অন্যান্য কলকাতা 

সৈয়দ বদরুদ্দোজা: একজন বিস্মৃতপ্রায় মুক্তমনা, সাহসী ও বাগ্মী রাজনীতিক/মোহাম্মদ সাদউদ্দিন 

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

আজ চৌঠা জানুয়ারি বাংলার প্রখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ বদরুদ্দোজার জন্মদিন। বিভক্ত বাংলায় নির্দল প্রার্থী হিসেবে লোকসভায় জয়ী হয়েছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী এই রাজনীতিবিদকে কংগ্রেসের যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি সেই অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। এই মহান রাজনীতিবিদের আজ জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ সাদ উদ্দিন।

—————————————-

Advertisement

কলকাতার কোনো এক স্হানে এক বাগ্মী বামপন্হী সাংসদ , চিন্তাবিদ অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, সৈয়দ বদরুদ্দোজার মতো এতো বড় মাপের তুখোড় বক্তা ও সাহসী রাজনীতিক তাাঁর আমলে কেউ ছিলেন না। তাঁর সমকক্ষ বক্তা খুব কম।মনে রাখতে হবে কথাটি কিন্তু হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ।তিনি নিজেও একজন সুবক্তা ছিলেন। একেই বলে বাঘ কিন্তু বাঘকে চিনে।

১৯৩৭ সাল।অবিভক্ত বাংলায় তখন শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি ক্ষমতাসীন।হক সাহেব প্রধানমন্ত্রী। ঐ হক মন্ত্রিসভাকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে সংবর্ধনার ব্যবস্হা করেছেন।সেই সংবর্ধনা সভায় বক্তৃতা করছেন কৃষক প্রজাপার্টির তরুণতুর্কী সৈয়দ বদরুদ্দোজা ।নোবেলজয়ী কবিগুরু ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এ কে ফজলুল হক সহ সব বাঘা বাঘা রাজনীতিক ও পণ্ডিতপ্রবররা আছেন।তরুণ বদরুদ্দোজার বক্তব্য দিয়েই চলেছেন।গোটা পরিবেশটা একেবারে নীরব।যেন সূচ পড়লে শব্দ হবে। বক্তব্য শেষ হয়ে গেল।কবিগুরু সহ সমগ্র সভাা করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠল।সৌমকান্তি বদরুদ্দোজার কাছে এসেই কবি গুরু বললেন, আমি লিখতে পারি কিন্তু এতো ভালো বলতে পারি না।

বদরুদ্দোজা ঘুরিয়ে কবিগুরুকে সম্মান দিয়ে বললেন, আপনার হাতে বাংলা শব্দভাণ্ডার গুরুদেব।আপনি আমাদের ভাষাভাণ্ডার।

রবীন্দ্রনাথ সেদিন বদরুদ্দোজাকে চিন্তে এতটুকু ভুল করেননি। কিন্তু আমরা কতটুকু জানি সেই বদরুদ্দোজাকে? কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলী জিন্নাকে মুখের উপর এই বদরুদ্দোজা বা বদু মিঞা বলেছিলেন , আপনি পাকিস্তান নিয়ে চলে যাচ্ছেন যান, কিন্তু আমি বা আমরা ভারতেই থাকব।মরন-বাঁচন যা হবে তা এই পবিত্র ভারতেই।কিন্তু কথাটা দু:খের হলেও সত্যি যে, ১৯৬৪ সালে তখনকার উদ্দেশ্যপ্রোণোদিত দাঙ্গার সময়ই বদু মিঞা তার সন্তানদের আটকাতে পারেননি। ১৯৬৪ সালেই দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতা পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দা। তাকে গাড়িতে নিয়ে কলকাতার সংখ্যালঘু এলাকায়ও ঘুরিয়েছিলেন।মুখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গুলজারিলালের।দিল্লি গিয়ে গুলজারিলাল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দাঙ্গা থামান।সংসদে অথবা বঙ্গীয় বিধানসভা যেখানেই তিনি ভাষণ দিতেন সব দলের সদস্যরা নোট নিতেন।নেহেরু থেকে ইন্দিরা সকলেই তাকে সমীহ করতেন। কিন্তু কে এই বদরুদ্দোজা?আজ তো তিনি নব প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত প্রায়। আসুন , তাঁকে নিয়ে একটু চর্চা করি।

স্কুলের সনদ থেকে জানা যায় , সৈয়দ বদরুদ্দোজা মুর্শিদাবাদের সালার থানার(অবিভক্ত ভরতপুর থানা, ১৯৮৫ সালে ভরতপুর থানা ভেঙে সালার থানার জন্ম হয়) তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০০ সালের ৪ জানুয়ারি।তার এই জন্মসাল ও তারিখ নিয়ে ভিন্ন মতও রয়েছে। অনেকে এও বলেন যে, তাদের আসল বাড়ি ভরতপুর থানার সৈয়দকুলুট গ্রাম। তাদের সৈয়দ পরিবারকে নিয়েই গ্রামের নাম সৈয়দকুলুট।পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল গোফুর।মাতার নাম সৈয়দা জহুরা খাতুন।স্ত্রীর নাম সৈয়দা রোকেয়া বদরুদ্দোজা ।গ্রামের খারিজি মাদ্রাসা, কাগ্রাম স্কুল ও তালিবপুর হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ, রিপন কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তার উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রভূমি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন তিনি।পেশা হিসাবে তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত এন্টালি মার্কেটের সুপারিনটেনডেন্ট।বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র সমিতির সভাপতি।খিলাফত আন্দোলনে যোগদান।দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শরৎ বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, প্রমুখদের সংস্পর্শে এসে তিনি পূর্ণ সময়ের জন্য রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তীতে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগ দেন।১৯৪৩-৪৪ সালে কলকাতার মেয়র হন।১৯৪০-৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতার বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন।১৯৪৬-৪৭ বঙ্গীয় বিধান পরিষদের সদস্য হন। তারপর দেশভাগ। ১৯৪৮-৫২ পর্যন্ত তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের রানীনগরের বিধায়ক।তার দলের নাম ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টি।পরে ঐ বিধানসভার সদস্য ছিলেন ১৯৫৭-৬২ সাল পর্যন্ত ।১৯৬২-৬৭ এবং ১৯৬৭-৭০ পর্যন্ত তিনি মুর্শিদাবাদ লোকসভার সাংসদ হন।

(২) সৈয়দ বদরুদ্দোজার রাজনৈতিক জীবনের বড় ঘটনা হল ১৯৪৩ সালের বাংলার বিশাল দুর্ভিক্ষ।এটাকে বাংলা সন অনুসারে বলা হয় “পঞ্চাশের আকাল” । এই দূর্ভিক্ষে বা আকালে অনাহার ও অর্ধাহারে অবিভক্ত বাংলার ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে।সৈয়দ বদরুদ্দোজা এই দূর্ভিক্ষের কারণ হিসাবে ব্রিটিশ সরকারকেই দায়ি করেন। তিনি বাংলার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেন।এর জন্য বদরুদ্দোজাকে বাংলার জেলাগুলিতে সফর করতে হয়। এই দূর্ভিক্ষ নিয়ে নাটক,কাব্য ও সিনেমা হয়েছে।বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক টি কে দত্ত তাঁর ” হাঙরি বেঙ্গল” তথ্যচিত্রে বলেছেন,” কলকাতার মেয়র সৈয়দ বদরুদ্দোজা সাংবাদিকদের বলেছেন,গ্রামবাংলার দূর্ভিক্ষের করাল ছায়া তিনি নিজের চোখে দেখেছেন, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামের চিত্রটা খুব ভয়াবহ।অথচ ব্রিটিশ সরকারের কোনো‌ হেলদোল নেই।”

বদরুদ্দোজা মনে করতেন এই দূর্ভিক্ষ ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা।কলকাতার তালতলা এলাকার ১৯ নম্বর আব্দুল হালিম লেনে(সাবেক ইউরোপীয় এসাইলেম লেন) থেকে সব কিছু পর্যবেক্ষন করতেন।প্রয়োজনে জেলায় জেলায় সফর করতেন। এইভাবে তিনি ” পঞ্চাশের আকাল “মোকাবিলা করেন।

বদরুদ্দোজার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে।১৯৪৫ সালে ব্রিটিশ সরকার দেশদ্রোহীতার অভিযোগে প্রিভেনশন অব ডিটেকশন অ্যাক্টের তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মামলার শুনানির সময় আদালতের বিচারক তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে বলেন।তিনি তখন দাঁড়িয়ে মধুর কন্ঠে যুক্তিপূর্ন বক্তব্য পেশ করেন টানা তিন ঘন্টা। বিচারক তাঁর বক্তব্যগুলো শুনে বলেই ফেললেন, আপনি এখন মুক্ত। ১৯৭৩ সালে নেতাজীর অগ্রজ শরৎ বসুর মৃত্যুতে কলকাতার নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোতে আয়োজিত স্মরণসভায় যে ভাষণ দেন তাতে অভিভূত হয়ে যান বিশিষ্ট সাংবাদিক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়।

কলকাতার এক ধর্ম সভায় সভাপতিত্ব করছেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রমন।রমনজী তাকে ছোট করে ভাষণ দিতে বলেন।কিছুটা বক্তব্য্ শুনে রমনজী তাকে বলেন, বলুন বলুন।দুঘন্টা বক্তব্য বলেন।ভারতীয় সংসদে নেহেরুজীর প্রয়াণে যে শোকসভা হয়েছিল তাতে বদু মিঞার বক্তব্যে সকলেই চোখের জল ফেলেন।নেতাজীর সঙ্গেও বদু মিঞার ভালো সম্পর্ক ছিল।১৯৪০ সাালে ডালহৌসী থেকে মনুমেন্ট স্হানান্তর‌ নিয়ে সুভাষচন্দ্রকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করলে বদু মিঞা বিশাল সমাবেশ করে।ব্রিটিশ সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, আন্দোলনের চাপে।

১৯৪৬ সালের দাঙ্গার জন্য কংগ্রেস ও মুসলীম লীগ উভয়কেই দায়ি করেন বদু মিঞা।দেশভাগের পরও এদেশীয় সরকারও তাকে নজরদারি করে। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার ক্ষেত্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একথা আজো বামেরা স্বীকার করেন। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় তিনি তাঁর সন্তানদের ধরে রাখতে পারেননি।তিনি ছিলেন ১০ সন্তানের পিতা।৬ মেয়ে ও ৪ ছেলে।এরা হলেন যথাক্রমে সৈয়দা সাকিনা ইসলাম,সৈয়দ মহম্মদ আলী,সৈয়দা সালমা রহমান,সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ,সৈয়দ হায়দার আলী,সৈয়দা আয়েশা কাদের,সৈয়দ আশরাফ আলী,সৈয়দা ফাতেমা ইসলাম, সৈয়দ রেজা আলী ও সৈয়দা জাকিয়া আহসান। সৈয়দা রাজিয়া ফয়েজ ও সৈয়দা জাকিয়া আহসান জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে মন্ত্রী হন।

ভারতীয়দের উপমহাদেশে শোষিত-নিপীড়িত-মজলুম মানুষের একটি কন্ঠ ছিলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা।১৯৭৪ সালের ১৮ নভেম্ভর তাঁর জীবনাবসান আয়।কিন্তু তাঁর ইতিহাস যেন আজ মৃতপ্রায়।এইরকম একজন মুক্তমনা ব্যক্তিত্ব আজ বিস্মৃত প্রায়। তাকে বলা হোত ” Nightingale of Cordoba”.


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ