কলকাতা 

মেঘালয়ে মেঘের আড়ালে ঈমানী সূর্য/মেঘালয় থেকে ফিরে আজিজুল হক

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বাধিক প্রিয় কারা? এ বিষয়ে বর্ণিত আছে যে, একবার হযরত মুসা আ. আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে? আল্লাহর পক্ষ থেকে জবাব দেয়া হয়েছিল যে, কোন মুমিন ব্যক্তির পায়ে কাঁটা বৃদ্ধ হলে যে ব্যক্তি সে কাঁটার বেদনা নিজের পায়ে অনুভব করে সেই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ।

বিচিত্রময় এ ধরা। জগত সংসারের বানানেওয়ালা বিচিত্ররূপ রসে তৈরি করেছেন জগত সংসারকে। কোথাও নদী , কোথাও সমুদ্র ,কোথাও বা জঙ্গল, আবার কোথাও বা পাহাড় ,কোথাও মরু, কথাও সমতল ,কোথাও অসমতল শত বৈচিত্রের রূপরসে তৈরি।

Advertisement

নান্দনিক বৈচিত্র্যে ভরা পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়। গিয়েছিলাম ঈদের ছুটিতে। ঘুরলাম,ফিরলাম দুচোখ মেলে দেখলাম ভারত -বাংলাদেশের দুই দেশের সীমান্ত ভারত -মহেন্দ্রগঞ্জ। এছাড়া পশ্চিম গারো হিলস এর ফুলবাড়ী জেলার প্রত্যন্ত গ্ৰাম থেকে গ্রামান্তর। অতঃপর গারো ও খাসিয়া পাহাড় অভিযান। অবশেষে মেঘালয়ের রাজধানী শিলং ভ্রমণ।

শিলং থেকে ছাপান্ন কিলোমিটার দূরত্বের সর্বোচ্চ চূড়া চেরাপুঞ্জি।

মূলত মেঘালয়ের বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম গারো – খাসি পাহাড়। এছাড়া রয়েছে বিশেষ জায়গা জুড়ে সমতল ভূমি। মেঘালয় যেমন বৈচিত্র্যে ভরা তেমনি বিচিত্র ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস।

৫ শতাংশ মুসলিমদের আবাসভূমি মেঘালয়

———————————————————

এই রাজ্যে প্রায় ৯০% খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। বাকি দশ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং মুসলিম । সব মিলিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা পাঁচ শতাংশ।

অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে নিজ নিজ ধর্ম নিয়ে জীবন যাপন। মুসলিম পরিবারের মানুষজনের, মুসলিম ঘরে জন্মালেও ছিল না ইসলামিক চর্চা। ছিলনা দ্বীনি পরিবেশ। বাপ দাদা থেকে মুসলিম ঘরে জন্ম, তাই মুসলিম নাম নিয়ে সমাজে বেঁচে থাকা।

ব্যক্তি জীবন থেকে সমাজ জীবনে প্রবেশ করেনি ইসলামের বিমল আলো। ঈমানী সৌরভ থেকে ছিল শত যোজন দূরে।

 

সুদীর্ঘ বছর মেঘালয় মুসলিমদের নিকানো উঠানে দীপ্ত হয়নি ইসলামি জ্যোতি। তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেনি শরীয়ত সুন্নাহ। অন্যদের মতো ছিল উলঙ্গ নাচ গানে অভ্যস্ত। করেছে পরের তামাক সেবনের কাজ। এইরকম শিকড়হীনদের উদ্দেশ্যে কাজী নজরুল ইসলাম আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছিলেন-

‘ভুলিয়াছে মুসলিম মোহ পাশে

মাতিয়াছে সবে বিভাবের বিলাসে।’

মেহনতের বলে বইছে ঈমানী খুশবু

।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।।

মুসলিমরা ছিল বিজাতীয় সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। জানতো না পুরো কালেমা। তাদের মধ্যে ছিলনা ওযু গোসলের প্রাথমিক জ্ঞান। মেয়েদের মধ্যে ছিল না পর্দা পুশিদা। মসজিদ ছিল হাতে গোনা। ছিলনা ঈদগা ও বিশেষ কবরস্থান।

যে কয়টি মসজিদ ছিল, ছিল নামাজী শূন্যতায়। জানাযায়, ইমাম আযান দিত, নামাজী অভাবে একাই নামাজ পড়ে নিতেন। স্বল্প সংখ্যক মানুষ ছাড়া ছিল না কোরআন পড়নেওয়ালা, আল্লাহ ওয়ালা।

মুসলিম মহল্লা গুলিতে ছিলনা দ্বীনদারীত্ব। ছিল বর্বরতা। পরনের কাপড়চোপড় বলতে হাফ প্যান্ট, গামছা , গেঞ্জি । মেয়ে মানুষের মধ্যে পর্দা পুশিদা বলতে কিছুই ছিল না।এই দ্বীনহীন পরিবেশে ইসলামের চেরাগ জালান বাংলার ওলামাগণ। দীর্ঘকাল চলল দাওয়াতে তাবলীগের মেহনত।মাসের পর মাস, এমনকি সাল চিল্লা দিয়ে পাহাড়ি এলাকায়, শত কষ্টের পাহাড়ের চড়াই উতরাইতে বুনেযান ঈমানী বীজ।

চলল মেহনত আর মেহনত। কৃষক থেকে ক্ষেতমজুর, ছাত্র থেকে শিক্ষক, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের মুসলিমদের মধ্যে ঈমানী রঙ এ রাঙানোর মেহনত। আল্লাহ্ ভোলা বান্দাদেরকে আল্লাহ্ মুখি করার অক্লান্ত মেহনত আর মেহনত।

দাওয়াতে মেহনতকারীদের অনেক সময় ও মালের কুরবানী, অশ্রু সিক্ত নয়নে গভীর রজনী গুলিতে জায়নামাজে নত হয়ে পাহাড়ে ও পাহাড়ি পাদদেশ থাকা উম্মতে মোহাম্মদীর হেদায়েত দেওয়ার ফরিয়াদ ছিল আল্লাহ সুবহানুতায়ালার দরবারে।

মুসাফিরদের কান্নার বলে পাহাড়ের বুকে ও পাদদেশে জ্বলে উঠে ইসলামের চিরাগ। মেঘালয়ের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় গুলিতে পা ফেললে সর্বত্র চোখে পড়বে টুপি দাড়ি , পায়জামা পাঞ্জাবি সুন্নতি পোশাকের মানুষজন। প্রায় ৯০% মহিলারা পর্দা পুশিদার মধ্যে সর্বত্র চলাফেরা।

মেঘালয়ের জমিনে সর্বত্র জামাতিদের প্রতি রয়েছে কদর। এলাকায় জামাতীরা আসলে মুসলিম পরিবারের মানুষজন করে থাকে বিশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা। মহিলা ও পুরুষেরা নিজেদের বাড়ি থেকে রান্না তৈরি করে জামাতি মেহমানদেরকে আপ্যায়ন করে থাকেন।

শুধু তাই না দাওয়াতি কাজে জমে থাকার জন্য মেঘালয়ে ১৯৯৩ তে অনুষ্ঠিত হয় ইজতেমা । সেই ইজতেমা থেকে সারা মেঘালয় জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জামাত। বিভিন্ন জীবিকার মানুষজন এক চিল্লা ,দু চিল্লা দিয়ে গড়ে তোলে ঈমানী পরিবেশ।

মহিলারাও এগিয়ে এলো ঈমানী পরিবেশ গড়তে

—————————————————————-

কেবল পুরুষদের মধ্যে নয়, মহিলাদের মধ্যেও দাওয়াতের কাজ চলছে তালে তালে। ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন জায়গায় মহিলাদের মধ্যে তালিম ও জামাতি কাজ চলছে। মহিলাদেরও জামাত বিভিন্ন জায়গা বের হয়ে থাকে ঈমানী বুনিয়াদ গড়ার লক্ষ্যে।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, মা মাকসুরাত দাওয়াতি কাজে আঞ্জামরত। সাম্প্রতিক ওয়েস্ট গারো হিলসে মহিলা জামাতীদের মধ্যে সময় দিয়েছেন এক চিল্লায় ৩৩ জন,,১০ দিনে ১৮৬ জন, ৩ দিনে সময় লাগিয়েছেন ৬৭৮ জন ।

গারো হিলসে দ্বীনের চিরাগ জ্বালিয়েছে

বাংলার জামাত

-লাচর ব্লকের ১৪ টি মসজিদের জিম্মাদার ও অবসরপ্রাপ্ত ভেটেনারি আধিকারিক হাজী আব্দুল মালেক সাহেব এক সাক্ষাৎকারে জানান, খাস করে ওয়েস্ট গারো হিলসে ইসলামের চিরাগ জ্বালানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলার তাবলীগ জামাতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। বিশেষ করে মগরাহাট, কলুটোলা ও চন্দননগরের মারকাজ মসজিদের জিম্মাদারদের অবদান ভুলে যাওয়ার নয়। মেঘালয়ের বুকে দ্বীনি পরিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে তাদেরই অবদান। নর্থইস্ট যে ৪১টি মারকাজ মসজিদ আছে তাদের চেষ্টার ফসল। দ্বীনদারি ফিজাতে তাঁদেরই অবদান।

মহিলাদের মধ্যে দ্বীনি ফিজা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে ২০ টি মহিলা মাদ্রাসা। প্রতি গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে আলিমা ও হাফিজা।

এগিয়ে এসেছে আধুনিক শিক্ষিতরা-

মুরুব্বীদের মতে নর্থইস্ট এ অজ্ঞতা ও অন্ধকারের জঙ্গল সাফ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা দাওয়াতে তাবলীগের জামাতিরা। তাদের আত্মত্যাগের বলে ইসলামিক মডেল ভূমি হয়ে উঠেছে মেঘালয়। তাদের দেখানো পথ ধরে কালা চরে ৬৮ টি গ্রামে গড়ে উঠেছে ২৬১ টি মসজিদ । গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে চলছে তা’লীম। পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে চলছে সাপ্তাহিক ও মাসিক তা’লীম।

আধুনিক শিক্ষিতরা দাওয়াতি কাজে বিশেষ সময় লাগাচ্ছেন। জেনারেল শিক্ষিতদের বয়ান মনে হবে আলেমদের বয়ান।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ