথার টাক।
তাকিয়ে দেখি হরেন কাকার
কানে তে দুল ঝোলা
ওরে বাবা কমলি পিশির
গোটা পিঠটাই খোলা ।
কোন্ টা পুরুষ কোন্ টা নারী
চিনতে লাগে খটকা
কি লিখি ভাই এদের ছাড়া
হচ্ছে গরম মটকা।
যেদিকে চাই জোড়ায় জোড়ায়
‘দাদাগিরি’র গুগলি
টু-শব্দ করেছো কি
তবে তো তুই ভুগলি!!
সিরিয়ালেই সময় কাটে
সেল-ফোনেতেই মত্ত
আমার ছড়া পড়বে কে আর
জুঝবে বলো কত্তো ।
পুজোর ছড়া লিখতে গিয়ে
লিখব ভাবি কি যে
ঢ্যাং কুরা-কুর বাজনা বাজে
কানের কাছে ডি-জে।
ভাবনা আমার জাবনা কাটে
দাবনা নাচাই কতো
শিকের মোন্ডা শিকে তে থাক্
ছড়ার খাতা যত ।
থাক্ থাক্ থাক্ লিখব না আর
লিখব না মনগড়া
পড়ার মতো পাঠক কোথায়
লিখব না আর ছড়া।
——————————
এসো কবিতা লিখি
সেখ আব্দুল মান্নান
প্রিয়ে রাতদিন কাজ কাজ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত
সংসারের নিরন্তর ঝক্কিতে সদা তুমি ত্রস্ত
এসোনা শোবার আগে রাতে দুলাইন কবিতা লিখি
ছেলেদেরও বলি এসো দুলাইন কবিতা শিখি।
দেখ এভাবে কবিতা লিখে কবি হওয়া না গেলেও
হাততালি বাহ্ বাহ্ শুকনো প্রশংসা না পেলেও
তৈরি হয় পবিত্র মন প্রাণপণ কবিতার মক্কায়
মনটা ভালো হলে ধিরে ধিরে সমাজটা বদলায়।
তুমি এখন অনায়েসেই লেখ কবিতা ভারি মিষ্টি
তোমার ওপর পড়ছে তাই কবিকুলের শেন দৃষ্টি
ছেলেরা হচ্ছে ক্রমে ছড়া লেখায় সাবলীল
মনকে তাদের পাবে না ছুঁতে কোনো কিছু অশ্লীল।
ব্যস্ততার মাঝে প্রিয়ে এসো লিখি কবিতা নিয়মিত
লিখতে লিখতে তুমি একদিন হবে পরিণত
ছেলেমেয়ে তুমি মিলে গড়বো এক কাব্য পরিবার
জাতপাত ভেদাভেদ কোনো কিছু থাকবে না আর।
—————————————————–
আঁধারে আলো
আফ্রূজা খাতুন
তুমি আমার আগমনী গান
শিউলি ফুলের সুবাস,
তুমি আমার বেল কুঁড়ি ঘ্রাণ
মলয় অনিল বাতাস।
তুমি আমার ফাল্গুনী রঙ
বসন্তে রঙ বাহার,
তুমি আমার লাল গোলাপের
পরশ ভালোবাসার।
তুমি আমার মন খারাপে
খুশিয়ালি রোদ্দুর,
তুমি আমার বেহাগ সুরে
ভালোবাসার সুর।
তুমি আমার দুখের সাথী
নিরব বেদনে,
বিরহ ঘোরের আঁধার থেকে
কুসুমিত বনে।
তুমি আমার মন আঁধারে
সাঁঝের পিদিম আলো,
তুমিই আমার আলোর দেব
আলোতে মোছো কালো।
———————————————————
পূজার মজা
মুকুল রঞ্জন দাশ,
বর্ষা যেতেই পূজার হাওয়া
লাগলো গায়ে ভাইরে!
আনন্দে মন উঠল নেচে
তাইরে নাইরে নাইরে ।
শিউলি ফুলের গন্ধ-মাঝে
পূজার আমেজ পাইরে,
কাশের বনের শুভ্র-শোভায়
উদাস হয়ে যাইরে।
পূজা এলেই নূতন নূতন
জামা-জুতা চাইরে–
পূজা-সংখ্যার গল্প-ছড়ায়
বিভোর হয়ে যাইরে।
পূজার ছুটির দিনগুলোতে
পড়ার চাপ তো নাইরে,
পাড়ায় পাড়ায় পূজা দেখে
আনন্দে বেড়াই রে।
বন্ধু -বান্ধব সবাই মিলে
হাসি, নাচি, গাইরে,
পূজার মতো এমন মজা
আর কিছুতে নাই রে।
____________________