West Bengal Muslim: পশ্চিমবাংলার মুসলমান: নেতৃত্ব সংকট ও রাজনৈতিক বাস্তবতা/ তায়েদুল ইসলাম
পশ্চিম বাংলার মুসলমান: নেতৃত্ব সংকট ও রাজনৈতিক বাস্তবতা :
তায়েদুল ইসলাম
পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে যত আলোচনা, তত কাজের বাস্তব প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বহু নতুন সংগঠন তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন মঞ্চে সভা-সম্মেলন হচ্ছে, লেখালেখির সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবের ময়দানে এই সমস্ত প্রচেষ্টার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
নেতৃত্বের সংকট ও সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লব
এখনকার মুসলিম নেতৃত্বের একটি বড় সমস্যা হল তাদের বাস্তব কর্মসূচির অভাব। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিপ্লবী সেজে এক শ্রেণির মানুষ নিজেদের পরিচিতি তৈরি করেছেন, কিন্তু জনগণের কাছে তারা আস্থা অর্জন করতে পারেননি। কারণ, তারা ময়দানে বাস্তব কোনো কর্মসূচি নিচ্ছেন না, বরং নিজেদের পরিচিতি বাড়িয়ে কিছু সুবিধা আদায়ের দিকেই বেশি মনোযোগী। এই কারণেই “সোশ্যাল মিডিয়া বিপ্লবী” বলে একটি নেতিবাচক পরিচয় তাদের কপালে জুটেছে।
ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক সুবিধাভোগিতা
একটি বড় অভিযোগ হলো, অনেকে মুসলমানদের বঞ্চনার বিষয়টিকে কেবলমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করছেন। তারা কখনোই ভাবেন না যে, মুসলমানদের কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর চৌকিদার হয়ে থাকার দিন শেষ হওয়া উচিত। বরং মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করা দরকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এই নেতাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, সরকারি আনুকূল্য পাওয়ার আশায়।
আরেকটি বড় সমস্যা হল, এই তথাকথিত মুসলিম নেতারা মুখে বলেন রাজনীতি করেন না, কিন্তু আসলে ভোটের সময় তারা বিভিন্ন দলের দরজায় ঘুরতে থাকেন। অনেকে ভোটে দাঁড়ানোর জন্য চুপিচুপি বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কেউ কেউ নির্দল প্রার্থী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, যাতে সব দিক থেকেই সমর্থন পাওয়া যায়।
মডেল নেতা ও নতুন রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
অনেকে রাজ্যসভায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, আর তার জন্য তাঁরা আহমদ হাসান ইমরান ও সামিরুলের মতো নেতাদের পথ অনুসরণ করছেন। অভিযোগ উঠছে, ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিলের ইস্যুতে যারা সরব, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আসলে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিট পাওয়ার জন্য লবিং শুরু করে দিয়েছেন। মুসলিম মিল্লাতের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে তাদের কোনো প্রকৃত চিন্তা নেই।
সংগঠনের ব্যর্থতা ও এলিট মুসলিমদের ক্লাব সংস্কৃতি
অনেকেই মুসলমানদের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় সংগঠনের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, মজলিস-এ-মুশাওয়ারত-এর মতো সংগঠনের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করা হলেও, বাস্তবে এগুলো মূলত উত্তর ভারতের এলিট মুসলিমদের “ক্লাব” হিসেবেই কাজ করে। বছরের দু’-একটি বড় সভা করে তারা নিজেদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করে। অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব এবং কার্যকর নেতৃত্বের সংকটের কারণে এই সংগঠনগুলো মুসলমানদের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াকফ বিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি তারা।
ভবিষ্যৎ দিশা: রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণ
পশ্চিম বাংলার মুসলমানদের যদি সত্যিই উন্নতি করতে হয়, তবে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি তৈরি করতে হবে। কেবলমাত্র বড় দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। মুসলমানদের স্বার্থের জন্য কাজ করতে হলে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং ছোটখাট সুবিধার লোভ ত্যাগ করতে হবে।
একটি কথা প্রচলিত আছে—”বিধবা হই, কিন্তু সতিন যেন না আসে।” অর্থাৎ মুসলিম সমাজের সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তারা নিজেদের স্বার্থ নিয়ে এত ব্যস্ত যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল—সংগঠিত হওয়া, ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদার হওয়ার জন্য সত্যিকারের পরিকল্পনা করা। মুসলমানদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায়, এই দুর্বলতা ও নেতৃত্বের সংকট চলতেই থাকবে, আর মুসলমান সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর শোষণের শিকার হয়েই থাকবে।