বিশেষ ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (SIR ), নাকি নাগরিকত্ব হরণ?/ সুকুমার মিত্র
বিশেষ ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (SIR ), নাকি নাগরিকত্ব হরণ?
সুকুমার মিত্র : সার চর্চা ;
গত ২৪ জুন ২০২৫ তারিখে নির্বাচন কমিশন বিহার থেকে শুরু করে সমগ্র দেশে SIR বা ‘সার’ (Special Revision of Electoral Rolls) প্রক্রিয়া চালু করে। এটি ভোটার তালিকার ২১তম বিশেষ পরিমার্জন, কিন্তু শেষ সংশোধনের পর এটিই সবচেয়ে দীর্ঘ ব্যবধানে (২০ বছর পর) হতে চলেছে। এই প্রক্রিয়াকে ঘিরে দেশে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে, যা ভোটার তালিকা সংশোধনের গণ্ডি পেরিয়ে নাগরিকত্বের প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
পাঁচটি মুখ্য পক্ষ ও তাদের অবস্থান:
১. কেন্দ্রীয় সরকার: সরকারের দাবি, এটি নির্বাচন কমিশনের একটি রুটিন কাজ। সংবিধান স্বীকৃত এই স্বশাসিত সংস্থার কাজে সরকারের কোন হস্তক্ষেপ নেই।

২. বিরোধী দলগুলি: তাদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশন আরএসএস-বিজেপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বিরোধী দলগুলির সমর্থক ভোটারদের ইচ্ছাকৃতভাবে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার মাধ্যমে নির্দিষ্ট রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতাদখলের পথ প্রশস্ত করার চেষ্টা চলছে।
৩. ভারতের নির্বাচন কমিশন (ECI): ECI দাবি করে, তারা সংবিধান ও আইন দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতাই প্রয়োগ করছে। ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তি বা বাদপ্রদানের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব যাচাই করা তাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে। সুপ্রিম কোর্টে এই অবস্থান পেশ করেছে।
৪. সুপ্রিম কোর্ট: সমালোচকদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট একটি ‘ফ্লিপ-ফ্লপ’ সংস্থায় পরিণত হয়েছে, যা প্রায়শই পরস্পরবিরোধী রায় দেয়। আধারকে ভোটার নথি হিসেবে সীমিত স্বীকৃতি দিলেও, এটি যে জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি, সেকথা মাথায় রেখে সরকার বা ভারতের নির্বাচন কমিশন ( ECI)-র উপর নজরদারির ভূমিকা নেয়নি।
৫. স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন SIR বিরোধী আন্দোলনকারী শক্তি: এই পক্ষটি SIR প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার সরাসরি ষড়যন্ত্র দেখছে। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ভোটব্যাংক নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু এই পক্ষটি নাগরিকত্ব রক্ষায় আন্তরিক।
ভারতের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার অস্ত্রভাণ্ডার:
ভারতের নির্বাচন কমিশন বা ECI-র হাতে সংবিধান ও আইন দ্বারা প্রদত্ত অত্যন্ত শক্তিশালী কিছু ক্ষমতা রয়েছে, যা ‘সার’ প্রক্রিয়াকে চালিত করছে:
· সংবিধানের ধারা ৩২৪-৩২৯: এই ধারাগুলি ভারতের নির্বাচন কমিশন বা ECI-কে জাতীয় ও রাজ্য নির্বাচনের ‘অধীক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার’ (Superintendence, control and direction) পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করেছে। ধারা ৩২৯ আদালতের হস্তক্ষেপও সীমিত করা হয়েছে।
· জনপ্রতিনিধিত্ব আইন, ১৯৫০-এর ধারা ২১(৩): এই ধারা ভারতের নির্বাচন কমিশন বা ECI-কে যেকোনো নির্বাচনী ক্ষেত্রের ভোটার তালিকার ‘বিশেষ পরিমার্জন’ (Special Revision) করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
· নির্বাচক নিবন্ধন বিধি, ১৯৬০-এর ধারা ২৫: ECI ভোটার তালিকা ‘নিবিড়ভাবে’ (Intensively) বা ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ (Summarily) সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
· বিহারের নির্দেশিকা ধারা ৫(খ): নির্বাচন আধিকারিক (ERO) কোনো ভোটারকে বিদেশি বলে সন্দেহ করলে, তার বিষয়টি নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-এর অধীনে প্রেরণ করতে পারেন।
· নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২৩: এই নতুন আইনে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ কমিটিতে সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তৈরি করা হয়েছে, যা ভারতের নির্বাচন কমিশনের বা ECI-র স্বাধীনতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলছে ।
ভোটার হওয়ার মাপকাঠি: একটি বাস্তবতা পরীক্ষা
SIR-এর জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশন বা ECI যে নথিগুলি চেয়েছে, সেগুলি ভারতের সাধারণ ও দরিদ্র জনগণের জন্য অত্যন্ত দুরূহ:
· পেনশন অর্ডার (PPO): ভারতে মাত্র ১২% কর্মরত মানুষ পেনশনের আওতায় আছেন।
· জন্ম সার্টিফিকেট (Birth Certificate): ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১৫.১% জন্ম অন্ধ্রপ্রদেশ নিবন্ধিত নেই। বিহারে ২০০১-০৫ সালে জন্মানোদের মাত্র ২.৮% এর জন্ম আছে।
· পাসপোর্ট: দেশের মাত্র ৭.২% মানুষের পাসপোর্ট রয়েছে।
· শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র: কর্মরত জনসংখ্যার ৩০% মাধ্যমিক স্কুলে যায়নি, তাই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট নেই।
· SC/ST/OBC সার্টিফিকেট: ২০১১-১২ সালের তথ্য অনুসারে, ৫০% SC/ST এবং ৬২% OBC-র Caste Certificate বা জাতগত শংসাপত্র নেই।
· আধার: ডিসেম্বর ২০১৯-এ আধার কভারেজ ৮৯.৬% হলেও উত্তর-পূর্ব রাজ্য যেমন অসম, মেঘালয় ও নাগাল্যান্ড-এ এটি যথাক্রমে মাত্র ১৭.৬%, ২৯.৩% ও ৫৭%।
· নাগরিকত্বপঞ্জিকরন সার্টিফিকেট বা NRC Certificate: অসম-এর বাইরে কারও NRC সার্টিফিকেট নেই।
উপসংহার:
Special Intensive Revision বা
SIR প্রক্রিয়াটি Booth Level Officer (BLO)-নির্ভর। Enumeration Form বা ভোটার তালিকায় নাম তোলার ফর্ম শুধুমাত্র BLO-দের কাছেই থাকে। বিহারের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১.১৫% মানুষের ইন্টারনেট- সুবিধাযুক্ত কম্পিউটার ব্যবহার করার ক্ষমতা আছে, ফলে মানুষ BLO-দের ইচ্ছা ও দয়ার উপর নির্ভরশীল।
মোদ্দা কথা, SIR কেবল ভোটার তালিকা পরিষ্কার করার প্রক্রিয়া নয়। যে নথিগুলি চাওয়া হচ্ছে, তা দেশের একটি বৃহৎ অংশের (বিশেষ করে দরিদ্র, প্রান্তিক, অশিক্ষিত, নিরক্ষর জনজাতি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের) মানুষের পক্ষে জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব। ফলে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক বৈধ ভারতীয় নাগরিক ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার এবং বস্তুত ‘নাগরিকত্বহীন’ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এটি সংবিধান প্রদত্ত সর্বজনীন ভোটাধিকারের মৌলিক নীতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি গভীর সংকটের ইঙ্গিতবাহী বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে।