অন্যান্য কলকাতা 

ফিরহাদ হাকিমের অপমান পক্ষান্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই অপমান নয় কী ?/ সেখ ইবাদুল ইসলাম

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ ইবাদুল ইসলাম : ফিরহাদ হাকিম একজন সাধারণ মানের রাজনীতিবিদ । সুব্রত মুখোপাধ্যায় কিংবা সোমেন মিত্রের এক সময়কার ভাবশিষ্য ছিলেন ফিরহাদ হাকিম । অল্প বয়সেই বাবাকে হারিয়ে ছিলেন । মা মনিকা হাকিম এবং জেঠু বিশিষ্ট চিকিৎসক রহমান সাহেবের পরিচর্যায় নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেছেন । নিজে ধর্ম সেভাবে মানেন বলে মনে হয় না । তবে বিয়ে করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবারে । স্ত্রী ইসমাত পরহেজগার না হলেও ধর্ম মানেন এটা স্বীকার করতেই হবে । তা সত্ত্বে ফিরহাদ হাকিম কিংবা ববির ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবেন না । সুব্রত মুখার্জি কিংবা সোমেন মিত্রের হাত ধরে রাজনীতিতে এলেও তাঁকে রাজনৈতিক নেতা হিসাবে বাংলায় পরিচিতি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনিয়ে কারও মনে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না ।

বেশ কয়েক বছর আগে আলিপুর বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে ফিরহাদকে প্রার্থী না করায় দিদির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন । কিন্ত সেটাও ছিল দিদির প্রতি ভায়ের অভিমান । তারপরেই আমরা দেখেছিলাম ওই আলিপুর থেকেই ফিরহাদকে বিধায়ক করতে মমতাকে । এরপর থেকে আর কোনো সময়েই মমতার সঙ্গে মতবিরোধ হয়নি । তবে এ কখা ঠিক মমতার অনুমতি না নিয়ে কোনো কাজই ফিরহাদ হাকিম যে করেন না তা যেকোনো রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি বলে দিতে পারবেন । তবে মমতা কেন ফিরহাদকে এত স্নেহ করেন ? এই প্রশ্ন তৃণমূলের অন্দরে ঘোরাফেরা করে থাকে । অনেকেই বলেন যোগ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন ফিরহাদ । কিন্ত বিষয়টি একটু খতিয়ে দেখলে তাঁর গুরুত্ব পাওয়ার রহস্যভেদ হয়ে যাবে ।

Advertisement

প্রথমত ফিরহাদ হাকিম এমন একজন রাজনীতিবিদ যিনি জনগণের সঙ্গে থাকতে বেশি ভালবাসেন । তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার আগে কাউন্সিলার হিসাবে তিনি বেশ কয়েক বার সেরা কাউন্সিলারের মর্যাদা পেয়েছেন । জনসংযোগে ফিরহাদ হাকিমকে শুধুমাত্র মমতার সঙ্গে তুলনা করা না গেলেও বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে তুলনা করলে অত্যুুক্তি হবে না । একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে ফিরহাদ হাকিম সফল শুধু নন সফলতম জনপ্রতিনিধি । যাঁরা তাঁকে কটাক্ষ করেন নানা বিদ্রুপ করেন (তৃণমূল দলের অন্দরে) তাঁদের সকলের জনসংযোগের চেয়ে যোজন মাইল এগিয়ে রয়েছেন ফিরহাদ ।

দ্বিতীয়ত, ফিরহাদ হাকিম বাংলার রাজনীতিতে ব্যতিক্রমী চরিত্র । ক্ষমতার উদ্ধত্যে শাসক দলের নেতারা যখন বিরোধী দলের নেতাদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করেন কলকাতার মেয়র তখন শান্ত সৌজন্যতা বজায় রেখে আক্রমণ করেন । এটাই ফিরহাদের মূল্যবোধের রাজনীতির শিক্ষা ।

তৃতীয়ত, নারদ স্ট্রিং অপারেশনের আগে পর্যন্ত ফিরহাদ হাকিম যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতেন তাদের বিভিন্ন অভাব অভিযোগ শুনতেন । কিন্ত নারদের ঘটনার পর কোথায় যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ।

ইদানিং হয়তো নেত্রীর কাছে ভাল হওয়ার জন্য ডি এ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে নানা কটুক্তি করেছেন । তারজন্য হয়তো ফিরহাদ একান্তে পস্তাচ্ছেন । এটুকু ছাড়া দীর্ঘ রাজনীতি জীবনে সৌজন্যতাকেই মান্যতা দিয়েছেন তিনি ।  আর এই কারনেই মমতা বন্দ্যেপাধ্যায়ের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছেন ফিরহাদ হাকিম । একথা বলতে দ্বিধা নেই মুকুল রায় দল ত্যাগ করার পর মানুষের সঙ্গে সংযোগের দায়িত্বটা অনেকটাই পালন করে চলেছেন ববি হাকিম। তা না হলে শাসক দলের অসন্তোষ আরও গভীরে পৌছে যেত ।

মমতার কানন যদি সেদিন মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ না করতেন তা হলে হয়তো কলকাতার মহানাগরিক পদে ফিরহাদ হাকিমকে আমরা দেখতে পেতাম না । মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দৃরদৃষ্টিতে শোভনের জায়গায় ফিরহাদকে এনেছিলেন তা এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে । মেয়র হিসাবে ফিরহাদ সফল হয়েছেন কিনা তার বিচার অবশ্যই কলকাতার মানুষ করবেন তবে তিনি কলকাতার উন্নতির জন্য যে কাজ করেছেন তাও ইতিহাস হয়ে থেকে যাবে ।

অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরহাদ হাকিমকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন । নিশ্চয় তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন । তাই পুর মন্ত্রীর পাশাপাশি কলকাতার মেয়র হিসাবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন । সব কিছু ঠিকঠাক ছিল । গোল বাধছে এক মুখপাত্রের লম্ফছম্ফে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা ব্যক্তি যখন তাঁরই দলের মুখপাত্র হয়ে যান তখন সন্দেহ জাগে বইকি ! কেন পদোন্নতি ? যাঁকে বেশ কয়েক বছর জেলের ভেতরে রাখা হলো তাঁকেই দলের প্রবীণ নেতাদের খবরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ! রহস্য কী ? বাংলার মানুষ এই রহস্য নিয়ে ভাবছে । প্রতিদিন ভাবছে ! প্রতি মুহুর্তে ভাবছে !

সাগরদিঘিতে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরে যাবার পর তৃণমূল নেত্রী আফশোষ করেছিলেন সংখ্যালঘুদের জন্য এত কিছু করার পরও ভোট পেলাম না ! আর আজ ফিরহাদ হাকিম ভাবছেন দিদির জন্য এত কিছু করার পরও একজন জেল খাটা আসামীর কাছে অপমানিত হতে হচ্ছে ! কলকাতার রাস্তায় পার্কিং ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতা পুরসভা তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন না, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না । ফিরহাদ এমন কাজ নেই যা তিনি তাঁর দিদির অনুমতি ছাড়া করেন না। আর পার্কিং ফি বাড়ানোর এতবড় সিদ্ধান্ত মমতাকে না জানিয়ে নেওয়া হয়েছে একথা এখন বিরোধীরাও বিশ্বাস করছেন না । এক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, কলকাতার রাস্তায় পার্কিং ফি বাড়ানো নিয়ে নাকি মন্ত্রীসভাতেও আলোচনা হয়েছে ! তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে এই সিদ্ধান্ত এই কথাটি যিনি বলেছেন তিনি কী প্রকৃত অর্থে দলের স্বার্থে কথা বলেছেন!

কলকাতা পুরসভা স্বশাসিত সংস্থা । এই সংস্থার মেয়র হিসাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন । আর দলের দায়িত্ব হলো মানুষের স্বার্থে সব কিছু বিবেচনা করা । মেয়রের কোনো সিদ্ধান্ত ভুল হলে তা দলনেত্রী নির্দেশ দিতে পারেন সংশোধনের জন্য । তা হবে গোপনেই । প্রকাশ্যে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে নয় । অনেকেই হয়তো ভাবছেন দলের মুখপাত্র মেয়রকে শবক শেখালেন । মেয়রকে অপমান করে আসলে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই অপমান করা হয়েছে । আর এতেই আর যাইহোক দল সংকটে পড়েছে । সাধারণ মানুষের কাছে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা ধাক্কা খেয়েছে ।

আর ফিরহাদকে অপমান করে কার্যত তৃণমূল দলের সংখ্যালঘু নেতাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে । শাসক দলের সংখ্যালঘু নেতারা এখন আতংকিত । তাঁরা মনে করছেন দিদির জন্য নিবেদিত প্রাণ ফিরহাদকে যদি প্রকাশ্যে সাংবাদিক সম্মেলন করে অপমান করতে পারেন আর দিদি নিরব থাকেন তা হলে তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন ।

রাম নবমী থেকে হনুমান জয়ন্তী সব ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। রাজ্যের সংখ্যালঘু সমাজ শাসক দলের কাছ থেকে আরও দূরে সরে গেছে ! ফিরহাদ হাকিমকে অপমান করার পর এই রাজ্যের শাসক দলের সংখ্যালঘু নেতারাও তৃণমূলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন । ফিরহাদের অপমান শুধু ব্যক্তিগত নয় , মমতার অপমান তো বটেই এবং দলের মমতা ঘনিষ্ট নেতাদেরও অপমান । শাসক দল নিজের ঘরেই বিপদে পড়েছে । ঘরে শত্রু থাকলে জিততে পারবেন মমতা !

 


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ