দেশ বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

স্মৃতিচারণ : না ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলার জনরবের গুয়াহাটিবাসী সংগীত শিল্পী ঋষিরাজ শর্মা 

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ আব্দুল মান্নান : দুপুর ১২ টা ৪১ মিনিটে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজটা দেখেই চমকে উঠলাম। আজ সকালে চলে গেছেন গুয়াহাটির বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংগীত শিল্পী ঋষির শর্মা। গুয়াহাটি থেকে মর্মান্তিক ম্যসেজটা পাঠিয়েছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক বাচিক শিল্পী অজিত কুমার সেন। ম্যাসেজটা পেয়ে মাস পাঁচেক আগে ঋষিরাজ শর্মার সাথে হওয়া আমার কথপোকথনের স্মৃতি রোমন্থন করছি। এমন সময় ফোন এলো গুয়াহাটির নিউজ পোর্টাল ‘নয়া ঠাহর’ এর সম্পাদক অমল গুপ্তর । অমল দা আড়ষ্ট গলায় বললেন ঋষিরাজ চলে গেলেন। আফশোস রয়ে গেল তার সাথে শেষ দেখাটা হলোনা।

অমল দা বললেন তাঁর স্ত্রীকে যখন কলকাতা মুকুন্দপুর আর এন টেগোরে কিডনির ট্রিটমেন্টের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন তখন ঋষিরাজ অনেক সাহায্য করেছিলেন।

Advertisement

উল্লেখ্য চাকরিসূত্রে গুয়াহাটি থাকাকালীন ঋষিরাজকে আমি চিনতাম প্রখ্যাত অসমিয়া সংগীত শিল্পী দিলীপ শর্মার পুত্র হিসেবে। চিনতাম প্রোথিতযশা সংগীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার ভাগ্নে হিসেবে। পিতা দিলীপ শর্মার সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠানে তাঁকে গান গাইতেও দেখেছিলাম। কিন্তু তাঁর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ গুয়াহাটিতে হয়নি। কাকতালীয় ভাবে তাঁর সাথে ব্যক্তিগত আলাপ পরিচয় হয়েছিল কলকাতায়। ঋষিরাজ দীর্ঘদিন কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। উন্নতমানের চিকিৎসার জন্য ঋষিরাজ গুয়াহাটি থেকে এসে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার আর এন টেগোর হাসপাতালে ( রবীন্দ্রনাথ হাসপাতালে) । গুয়াহাটি থেকে কলকাতায় এসেই আমায় ফোনে করেছিলেন হাসপাতালের আশেপাশে তূলনামূলক কম খরচের একটা ঘর ভাড়ার সন্ধ্যান দিতে। যদিও তখন আমার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হয়েছিলেন সাহিত্য পত্রিকা ‘সংলাপ’ এর সম্পাদক তথা কবি তুষার কান্তি সাহা। তুষারই আমার ফোন নম্বর ঋষিরাজকে দিলে ঋষিরাজ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। প্রায় দু বছর কিডনির চিকিৎসায় মুকুন্দপুরে ছিলেন সপরিবারে। সে সময় করোনার প্রাদুর্ভাব ছিল খুব বেশি। তাই তাঁর হোটেলে গিয়ে দেখা করিনি। তবে দু একদিন অন্তর অন্তর আমরা একে অপরে ফোনালাপ করতাম। কখনো কখনো ভিডিও কনফারেন্সেও আলাপ করতাম। যখনই কথা হতো তখনই রোগের কষ্টকে চেপে হাসতে হাসতে কথা বলত। এরমধ্যে তাঁর কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন হয় এবং অসমের একজন ডোনারের ব্যবস্থা হয়‌ । যথা সময়ে তাঁর কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়।

এর কিছুদিন পর একদিন হঠাৎ ঋষিরাজ দুটো বাংলা ফোক সংগীতের অভিও পাঠিয়ে বলেন দাদা গান দুটো শুনে একটু বলবেন তো কোথায় কোথায় উচ্চারণের ভুল আছে। গানের অডিওটা পেয়ে আমি অবাক হলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম চিকিৎসা করাতে এসে ভাড়া ঘরে কোথায় কিভাবে হারমোনিয়ামের ব্যবস্থা করলেন? সব কথা জানালেন আমায়। দিনে দিনে আমাদের সম্পর্ক সাবলীল হলো। তাই সাহস করে একদিন একটা ছোট কবিতা পাঠিয়ে দিয়ে তাঁকে বললাম দেখুন তো এই লেখাটায় সুর দিয়ে গান করা যায় কিনা। এক কথাতেই রাজী হয়ে গেলেন ঋষিরাজ। এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আমার লেখায় সুর দিয়ে গান করে অভিও পাঠিয়ে বললেন দেখুন কেমন হয়েছে আর কোথায় কোথায় উচ্চারণের ত্রুটি আছে। আমি নিজে সুর,তাল,লয়ের কিছুই বুঝি না। তবে বাংলা উচ্চারণের ভুলটা বুঝতে পারি। দু তিনটে উচ্চারণের ভুল ফোন করে বুঝিয়ে দিতে শুধু হারমোনিয়ামে খালি গলায়, কিছুটা ভূপেন হাজারিকার সুরে আমার লেখার গানের অডিও পাঠালেন।

এভাবে মেতে যেতে একদিন ঋষিরাজ বললেন আপনি আর আমায় ‘আপনি’ সম্বোধন করবেন না। ছোট ভাইয়ের মতো তুমি সম্বোধন করবেন। ব্যস তারপর থেকেই আমরা একে অপরকে তুমি সম্বোধন করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে করোনার প্রকোপ কমে গেছে অনেকটা। একদিন সন্ধ্যেয় তার হোটেলে চলে গেলাম। দেখলাম হোটেলের রুমটাকে নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। সেভাবেই সাজানো গোছানো ঘর। ওই সময় ওর স্ত্রী কোনো কাজে বাইরে যাওয়ায় ঋষি নিজের হাতে চা বানিয়ে খেতে দিলে আমায়। চা খেতে খেতেই হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে আমার লেখা গানটা গাইতে লাগল আগের তূলনায় আরো সুন্দর করে। গানটা ( চারিদিকে রং বেরঙের মানুষ দেখি কত/ তাদের কি আর চিতে পারি আমার মনের মতো….) গাইতে গাইতে বললে ‘দাদা, আমি গুয়াহাটি ফিরে গিয়ে তোমার গানটা স্টুডিওয় রেকর্ডিং করে পাঠিয়ে দেব, তার আগে কিন্তু গানটা কোন প্রচার মাধ্যম দেবে না।’ সেদিন ঋষিরাজের আন্তরিক কথাগুলো শুনে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার মতো একজন অর্বাচীনের লেখা গান হয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে গেলে দারুণ লাগবে।

কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের পরে ঋষিরাজ অনেকটাই সুস্থ হলে সিদ্ধান্ত নেয় গুয়াহাটি ফিরে যাবে। সেইমত ফিরে যায় গুয়াহাটি। গুয়াহাটিতে ফিরে যাওয়ার মাস দেড়েক পরে একদিন হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ লিখে জানালে যে তার মা সুদক্ষিণা শর্মা খুব অসুস্থ, হাসাপাতালে ভর্তি আছেন। তুমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাও রাতে আমার মা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিংবদন্তি সুদক্ষিণা শর্মার বয়েস হয়েছে যথেষ্ট, এই বয়সে কার কী হয় বলা মুশকিল। এরপর বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও আমাদের মধ্যে ফোনালাপ বন্ধ। আমি তিন চারদিন ফোন করলাম, কিন্তু ঋষিরাজ ফোন ধরলো না। ভাবলাম হয়ত মাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত রয়েছে! পরে নিশ্চয় ফোন করবে। আমিও ওকে বিরক্ত করিনি‌।

আজ দুঃসংবাদ পেলাম, ঋষিরাজ না ফেরার দেশে চলে গেছে। অবাক করা কান্ড, মাকে রেখে নিজেই চলে গেল! ঋষিরাজ এভাবে চলে যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। যাইহোক জন্মমৃত্যু তো ওপর ওয়ালার হাতে।মানুষের করার কিছু নেই। কেবল আমরা তাঁর কাছে প্রার্থনা জানাতে পারি কারোর মঙ্গলের জন্যে।এক্ষেত্রে ভালো করছেন নাকি খারাপ করেছেন তা নিয়ে ঈশ্বরকে দোষারোপ করতে পারি না। তবে তাঁর কাছে করজোড়ে মিনতি জানাতে পারি আপনি ঋষিরাজের বিদেহী আত্মার শান্তি প্রদান করুন।

বিশিষ্ট আইনজীবী তথা সঙ্গীত শিল্পী ঋষিরাজ আমাকে চিরঋণী করে চলে গেলেও আমার স্মৃতি সত্ত্বায় বেঁচে থাকবে আমৃত্যু।

 

 

 

 


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ