ড. বি আর আম্বেদকর– সংক্ষিপ্ত জীবন আলেখ্য/ মজিবুর রহমান
ড. বি আর আম্বেদকর– সংক্ষিপ্ত জীবন আলেখ্য
মজিবুর রহমান : ভারতের সংসদে সংবিধানের ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আলোচনার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ড. বি আর আম্বেদকরের (১৪.৪.১৮৯১-৬.১২.১৯৫৬) অবমাননা করেছেন, এই অভিযোগে জোরদার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অতীতের অনেক কথাই উঠে আসছে। এই বিতর্কের আবহে শাসকদল বিজেপি ও বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেস উভয়কেই অবশ্য আম্বেদকরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা যাচ্ছে। উভয়েই আম্বেদকরের উত্তরাধিকার দাবি করছে। আম্বেদকর জাতীয় রাজনীতিতে চর্চার মধ্যে উঠে আসছেন। বর্তমান নিবন্ধে আম্বেদকরের জীবনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক ও ঘটনার ওপর আলোকপাত করা হল যা তাঁর জীবনদর্শন ও সাফল্য-ব্যর্থতা বুঝতে সাহায্য করবে।
আম্বেদকরের জন্ম মুম্বাইয়ের অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ে। তাঁর বাবা রামজি শকপাল ছিলেন একটি সামরিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আম্বেদকরের ঠাকুর্দা মালোজী শকপালও সামরিক বিভাগে চাকরি করতেন। আম্বেদকরের মা ভীমাবাঈয়ের বাবা-কাকারাও সামরিক বিভাগের আধিকারিক ছিলেন। সেই হিসেবে আম্বেদকর অস্পৃশ্য হলেও মোটামুটি একটা শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারের সন্তান। জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয় ভীমরাও বা ভীম। বাপ-ঠাকুর্দার পদবি অনুযায়ী ভীমরাওয়ের পদবি ‘শকপাল’ হওয়ার কথা ছিল। তখনকার দিনে অস্পৃশ্যরা চরম সামাজিক অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হতেন। পদবি দেখে অস্পৃশ্য চিহ্নিত করা সহজ হত। শকপাল হল অস্পৃশ্যদের মধ্যে অত্যন্ত চালু একটি পদবি। ভীমরাও শকপাল পদবি নিয়েই গভর্মেন্ট মিডল স্কুলে ভর্তি হন। ওই স্কুলের একজন ব্রাহ্মণ শিক্ষক ভীমরাওকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি ভীমরাওকে পদবির দ্বারা অস্পৃশ্য চিহ্নিত হয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়া থেকে মুক্তি দিতে একটি কৌশল নেন। আমাদের দেশে বাসস্থানের নামকে ব্যক্তির নামের অংশ হিসেবে ব্যবহার করার রেওয়াজ রয়েছে। ভীমরাওয়ের পৈতৃক নিবাস ছিল আম্বাবাদ। ওই মাস্টার মশাই আম্বাবাদ-এর সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে ভীমরাওয়ের পদবি বানিয়ে দেন। তাঁর নাম হয় ভীমরাও (মূল নাম) রামজি (বাবার নাম) আম্বেদকর (পদবি)। ১৯২৭ সালে আম্বেদকরের অনুগামীরা তাঁকে ‘বাবাসাহেব’ উপাধি দেন। সুভাষচন্দ্র বসুর ‘নেতাজি’ আর ভীমরাও রামজি আম্বেদকরের ‘বাবাসাহেব’ ভক্তদের ভালোবাসা বহন করে। সুভাষচন্দ্র ও আম্বেদকরের মধ্যে আরও একটি মিল ছিল। তাঁরা দুজনেই গান্ধীজীর ‘অবাধ্য’ হওয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর সঙ্গে মতবিরোধের কারণে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য হন এবং নতুন দল গঠন করেন। অন্যদিকে, আম্বেদকর দলিত সম্প্রদায়ের প্রশ্নে গান্ধীজীর সঙ্গে কখনও সহমত হতে পারেননি। তিনি একাধিক দল গড়েছেন কিন্তু কখনও কংগ্রেসে যোগদান করেননি। ১৯৫১ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে এক বিশাল জনসভায় আম্বেদকর বলেন, “দেশকে স্বাধীন করার কৃতিত্ব ও সম্মান প্রকৃত অর্থে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রাপ্য, কংগ্রেসের নয়।”
আম্বেদকরের পিতা-মাতার ১৪টি সন্তান জন্মগ্ৰহণ করে কিন্তু নয়জনেরই অকালমৃত্যু হয়। আম্বেদকর ছিলেন কনিষ্ঠতম। আম্বেদকরের মায়ের মৃত্যু পর তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। সৎমায়ের সঙ্গে আম্বেদকরের সম্পর্ক ভালো ছিল না। তবে তিনি পিতার দেখভাল করতেন এবং সৎমায়ের সৎকার সহ আনুষঙ্গিক কাজ দায়িত্ব নিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। আম্বেদকর সতেরো বছর বয়সে নয় বছর বয়েসী রামি বা রমাবাঈয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেন কিন্তু চারজনেরই অকাল মৃত্যু হয়। একমাত্র জীবিত সন্তান যশোবন্ত কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে ব্যর্থ হন। ১৯৩৫ সালে রমাবাঈয়ের মৃত্যু হয়। ১৯৪৮ সালে সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী আম্বেদকর ব্রাহ্মণ কন্যা ডাঃ সারদা কবীরকে বিবাহ করেন। পরে তিনি ‘সারদা’ থেকে ‘সবিতা’ হন। তিনি মুম্বাই গভর্মেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন যেখানে আম্বেদকরকে একাধিকবার রোগী হিসেবে ভর্তি হতে হয়েছিল। সবিতাদেবীর সঙ্গে বিবাহকে আম্বেদকরের পুত্র এবং অনুগামীরা সমর্থন করেননি। আম্বেদকরের প্রয়াণের পর সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে সবিতাদেবী ও যশোবন্তের মধ্যে দীর্ঘদিন আইনি লড়াই চলেছিল।
আম্বেদকর একজন মেধাবী, মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। তিনি মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ১৯১০ সালে আই এ পাস করেন এবং বরোদার মহারাজার কাছ থেকে বৃত্তি পান। ১৯১২ সালে মুম্বাই ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে বি এ পাস করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯১৫ সালে ‘প্রাচীন ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য’ বিষয়ে একটি থিসিস লিখে অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্ৰি লাভ করেন। পরের বছর ‘ভারতের জাতীয় লভ্যাংশ– একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি গবেষণা সন্দর্ভ উপস্থাপন করে পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর বৃত্তির শর্তানুসারে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে বরোদার মহারাজার সামরিক সচিব পদে চাকুরিতে যোগদান করেন। কিন্তু অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের লোক বলে তিনি নানা লাঞ্ছনার শিকার হন এবং নভেম্বরেই চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে মুম্বাইয়ে সিডেনহ্যাম কলেজ অব কমার্স-এ অর্থনীতির অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং মার্চ, ১৯২০ পর্যন্ত চাকুরীতে বহাল থাকেন। এরপর আরও পড়াশোনা করার জন্য বিলেত যাত্রা করেন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স-এ অর্থনীতি ও গ্ৰেস ইন-এ আইন নিয়ে ভর্তি হন। ১৯২১ সালে ‘বৃটিশ ভারতে পুঁজির প্রদেশভিত্তিক বন্টন’ বিষয়ে থিসিসের জন্য এম এস সি ডিগ্ৰি লাভ করেন। ব্যারিস্টার অ্যাট ল পাস করেন ১৯২২ সালে এবং ১৯২৩ সালে ‘টাকার সমস্যা’ বিষয়ক থিসিসের জন্য ডি এস সি ডিগ্ৰি লাভ করেন। ১৯২৫ সালের জানুয়ারিতে মুম্বাইয়ের একটি কলেজে বাণিজ্যিক আইন বিষয়ে খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মার্চ, ১৯২৮ পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর জুন মাসে মুম্বাই গভর্মেন্ট কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে এখান থেকে বিদায় নেন। ১৯৩৫ সালের জুন মাসে এই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ফিরে আসেন এবং ১৯৩৮ সালের জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আর কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেননি। তবে অনিয়মিত ভাবে ব্যারিস্টারি চালিয়ে যান। আম্বেদকর লেখালেখিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ডিগ্ৰি অর্জনের জন্য গবেষণা পত্র লেখা ছাড়াও তিনি তাঁর ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বিষয়াদি নিয়ে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। ১৯২০ সালে তিনি মারাঠি পাক্ষিক পত্রিকা ‘মূক নায়ক’ প্রকাশ করেন। ১৯২৪ সালে এটি বন্ধ করে ‘বহিষ্কৃত ভারত’ নামে আরেকটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২৭ সালে মাসিক পত্রিকা ‘সমতা’র সূচনা হয়। ১৯২৯ সালে পাক্ষিক পত্রিকা ‘জনতা’র যাত্রা শুরু হয়। আম্বেদকরের লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুস্তক বা পুস্তিকার নাম হল– ‘ভারতে জাতিভেদ প্রথা’, ‘ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের সমাধান’, ‘জাতপাত প্রথার বিলুপ্তি’, ‘সংঘ বনাম স্বাধীনতা’, ‘পাকিস্তান বিষয়ে ভাবনাচিন্তা’, ‘তফসিলি জাতিসমূহের সমস্যা’, ‘রানাডে, গান্ধী এবং জিন্নাহ’, ‘অস্পৃশ্যদের জন্য কংগ্রেস ও গান্ধী কী করেছে?’, ‘সাম্প্রদায়িক অচলাবস্থা ও তার সমাধানের একটি উপায়’, ‘শূদ্র কারা?’, ‘রাষ্ট্র ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’, ‘অস্পৃশ্য কারা?’, ‘ভাষাভিত্তিক প্রদেশ হিসেবে মহারাষ্ট্র’, ‘বুদ্ধ ও তাঁর ধর্মমতের ভবিষ্যৎ’, ‘হিন্দু নারীদের উত্থান ও পতনের জন্য দায়ী কারা?’, ‘বুদ্ধ অথবা কার্ল মার্কস’ ইত্যাদি। মহারাষ্ট্র সরকার ১০ খণ্ডে আম্বেদকর রচনাবলী প্রকাশ করেছে।
আম্বেদকর অনুন্নত শ্রেণির উন্নয়নের জন্য ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে গঠন করেন ‘বহিষ্কৃত হিতকারিনী সভা’। জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সম্মেলন থেকে ধ্বনি তোলা হয়– শিক্ষা, আন্দোলন, সংগঠন। এর মাধ্যমে বলতে চাওয়া হয় যে, অনুন্নত শ্রেণির মানুষ শিক্ষা গ্ৰহণ করে সংগঠন গড়ে তুলে আন্দোলনে সামিল হলে তবেই তাঁদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হওয়া সম্ভব। আম্বেদকর ১৯২৫ সালে মুম্বাই বিধান পরিষদের সদস্য মনোনীত হন। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে দু’দিন ধরে সমাবেশ ও সভা করার পর মহারাষ্ট্রের কোলাবা জেলায় অবস্থিত মাহাদ পৌরসভার চৌদার পুকুরে নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে আম্বেদকর দশ হাজার দলিত অনুগামী সহ জলপান করেন। আম্বেদকরের অনুগামীদের সঙ্গে স্থানীয় বর্ণহিন্দুদের মারপিট হয় এবং ব্যাপারটা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। আদালতে আম্বেদকরের জয় হয়। ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় মাহাদে মনুস্মৃতি দহন কর্মসূচি পালন করা হয়। দহন ভূমিতে পোস্টারে লেখা হয়– অস্পৃশ্যতা ধ্বংস হোক, ব্রাহ্মণ্যবাদকে কবর দাও, জন্মের ওপর ভিত্তি করে চতুর্বর্ণ মানি না ইত্যাদি। মনুস্মৃতির একটা একটা করে পাতা ছিঁড়ে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। মনুস্মৃতি দহন আম্বেদকরের একটি দুঃসাহসিক পদক্ষেপ ছিল। মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতার সংক্ষিপ্ত পরিচয়: এটি অন্যতম হিন্দু ধর্মশাস্ত্র। এটি জাতি ও লিঙ্গের উপর ভিত্তি করে মানুষের অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণ করে। মনুস্মৃতি অনুযায়ী, ব্রহ্মার মুখ, বাহু, উরু ও পা থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের সৃষ্টি। মনুস্মৃতি শূদ্রদের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার দেয় না। মনুস্মৃতির বিধানে শূদ্রের শিক্ষার অধিকার নেই, সম্পত্তির অধিকার নেই, ইচ্ছানুযায়ী কাজ করার অধিকার নেই। শূদ্রের কাজ শুধু মুখ বুজে উচ্চবর্ণের সেবা করা, কোনও প্রতিদানের আশা না করে। হিন্দুদের আদি ধর্মগ্ৰন্থ বেদ পাঠ করা এমনকি শ্রবণ করাও শূদ্রদের জন্য কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মনুসংহিতা নারীর অধিকার চূড়ান্তভাবে খর্ব করে এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্ৰহণ করে। পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা সন্তানের অধিকার অস্বীকার করা হয়। রূপচর্চা, শিশু পালন ও ধাত্রীবিদ্যা অধ্যয়নের মধ্যে নারীর ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়। পুরুষদের বহুবিবাহের অনুমতি দেয় কিন্তু অকাল বিধবার পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ করে। সবমিলিয়ে বলা যায়, শূদ্র ও নারীকে চরম অমর্যাদা ও বৈষম্যের সমাসনে বসিয়েছে মনুসংহিতা।
আম্বেদকর অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৩০ ও ১৯৩১ সালের গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড ১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা (কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ড) ঘোষণা করেন। এতে প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানদের পাশাপাশি নির্যাতিত শ্রেণি তথা দলিত সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা নির্বাচনের দাবি স্বীকৃত হয়। এর অর্থ হল, কিছু আসন থাকবে সাধারণ (জেনারেল) যেগুলোতে (উচ্চবর্ণের) হিন্দু সহ সকল ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল ভোটার একটি করে ভোট দেবেন এবং একজন প্রার্থী জয়লাভ করবেন। কিন্তু কিছু আসন হবে সংরক্ষিত (রিজার্ভড) যেগুলোতে যেকোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের সঙ্গে মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান অথবা দলিত প্রার্থীরা থাকবেন। জয়লাভ করবেন দু’জন। একজন সাধারণ সম্প্রদায়ের প্রার্থী এবং একজন সংরক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রার্থী। অসংরক্ষিত আসনটির জন্য সকলেই ভোট দিতে পারবেন। কিন্তু সংরক্ষিত আসনের জন্য শুধুমাত্র ওই সম্প্রদায়ের ভোটাররাই ভোট দিতে পারবেন। কংগ্রেস মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নিলেও দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থায় তীব্র আপত্তি জানায়। মহাত্মা গান্ধী তখন মহারাষ্ট্রের পুনেতে অবস্থিত যারবেদা কারাগারে বন্দি ছিলেন। তিনি দলিতদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে আমৃত্যু অনশন শুরু করেন। গান্ধীজীর সঙ্গে আম্বেদকর সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের আলাপ আলোচনার পর সেপ্টেম্বর মাসে ‘পুণা চুক্তি’ গৃহীত হয়। এই চুক্তি অনুসারে অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংযুক্ত নির্বাচনী ক্ষেত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর ফলে প্রাদেশিক আইনসভাগুলোতে সাধারণ আসনে অনুন্নত সম্প্রদায়ের জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত থাকবে। এগুলোতে প্রার্থীরা সকলেই অনুন্নত সম্প্রদায়ের হবেন কিন্তু সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভোটাররাই ভোট দেবেন। গোটা দেশে এমন সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা স্থির করা হয় ১৪৮টি। এর মধ্যে বাংলার আসন ছিল ৩০টি। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে বাংলায় প্রায় ৯০টি বর্ণ ও জাতি-গোষ্ঠীকে অনুন্নত শ্রেণি হিসেবে ঘোষণা করা হয়– বাগদী, বাহেলিয়া, বাইতি, বাউরি, বেদিয়া, ভাটিয়া, ভুঁইমালি, ভুঁইয়া, ভূমিজ, চামার, ধেনুয়া, ধোবা, ডোম, গারো, খাসি, হাড়ি, হো, জেলিয়া, কৈবর্ত, ঝালো, মালো, কাদার, খারো, কালোয়ার, কান, কাঁষ, কান্দ্রা, কেওরা, কাপালি, কাপুরিয়া, কারেঙ্গা, কস্তা, কউর, খণ্ডাইত, খাতিক, কীবক, কোচ, কোনাই, কোনওয়ার, কেরা, কোটাল, লোধা, লোহার, মাহার, মালি, মাল, মল্ল, মেছ, মেথর, মুচি, মুন্ডা, মুসাহার, নাগর, নাগেসিয়া, নৈয়া, নমঃশূদ্র, নাথ, নুজিয়া, ওঁরাও, পালিয়া, পান, পাশি, পাটনি, পোদ, পুস্তরী, রাভা, রাজবংশী, রাজোয়ার, সাঁওতাল, সুকলি, শুড়ি, তুরী ইত্যাদি। এরাই প্রাথমিকভাবে সিডিউলড কাস্ট বা তফসিলি জাতি বলে চিহ্নিত হয়। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে ‘ভারত শাসন আইন’ পাস করে তাতে তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষণ স্বীকৃত হয়। ১৯৫০ সালে স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ১১০৮টি জনগোষ্ঠী তফসিলি জাতি ও ৭৪২টি জনগোষ্ঠীকে তফসিলি উপজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
স্বায়ত্তশাসন প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আম্বেদকর ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর দল মুম্বাই আইনসভার নির্বাচনে ১৫টি আসনে জয়লাভ করে। তিনি নিজেও নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি গড়ে তোলেন তফসিলি জাতি ফেডারেশন। জুলাই মাসে তাঁকে ভাইসরয়ের কর্মসমিতিতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় যা তিনি জুন, ১৯৪৬ পর্যন্ত পালন করেন। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৬ সালেই প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের ভোটে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। মুম্বাই আইন পরিষদে তফসিলি জাতি ফেডারেশন সদস্য খুব কম থাকায় আম্বেদকরের সেখান থেকে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তাই তাঁকে বাংলা থেকে গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের জুন মাসে বাংলার আইনসভায় বঙ্গ বিভাজনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার ফলে গণপরিষদে (পশ্চিম) বাংলার প্রতিনিধির সংখ্যা হ্রাস পায় এবং আম্বেদকরের সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। তখন কংগ্রেস মুম্বাই বিধানসভায় তাদের সদস্য ড. এম আর জয়াকারের পদত্যাগের ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থান থেকে আম্বেদকরকে গণপরিষদে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। স্বাধীন ভারতে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভায় তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। ২৯শে আগস্ট, ১৯৪৭ গণপরিষদ সাত সদস্য বিশিষ্ট খসড়া (ড্রাফটিং ) কমিটি গঠন করে যার সভাপতি নিযুক্ত হন আম্বেদকর। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণপরিষদের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র প্রসাদের নিকট সংবিধানের খসড়া জমা করা হয়। গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা শুরু হয় ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৪৮। ২৬শে নভেম্বর, ১৯৪৯ সংবিধান গৃহীত হয় এবং ২৬শে জানুয়ারি, ১৯৫০ কার্যকর হয়। আইনমন্ত্রী হিসেবে আম্বেদকর ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে হিন্দু কোড বিল পেশ করেন। এই বিলে হিন্দু সমাজে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সংস্কারের সংস্থান রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ সহ কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের নেতৃবৃন্দ বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেন। অস্পৃশ্য মাহার আম্বেদকর হিন্দুর ধর্মীয় বিধান সংস্কার করবেন, এটা অনেক গোঁড়া হিন্দু মেনে নিতে পারেননি। প্রচুর বাকবিতণ্ডা হয়। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিলটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। আম্বেদকর তাঁর দীর্ঘ পরিশ্রমের এমন করুণ পরিণতিতে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন এবং ১১ই অক্টোবর মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন। পদত্যাগের অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি ভারত সরকারের কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করেন। তাঁর পরামর্শ ছিল, কাশ্মীরের মুসলমান প্রধান অংশ চলে যাক পাকিস্তানে এবং হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ প্রধান অংশ যুক্ত হোক ভারতের সঙ্গে।
স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে। আম্বেদকর মুম্বাইয়ের একটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে তফসিলি জাতি ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেস প্রার্থীর নিকট পরাজিত হন। কয়েক দিন পর মার্চ মাসের শেষ দিকে মুম্বাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট ১৫টি রাজ্যসভা আসনের একটিতে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে সংসদের অধিবেশনে এক বক্তৃতায় আম্বেদকর বলেন, “আমার বন্ধুরা বলেন আমিই সংবিধান রচনা করেছি। কিন্তু আজ একথা আমি বলতে চাই যে, আমিই প্রথম ব্যক্তি সেটাকে পুড়িয়ে ফেলতে চাই। এই সংবিধান আমি চাই না।” তিনি নিজেকে ‘ভাড়াটিয়া সংবিধান লেখক’ বলেছিলেন। রাজ্যসভার সদস্য থাকা সত্ত্বেও ১৯৫৪ সালে মুম্বাইয়ের একটি লোকসভার উপনির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং পরাজিত হন।
আম্বেদকর ও তাঁর স্ত্রী সবিতা ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন নাগপুরে আনুষ্ঠানিক ভাবে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেন। দীক্ষাভূমি জনসমুদ্রের আকার ধারণ করে। সমবেত জনতা আম্বেদকরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্ৰহণ করেন। ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবরের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ নিম্নবর্ণের হিন্দু বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পাঁচ-ছয় বছর আগে থেকেই দেশ বিদেশের বিভিন্ন বৌদ্ধ উৎসব ও অনুষ্ঠানে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তাঁর চেষ্টায় বৌদ্ধধর্মের স্মৃতি বিজড়িত অশোক চক্র ভারতের জাতীয় পতাকায় স্থান পায় এবং সারনাথের অশোক স্তম্ভের চূড়ার জোড়া সিংহ মূর্তি ভারত রাষ্ট্রের প্রতীক রূপে গৃহীত হয়। তিনি ১৯৫৩ সালের জুন মাসে স্থাপন করেন মুম্বাই সিদ্ধার্থ (গৌতম বুদ্ধের পূর্বনাম) কলেজ অব কমার্স। আম্বেদকরের হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার চিন্তাভাবনা দুই-আড়াই দশক আগেই শুরু হয়েছিল। ১৯২৯ সালে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “অস্পৃশ্যরা যেন এমন এক ধর্ম গ্ৰহণ করে যা তাদের সমান অধিকার দেবে অন্য মানুষদের সঙ্গে ওঠা-বসা করার, একসাথে খাওয়ার।” ১৯৩৫ সালে মহারাষ্ট্রের ইয়োলায় দলিত সমাজের দশ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ধর্মান্তরকরণের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। নিজের ধর্মান্তরিত হওয়ার ব্যাপারে আম্বেদকর বলেন যে, তিনি জন্ম নিয়েছেন অস্পৃশ্য হিন্দু হিসেবে, এর অন্যথা তাঁর এক্তিয়ারে ছিল না। তবে তিনি হিন্দু হিসেবে মৃত্যু বরণ করবেন না। তিনি প্রমাণ করতে সচেষ্ট হন যে, অস্পৃশ্য শব্দটির জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে। সে সময় যে সব বৌদ্ধ হিন্দুধর্ম গ্ৰহণ করেননি তাঁদেরই অস্পৃশ্য আখ্যা দেওয়া হয়। পরে অবশ্য হিন্দুধর্ম গৌতম বুদ্ধকে দশম অবতারের একজন হিসেবে মেনে নেয়। আম্বেদকরের মতে সে যুগের নিষ্ঠাবান বৌদ্ধরাই বর্তমান ভারতে অস্পৃশ্য হয়ে আছেন।
আম্বেদকর তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও সুখ্যাতি অর্জন করতে সমর্থ হন। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সংবিধান রচনার কৃতিত্বের জন্য আম্বেদকরকে সম্মানসূচক ডি লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। প্রখ্যাত আইরিশ নাট্যকার, বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক কর্মী জর্জ বার্নার্ড শ (১৮৫৬-১৯৫০) বলেছিলেন, “ড. আম্বেদকরের বর্তমান ও সুদূর ভবিষ্যতকে দেখবার আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি ছিল।” বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) বলেছিলেন, “পণ্ডিতদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু আম্বেদকরের মতো জ্ঞানী ও মহান শিক্ষক জগতে খুবই কম।” প্রখ্যাত ইংরেজ লেখক, নাট্যকার ও পাবলিক স্পিকার জন বেভারলি নিকোলস (১৮৯৮-১৯৮৩) মন্তব্য করেন, “ড. আম্বেদকর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ছয়জন মেধাবী পণ্ডিতদের একজন।”
আম্বেদকরের আদর্শকে সামনে রেখে কাঁশিরাম (১৯৩৪-২০০৬) ১৯৮৪ সালে উত্তরপ্রদেশে বহুজন সমাজ পার্টি (বি এস পি) গঠন করেন। ১৯৯০ সালে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকার আম্বেদকরকে মরণোত্তর ভারতরত্ন পুরস্কার প্রদান করে।দলিত সমাজ আম্বেদকরকে ভগবানের দৃষ্টিতে দেখে। অনেক সংগঠন ১৪ই অক্টোবর ধর্মান্তর দিবস ও ২৫শে ডিসেম্বর মনুস্মৃতি দহন দিবস উদযাপন করে। ভারতের সংবিধানের আলোচনা তাঁকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হয় না। কাজেই যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন আম্বেদকর বিস্মৃতির অতল গহ্বরে কখনও হারিয়ে যাবেন না।
ঋণ স্বীকার: ভারতরত্ন বাবাসাহেব আম্বেদকর/সুশান্তকুমার সাহিত্যরত্ন, উইকিপিডিয়া