কলকাতা 

বিশেষ কোনো প্রতিযোগিতার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রস্তুত হইনি, গণিতের প্রতি অমোঘ আকর্ষণ আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে – জানাল ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথস অলিম্পিয়াডে পরপর তিনবারের সোনাজয়ী প্রাঞ্জল শ্রীবাস্তব

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এখন সে দেশের আইকন, বিশেষ করে যুব সমাজের। হ্যাঁ ঠিক, তা’তো হওয়ারই কথা। ত্রিস্তর কম্পিটিশন ভেদ করে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে নির্বাচিত হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ, চার-চারবার নির্বাচিত হওয়া এবং দেশের জন্য পদক আনার কৃতিত্ব তার ঝুলিতে। তার মধ্যে আবার, পরপর তিনবার সোনার মুকুট। বুঝতে কারো বাকি নেই, সে আর কেউ নয়, আমাদের গর্বের *প্রাঞ্জল শ্রীবাস্তব*। প্রাঞ্জল জানিয়েছে ছোট থেকে তার গণিতের প্রতি আকর্ষণের কথা, পরিবারের কথা, আই এম ও-তে অভিজ্ঞতার কথা আর সেখানে সোনা জয়ে হ্যাটট্রিকের পর বিশেষ অনুভূতির কথা। 

অনুলিখনে *নায়ীমুল হক*। 

Advertisement

¤ সাক্ষাৎকারের শুরুতে তোমার পরিবারের কথা সংক্ষেপে যদি কিছু বল।

➖আমরা দুই ভাই। দাদা গণিতের ছাত্র। থিওরিটিক্যাল ম্যাথমেটিক্স নিয়ে উচ্চশিক্ষা করছে। বাবা-মা দুজনেই তথ্যপ্রযুক্তি প্রফেশনাল। ছোট থেকেই তাঁরা আমাদেরকে মুক্তচিন্তা করতে শিখিয়েছেন, যুক্তিবোধ, নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিখিয়েছেন। বাবা যেখানেই যেতেন আমাদের জন্য নতুন নতুন বই উপহার দিতেন। বেশ মনে আছে তখন আমি ক্লাস থ্রিতে, বাবা আমাকে ইয়ান স্টুয়ার্ট-এর সিগনিফিকেন্ট ফিগারস, রিক্রিয়েশন ম্যাথস কিনে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই আমার গণিতে মজা পাওয়া শুরু।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলতেই হয়, বাবা-মা কখনোই আমাদেরকে পড়াশোনার জন্য কিংবা রেজাল্ট ভালো করার জন্য চাপ দেননি । বরং উল্টোটা হয়েছে, পিয়ানো বাজানোর দিকে আমার শখ দেখে, সে ব্যাপারেই আমাকে উৎসাহিত করেছেন।

¤ ম্যাথস অলিম্পিয়াড-এ অংশ নেওয়ার কথা ছোট থেকেই ভেবেছিলে?

➖ বিশেষ কোনো প্রতিযোগিতায় বসার দিকে তাকিয়ে আমি কাজ শুরু করিনি। একদম ছোটবেলা থেকে আমাদের দেশ-বিদেশের বই পড়ার হ্যাবিট জন্মিয়েছিল, ফলে কোথায় কী ধরনের পড়াশোনা বা প্রতিযোগিতা হচ্ছে, তার খবরাখবর সেখান থেকে পেতাম। আর ছোটবেলা থেকে প্রচুর পাজল গেম, তার গাণিতিক সমাধান কি করে হয় সে সম্পর্কে ভাবতাম। ধীরে ধীরে সংখ্যা, সিরিজ এদের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক আমাকে অভিভূত করে তোলে এবং আমি এগুলো নিয়ে খুব মজা পেতে থাকি, আরও পড়াশোনায় ডুবে যাই।

¤ গণিতে তোমার এত আনন্দ অথচ গণিত নিয়ে তোমার বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বেশ ভয়-ভীতির এক আবহ লক্ষ্য করা যায়।

➖আসলে, কোনো কিছুই না বুঝে মুখস্থ করা উচিত নয়। যে কোনো ঘটনার অবশ্যই একটা যুক্তি আছে। সেই যুক্তি বুঝতেই হবে। আর বুঝতে পারলেই তখন তা আনন্দময় হয়ে উঠবে। তখন আর ভয়-ভীতি থাকার কোনো প্রশ্নই থাকেনা। আমি ছোট থেকে আজ পর্যন্ত কখনও স্রেফ পড়ার জন্য পড়িনি। গণিতের মজা আমাকে ভীষণভাবে টানে, এগুলো নিয়ে আমি মজার খেলা খেলি। বিভিন্ন ধরনের ফান-অ্যাক্টিভিটি আছে, যেগুলো স্কুল পর্যায়ের ছেলে-মেয়েদের হাতে-ধরে একবার করিয়ে দিতে পারলেই মজা পেয়ে যাবে। আমার জন্য গণিত একেবারেই রিলাক্সেশন এবং রিক্রিয়েশন।

আর একটা কথা উল্লেখ করতেই হয়, একেবারে ছোটবেলা থেকে শিক্ষক-ভাগ্য আমার অতি সুপ্রসন্ন। একেবারে ঠিক পদ্ধতিতে আমাকে গড়ে তোলার সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁদেরই। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গণিতের উপর গবেষণা করছেন এরকম শিক্ষকদের সাহায্য আমি পাচ্ছি। এছাড়াও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির কয়েকজন আমাকে খুবই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিভিন্নভাবে সমস্যার সমাধান করা, আলোচনার মাধ্যমে তার গভীরে ডুবে যাওয়ার স্বাদ-ই আলাদা।

¤ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথস অলিম্পিয়াড – গণিতের এই প্রতিযোগিতা কেমন ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য? যদি এর প্রক্রিয়া সংক্ষেপে কিছু বল।

➖ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য ক্লাসে উঠার পরীক্ষা বা তার রেজাল্ট নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো ক্রাইটেরিয়া নেই। গণিতে যাদের প্রবল উৎসাহ এবং ভবিষ্যতে গণিত নিয়ে পড়াশোনা যাদের প্রকৃত বাসনা, সেই সমস্ত অষ্টম-নবম-দশম-একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। কয়েকটি স্টেজে হয় এর নির্বাচন – প্রি রিজিওনাল ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড, রিজিওনাল ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ম্যাথমেটিক্যাল অলিম্পিয়াড, আই এম ও ট্রেনিং ক্যাম্প, প্রি-ডিপার্চার ক্যাম্প আর অবশেষে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথস অলিম্পিয়াড।

ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথস অলিম্পিয়াডের চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা হয় দুদিনের, প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টা করে পরীক্ষার সময়। মোট ছটা প্রশ্নের সমাধান করতে হয়। প্রতিটি সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ মান সাত।

¤ এবার আইএমও প্রতিযোগিতার আসর বসেছিল নরওয়েতে। তোমাদের ছ’জনের টিমে কে কে ছিল?

➖ হ্যাঁ, ঠিক তাই।

নরওয়ের অসলোতে আয়োজিত হয়েছিল এ বছরের আইএমও। ১০৪ টি দেশের ৫৮৯ ছাত্র-ছাত্রী অংশ নিয়েছিল। এই প্রতিযোগিতায় ভারত থেকে অংশ নিয়েছিল অর্জুন গুপ্ত, আদিত্য মাংগুডি ভেঙ্কট গণেশ, কৌস্তব মিশ্র, অতুল সতভারত নাদিগ, ভেদান্ত সাইনি আর আমি। আমাদের দলে গাইড হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক নিরঞ্জন এবং অধ্যাপক শান্তা লাইশ্রাম আর দুই আইএমও প্রাক্তনী সুতানয় ভট্টাচার্য এবং স্পন্দন ঘোষ ছিলেন অবজারভার।

¤ আসা যাক এবার প্রশ্নপত্র কেমন ছিল, সে প্রসঙ্গে 

➖ এ বছরের প্রশ্নপত্র ছিল অত্যন্ত কঠিন, বিশেষ করে প্রথম দিনের শেষের অংশ। অবশ্য প্রতিযোগিতায় প্রথম দিকটা অসুবিধা হলেও দ্বিতীয় দিনটা ছিল আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক। বীজগণিত, কম্বিনেটরিস, নাম্বার থিওরি, জ্যামিতি নিয়ে প্রতিটি প্রশ্ন শক্ত হলেও আমি ধীরে ধীরে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারছিলাম।

¤ এবার আমরা তো ছ’টা পদক লাভ করেছি।

➖ হ্যাঁ, ঠিক তাই।একটি সোনা সহ পাঁচটি ব্রোঞ্জ পদক এবার আমাদের দখলে এসেছে।

¤ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাথ অলিম্পিয়াডের মতো আসরে দেশের হয়ে গোল্ড মেডেল জেতায় হ্যাটট্রিক করে তোমার কেমন লাগছে? 

➖দেখুন, দেশের হয়ে কোথাও প্রতিনিধিত্ব করার স্বাদ-ই আলাদা, তার ওপর এরকম একটা দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করতে পারলে কার না ভালো লাগে!

¤ গণিতের প্রতি ছোটবেলা থেকে যাদের ভালোবাসা এমন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি তোমার কী বার্তা? 

➖গণিতের এই আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে হলে প্রথমে যেটা দরকার, তা হল গণিতের প্রতি অকৃত্রিম এবং গভীর ভালোবাসা। এর সঙ্গে থাকতে হবে গণিতের জন্য কাজ করার সুদৃঢ় বাসনা আর গবেষণা করার পাকাপাকি সিদ্ধান্ত। সেখান থেকেই তৈরি হবে নিষ্ঠা, নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা আর অপরাজেয় মনোভাব।

¤ অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন তোমাকে।

➖ আপনাদেরকেও অনেক অভিনন্দন। আপনাদের সকলের ভালোবাসা ও আশীর্বাদে আমাদের গোটা টিম কৃতজ্ঞ ও অভিভূত।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ