কলকাতা বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

আগমনী ও শারদ উৎসব: আমার স্মৃতির হাত ধরে / প্রফেসর ড: মনীষা চক্রবর্তী

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

প্রফেসর (ড:) মনীষা চক্রবর্তী  ঃশরৎ ডাকছে ঘরের ও মনের দুয়ারে, নিয়ে এসেছে খোলা নীল আকাশ, ঝাঁকে ঝাঁকে

সাদা মেঘ ও এক রাশ স্মৃতির জোয়ার | ছোটবেলার সেইদিনগুলো মনকে টেনে ধরে

Advertisement

লেখিকা: প্রফেসর মনীষা চক্রবর্তী

রাখে, কি আপন করে, ছাড়তে, একেবারেই চায়না |
ছোটবেলায় পুজো আসার বেশ কিছদিন আগে, মা নিজের হাতে ভারী সুন্দর, বিভিন্ন
ডিজাইনের অনেক জামা বানাতেন, আমার জন্যে | পড়ার টেবিলে আমাকে কিছু কাজ
দিয়ে, মা সেলাইয়ের মেশিনটা নিয়ে বসতেন | মেশিন ঘোরার সেই শব্দ মানেই,
আমার আরেকটা সুন্দর জামা | মনটা পড়ে থাকতো, কখন মা ডাকবেন আমাকে,
কখনো, কোনো মাপের জন্যে, তো কখনো, পরিয়ে দেখার জন্যে | জামাটি হয়ে গেলে,
মা অতি যত্নে আমাকে পরাতেন ও প্রাণ ভোরে দেখতেন আমাকে, বেশ অনেক্ষন |
আমি আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরতাম ও তার পর বাবা ও দিদির কাছে ছুটে যেতাম |
বাবা ও দিদি দেখেই বলতেন, খুব সুন্দর লাগছে ও সেইটা কবে পরবো পুজোতে আমি
? এই প্রশ্ন, আমাকে ভারী চিন্তায় ফেলতো | প্রতিটি ভারী সুন্দর জামা, মা বানাতেন |
সত্যি তাহলে আমি কোনটা অষ্টমীর সকালে ও কোনটা অষ্টমীর রাত্রে পরবো ?

মায়ের কাছে এই প্রশ্ন থাকতো আমার প্রায়ই | মা তার সংসারের এতো ব্যস্ততার মধ্যে,
আমাকে বারে বারেই অতি স্নেহে ও আদর করতে করতে বলতেন, কোনটা কবে
পরবো | দিদির জন্যেও মা জামা বানাতেন | এর পরেও, বাবা মা পুজোর কেনাকাটি
করতে নিয়ে যেতেন, আমাকে ও দিদিকে গড়িয়াহাটে |
মায়ের কথা ভাবলে, শুধু মনে হয়ে, এতো শান্ত, এতো ধৈর্যশীলা, এতো গুণী, এতো

সুন্দরী ও এতো আপন মানুষটিকে সময় আমাদের সকলের থেকে নিয়ে নিলো, এতো
দূরে, যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না, তাকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় না,
শুধু মনে-মনে প্রতিমুহূর্ত তাকে অনুভব করা যায় |
বাবা আই ও এফ এস গেজেটেড অফিসার ছিলেন | সেই সূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায়
তাকে কর্ম সূত্রে থাকতে হয়েছে | সব জায়গায় তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাস ছিল |
ক্যাম্পাসে দূর্গা পুজো হতো | পুজো শুরু হওয়ার মাস খানেক আগে থেকে, নৃত্য
নাট্যের প্রস্তুতি শুরু হতো | প্রতি বছরই কেউ না কেউ, এইটির দায়িত্বে থাকতেন |
আমি ছোট বেলা থেকেই, কত্থক নৃত্য শিখতাম | যেই বছর, যেই কাকিমা, দায়িত্বে
থাকতেন, আমার মাকে খবর দিতেন, যাতে মা আমাকে, তার বাড়ি পাঠান
বিকেলে |
স্কুল থেকে এসে, প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে আমার অনেক্ষন সময় কাটতো, সারা দিন স্কুলে
আমি কি কি করেছি, এইসব বলতাম | মা প্রতিদিনই আমার সব কথা মন দিয়ে
শুনতেন ও বলতেন এইবার খেয়ে নাও কিন্তু আমার কথা আর শেষ হতেই চাইতো না

| যেইদিন নৃত্যনাট্যের নাচের জন্যে আমার ডাক এসেছে শুনতাম, আমি তো আনন্দে,
হাসি মুখে, মাকে জড়িয়ে ধরতাম | মনে পড়ে, মদন ভষ্মে পার্বতীর ভূমিকায়,
চণ্ডালিকাতে চণ্ডালিকার ভূমিকায়, কালিও দমনে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় ও আরও

অনেক নৃত্য নাট্য ও একক নৃত্যে, আমার নাচের স্মৃতির ঢেউ | ফাইনাল রিহার্সাল
অব্দি রোজ বিকেল অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির পর্যায় চলতো, আর আমি আমার বন্ধু ও
পরিচিতদের সঙ্গে আমার নাচের অংশের প্রাকটিস করতে যেতাম গান, তবলা ও
মিউজিকের সঙ্গে, যেই বছর যেইকাকিমা দায়িত্ব থাকতেন, তার বাড়ি | আনন্দের
মুহূর্ত, আজও মনে ততটাই টাটকা রয়ে গেছে | ফাইনাল রিহের্সাল স্টেজে হতো |
ছোটদের অনুষ্ঠান পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতে হয়ে যেত |
ফাইনাল প্রোগ্রামের দিন, দুপুরকে ঠেলে বিকেল আসতেই, যেতাম সাজগোজ করতে
গ্রিনরুমে | মেকআপ আর্টিস্ট ও ড্রেসাররা আসতেন | মা সন্ধে হওয়ার বেশ কিছুক্ষন

আগেই, চলে আসতেন, আমাকে সাজগোজ করা অবস্থায় গ্রিনরুমে দেখতে, প্রতিবারই
মা আমাকে আদর করে জড়িয়ে ধরতেন ও আমার হাতের ছোট আঙ্গুলটা হালকা করে
কামড়ে দিতেন ও মায়ের চোখ ভেজা থাকতো আনন্দে | আজ মায়ের সেই আনন্দে
ভেজা চোখ, আমার মন খোঁজে দূর্গা প্রতিমার পাশে, আমি তাকে চোখ বন্ধ করে
দেখতে পাই ও ভাবি ঈশ্বরকে প্রতি মুহূর্ত স্পর্শ করা যায় মা ও বাবার মধ্যে দিয়ে |
প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই, মা বাবা ও দিদি মণ্ডপে স্টেজের সামনে বসতেন | ভর্তি
অডিয়েন্স | ক্যাম্পাসের প্রত্যেকেই প্রায় থাকতেন | মিউজিক, তবলা, গান, লাইট,সামনে বসে আছে ভর্তি অডিয়েন্স ও দূরে আলোয় প্রজ্জলিত দূর্গা প্রতিমা তার পরিবার

সহ, এই অপূর্ব সুন্দর মুহূর্তে, মনে পড়ে যখন স্টেজে আমি প্রথম ঢুকতাম, আমার
নৃত্য পরিবেশনের জন্যে, মনে হতো গোটা স্টেজটাই আমার অপেক্ষায় রয়েছে, অধীর
আগ্রহে, যে চাইছে আমার সব কথা বুঝতে, নৃত্যের মাধ্যমে | ভীষণ আনন্দের
অনুভূতি আজও মনকে ততটাই স্পর্শ করে, যতটা সেই মুহূর্তে আনন্দ পেতাম | বাবা
প্রাণ ভোরে ছবি তুলতেন আমার | বাবা খুব সুন্দর ছবি তোলেন | অতি তৎপরতায়,
পুজোর পর, বাবা দোকান খুলতেই, ছবি গুলো রেডি করিয়ে আনতেন, আর আমি
অপেক্ষায় থাকতাম, কবে বাবার তোলা প্রতিটি ছবি আমি দেখবো | আমি, মা ও দিদি
আমরা, ছবি গুলো দেখতাম, আর বাবা আমাদের উৎসাহ ও আনন্দে ভরা
বিস্ফোরিত চোখ-মুখ, হাসি মুখে অনুভব করতেন | অনুষ্ঠানের শেষে অডিয়েন্সের
করতালি মনে খুব আনন্দ দিতো, আবার পাশাপাশি, মনে একটু হলেও কষ্ট হতো, যে
আবার এক বছরের অপেক্ষা, সেই বছরের মতো, দুর্গাপুজোয় নৃত্য পরিবেশনের এই
আনন্দের অনুভূতির সমাপ্তি ঘটেছে |


সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর সকাল মানেই, স্নান করে, নতুন জামা পরে, প্যান্ডেলে যাওয়া,
বন্ধুদের সঙ্গে অঙ্গলি দেয়া, প্যান্ডেল বসে, ঢাকের তাল ও মন্ত্র উচ্চারণ শুনতে
শুনতে প্রসাদ খাওয়া | দুপুরে এই তিনদিনই পংক্তি ভোজ থাকতো | বন্ধুরা মিলে,
একসাথে বসে খেতাম, খিচুড়ি, লাবড়া, বেগুনি, চাটনি, পাঁপড়, পায়েস ও মিষ্টি |
মনে পড়ে, পরিবেশন করার সময়, বাবার বন্ধুরা, আমাকে বেশি করে খিচুড়ি,
লাবড়া, চাটনি ও পায়েস দিতেন, আর বলতেন, "তোর নাচের অনুষ্ঠান দারুন

হয়েছে" | মা বাবা ও দিদি, সবাই সবার মতন, তাদের বন্ধু ও পরিচিতদের সঙ্গে,
প্যান্ডেলে আনন্দে পেতেন | সন্ধে বেলায়, এই তিনদিনই অনুষ্ঠান থাকতো | আমরা
বন্ধুরা এক সাথে বসে দেখতাম |
পুজোর কটা দিন, ঝড়ের বেগে কেটে যায় | শারদ উৎসব আসছে, এইটাই মনকে
টেনে রাখে, আনন্দের সুরে | মা আসছেন, আনন্দ দিতে ও ভালোবাসতে | আমরা
সবাই মন খুলে আনন্দের জোয়ারে ডানা মেলে ধরেছি, যে যার মতন করে | তবে
আনন্দের সূত্র একটাই, মা এসেছেন, তাই আমরা আনন্দে মেতে আছি, ধুপ ধুনোর
গন্ধে, ঢাকের তালে, কাসর ঘন্টায়, ধুনচি নাচে, প্রদীপশিখাই ও মন্ত্রধ্বনিতে | শুভ শারদীয়।

লেখিকা : প্রফেসর,  স্কুল অফ বায়োসায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
যাদবপুর ইউনিভার্সিটি


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ