জেলা 

কৃষ্ণনগরের সরস্বতী পুজো পরিক্রমা

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

দীপাঞ্জন দে: কৃষ্ণনগরের সরস্বতী পুজোর আড়ম্বর বছরের পর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে কৃষ্ণনগরের সরস্বতী পুজো আড়ম্বরের দিক থেকে পূর্ববর্তী সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেল। করোনা অতিমারির কারণে ২০২০ সালের শুরুতে আড়ম্বরের সাথে শেষ সরস্বতী পুজো হয়েছিল। তার পর মাঝের দু’বছর অর্থাৎ ২০২১ এবং ২০২২ সালে সরস্বতী পুজোর আয়োজনে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। এবছর সবকিছুকে ছাপিয়ে সবাই মেতে উঠেছে পুজো নিয়ে। যদিও কৃষ্ণনগরের সরস্বতী পুজোর আয়োজনে বা বিষয় ভাবনায় এই উত্তরণ আকস্মিক নয়।

     ২০২৩ সালে কৃষ্ণনগরের সরস্বতী প্রতিমাগুলির অধিকাংশই দেবী মূর্তি এবং দেবী ডাকের সাজে সজ্জিত। আর্টের ঠাকুর তুলনায় কম দেখতে পাওয়া গেল।

Advertisement

 

জগদ্ধাত্রী মূর্তির আদলে একাধিক সরস্বতী প্রতিমা গড়া হয়েছে এবং প্রতিমার বিশালতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর একসময় কৃষ্ণনগরের সরস্বতী পুজোয় প্রতিমার বিশালতার চাইতে তার গড়ন অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একদা কৃষ্ণনগরে ওরিয়েন্টাল প্রতিমা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। ২০২৩ সালের সরস্বতী পুজো আলো, মণ্ডপ সজ্জাতেও পূর্ববর্তী সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। কৃষ্ণনগরে বড় বাজেটের একাধিক পুজোর হদিস মিলেছে। অলিতে গলিতে পুজো হচ্ছে। আড়ম্বর বহুগুণ বেড়েছে। প্রাণ আছে কিনা জানিনা, তবে উন্মাদনা রয়েছে প্রচুর। সামাজিক গণমাধ্যমে তো ঘোষণাই করা হয়েছে— কৃষ্ণনগরের তৃতীয় বৃহৎ উৎসব হল সরস্বতী পুজো। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে ২০২৩ সালে কৃষ্ণনগরে চারশোরও বেশি পুজো হয়েছে।

ফি বছর কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে অন্য রকমের উন্মাদনা থাকে। ২০২৩ সালে তাদের সরস্বতী পুজোর বিষয়ভাবনায় ‘মুক্তি’-র দেখা মিলল। সরস্বতীর মণ্ডপসজ্জায় কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেখিয়েছে যে, কিভাবে প্রকৃত সাধনা চেতনায় মুক্তি আনতে পারে। আর সেই মুক্তির বার্তাই তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরাও বিগত কয়েক বছর ধরে সরস্বতী পুজোর বিষয় ভাবনায় চমক দিচ্ছে। এবারেও স্কুলের শিক্ষার্থীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে তাদের পুজোমণ্ডপ তৈরি করেছে। বইয়ের স্তূপের নীচে সরস্বতী প্রতিমাকে স্থাপন করা হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, সাধারণ মানুষও দলে দলে যাচ্ছেন কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের সরস্বতী পুজোর থিম দেখতে। সামাজিক গণমাধ্যম কিভাবে শিক্ষার্থীদের মেধা শুষে নিচ্ছে, সেটাই তাদের মণ্ডপসজ্জায় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। মণ্ডপের সামনে একটি খাঁচায় একজন শিক্ষার্থীকে বন্দী দেখানো হয়েছে। সে আসলে মোবাইলের প্রতি আসক্ত। তাদের সরস্বতী পুজোর থিমে বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের মোবাইলের প্রতি আসক্তি থেকে মুক্ত করতে পারে একমাত্র বই। এ বছর কৃষ্ণনগর এ ভি হাইস্কুলের সরস্বতী পুজোর বিষয়ও বই। তাদের মণ্ডপসজ্জায় মানুষের গুহা জীবন থেকে আজকের ই-বুকের যুগেও বইয়ের প্রাসঙ্গিকতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

রাধানগর বয়েজ ক্লাবের (মা বাগেশ্বরী) এবছরের বিশেষ আকর্ষণ ৭৫-এর স্বাধীনতার ফসল। প্রতিমার সাজ করা হয়েছে বিভিন্ন ডাল, পোস্ত, বিভিন্ন বীজ ইত্যাদি দিয়ে। চকের পাড়ার ক্লাব রোটারীর এবারের বিশেষ আকর্ষণ প্রতিমার উচ্চতা ও প্রতিমা সজ্জা। আমিনবাজারের ক্লাব অগ্নির এবারের বিশেষ আকর্ষণ সহজ পাঠ। বেজিখালির ক্লাব স্বস্তিকের এবার ৪০তম বর্ষ। স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে তাদের বিশেষ আকর্ষণ ইন্ডিয়া গেট। চাষাপাড়ার ক্লাব উদয়ন বুড়িমার মণ্ডপের পাশেই (রাজমাতা), তাদের এবছরের বিশেষ আকর্ষণ চন্দ্রযান ২। শক্তিনগরের ক্লাব নিউ স্টার (ভবানী মাতা), তাদের ২০২৩ সালের পুজোর বিষয় ভাবনা শুরুর পরিচয় বর্ণপরিচয়। নেদিয়ার পাড়া নতুন সংঘ (নতুন মাতা) পি কে ভট্টাচার্য রোড বিশেষ আকর্ষণ নারীকথা। অরবিন্দ সরণি পূর্বাচল পাড়ার ক্লাব প্রগতি সংঘ (প্রগতি মাতা) এবারের বিশেষ আকর্ষণ নৌকার দেশে। শক্তিনগর নতুন পাড়ার ক্লাব এস. বি. এস. (মহীয়সী মাতা), তাদের এবছরের বিশেষ আকর্ষণ কুলোর মণ্ডপ। কাঠুরিয়া পাড়ার ক্লাব উদ্যোগ, যাদের পুজোর বিশেষ আকর্ষণ প্রবহমান। চকের পাড়ার ক্লাব অগ্নি মাতা। তাদের বিশেষ আকর্ষণ ছৌ নাচের দেশে, মা আসছে ছৌ নাচের বেশে। রাধানগরের ক্লাব ব্রাইট (রাধা মা) তাদের বিশেষ আকর্ষণ লজেন্সর সাজ। বৌবাজার বারোয়ারীর (মা রূপেশ্বরী) বিশেষ আকর্ষণ শঙ্খ ও ঝিনুকের সাজে সুসজ্জিত দেবী। রাধানগরের ক্লাব আমরা প্রতিবেশীর এবারের থিম মন যা চায়। ক্লাব মাতঙ্গীর বিশেষ আকর্ষণ সহজ মানুষ। ষষ্ঠীতলা পাল বাড়ি ব্রহ্মসনাতনী। খোড়ো পাড়া বারোয়ারীর থিম ইন্ডিয়ান ফ্ল্যাগ। উকিলপাড়ার ক্লাব শহর প্রতি বছর বিষয় ভাবনায় চমক দিয়ে থাকে। তাদের এবারের বিশেষ আকর্ষণ অনুগল্প, সোনাপট্টিতে সাত দিন। তাদের আরেকটি আকর্ষণ হল সবথেকে ছোট তিন ইঞ্চির সরস্বতী প্রতিমা। ক্লাব নবোদয়ের থিম সাজবো যতনে, সেখানে দেখা যায় কাঁচের চুরির সাজ। কোতোয়ালী থানার বিপরীতে ক্লাব টার্গেট এবছর থিম করেছে বিবর্তনের সরস্বতী। ক্লাব বীণাপাণি করেছে পেন্সিল দিয়ে মায়ের সাজ। সমরপল্লী বারোয়ারীর থিম ৩০ ফুট ভারতের জাতীয় পতাকা। হাতারপাড়া (ময়ূরাক্ষী মাতা) বিশেষ আকর্ষণ প্রতিমায় টুথপিকের সাজ। জওহরলাল নেহেরু জাতীয় যুব কম্পিউটার সেন্টারের এবছরের থিম অভিজ্ঞান শকুন্তলম। রাধানগরের ক্লাব রক্তজবা (মা অরুন্ধতী) এবারের থিম মাটির টানে। আনন্দময়ী তলার মহিশাল পাড়ার সৈকত জিমন্যাস্টিক ক্লাবের (বাগময়ী মা) বিশেষ আকর্ষণ প্রতিমার আট ফুটের মুকুট। ঘূর্ণির পেয়াদা পাড়া নতুন সংঘ বিশেষ আকর্ষণ প্রতিমায় ধানের সাজ। ক্লাব বি.জি.এস.-এর থিম মহাকাল। ক্লাব গোল্ডেন স্টারের থিম কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি। হাইস্ট্রীটের ক্লাব A to Z -এর বিশেষ আকর্ষণ স্মরণে বরণে শিল্পী বীরেন পাল।

এছাড়াও কৃষ্ণনগরের বিশেষ কয়েকটি সরস্বতী পুজোর কথা বলতেই হয়। যেমন— চৌধুরীপাড়া (নীলেশ্বরী মাতা), চাষাপাড়ার ক্লাব ক্যাপিট্যাল (শুভ্রমাতা), রাজারোড ষষ্ঠীতলা বারোয়ারী (রাজ রাজেশ্বরী মাতা), কাঠুরিয়াপাড়ার ক্লাব জয়ন্তী সংঘ (জয়ন্তী মাতা), নলুয়াপাড়া বারোয়ারী (সেরা মা), কালীনগর দেশবন্ধু ক্লাব (দেবী মা), ঘূর্ণি সূর্য সংঘ (মিষ্টি মা), উত্তর কালীনগরের শুকুল মাঠ (শ্রেষ্ঠ মাতা), বিশ্বম্বর রায় রোডের রক স্টার ক্লাব (ভুবনেশ্বরী মা), ঘূর্ণি আদি ঘরামীপাড়া (মা রাজেশ্বরী), তাঁতিপাড়া বারোয়ারী (সবার মা), ষষ্ঠীতলা বারোয়ারীর (বড়মা), ছুতোরপাড়ার ক্লাব ত্রিমূর্তি (আদিমা), রাধানগর আদি বারোয়ারির ক্লাব জুপিটার (জয় মা), আর এন ঠাকুর রোডে ক্লাব সপ্তরথী (বিশ্বমাতা), গেটরোড শ্মশান কালী বাড়ি (বাগেশ্বরী মাতা), রাধানগর ক্লাব জুপিটার (জয় মা), ঘূর্ণি ভাই ভাই সংঘ (সেরা মা), নাজিরাপাড়া বয়েজ ক্লাব (বিদ্যামাতা), শক্তিনগরের ক্লাব ক্লাসিক (চন্দ্র মাতা), অঞ্জনা পাড়ার ক্লাব উজ্জয়িনী (চন্দ্রিকা মাতা), ঘোড়া পট্টির ক্লাব প্রতিজ্ঞা (মিষ্টি মা), চৌধুরীপাড়া বারোয়ারীর (স্বর্ণমাতা), কৃষ্ণনগর রোড স্টেশনের ক্লাব একতা (মিষ্টি মা), কৃষ্ণনগরের প্রান্তে কবি বিজয়লাল ইনস্টিটিউটের সম্মুখে নতুন কালিপুর (শান্তি মা), ঘূর্ণি হালদার পাড়ার ক্লাব পেট্রিয়ট (সোনামা), শক্তিনগর পাঁচমাথা মোড় বারোয়ারীর (শক্তিমাতা), প্রভাত সংঘ (জলঙ্গী মাতা)। এছাড়াও কৃষ্ণনগরে বহু সরস্বতী পুজো হয়, যেমন— আনন্দময়ীতলা বালকেশ্বরী বারোয়ারী, হাটখোলা পাড়া বারোয়ারী, নাজিরাপাড়ার ক্লাব চৈতালী, সাপুরিয়াপাড়ার ক্লাব নবজিত, বেলেডাঙ্গা ক্ষৌণিশ পার্কের ক্লাব অরোরা, চৌধুরীপাড়ার ক্লাব ইউরেকা, ক্লাব সানসাইন, কলুপাড়ার ক্লাব প্রতিদান, কালীনগর এম এল এ রায় রোডের ক্লাব পঞ্চদ্বীপ, নগেন্দ্রনগর চতুর্থ লেনে কয়েকটি পরিবার মিলে পারিবারিক, আমরা সবাই ক্লাবের ‘মা বিদ্যাশ্রী’। ক্লাব ইউনিটি, ক্লাব স্বাগতম, ক্লাব যুবকবৃন্দ, রাজদূত ক্লাব, আপনজন ক্লাব, কৃষ্ণনগর রেনেসাঁস ক্লাব, পরশ পাথর ক্লাব, নাজিরাপাড়া ক্লাব ০০৭, নাজিরাপাড়া সর্ব্বশ্রী, ফেমাস ক্লাব, ক্লাব প্রতিবেশী, ক্লাব অভিরূপ, ক্লাব ক্রীড়াঙ্গন, ক্লাব ত্রিমূর্তি, ক্লাব জলসা, মানিকপাড়া ক্লাব ঋতায়ণ, ক্লাব ঘরোয়া প্রভৃতি।

 

 


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ