অন্যান্য বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

আত্মধ্বংসের ইদিপাস না রবীন্দ্রনাথের গোরা?

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

 অশোক ভট্টাচার্য রাজা :  জন্মেছিলো ইউরোপীয় মায়ের গর্ভে, হয়ে পড়েছিলো গোঁড়া হিন্দু, তারপর ‘মানুষ’ শেষ পর্যন্ত হলো শান্ত সমাহিত ভারতীয়… একই জন্মে জন্মান্তরের এই ধারাবাহিকতাই ছিলো রবীন্দ্রনাথের গোরা’র জার্নি।

এই যে ক্রমত্তোরণ, তা প্রতি মুহূর্তের দ্বান্দ্বিক সমগ্রতার মাঝে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার মধ্যে দিয়েই রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ কে সংকীর্ণতার আতুর ঘর থেকে মহামানবের সাগর তীরে এনে উপস্থিত করেছিলো।

Advertisement

এই ঘাত-প্রতিঘাত কি রবীন্দ্রনাথকেও আলোড়িত করেনি? না হলে ‘গোরা’ লিখে চলেছেন যখন( ১৯০৭-১৯১০) তখন ঘটে গ্যালো আর এক ঘটনা। গীতালি -গীতাঞ্জলি -গীতিমাল্য পর্বে রবীন্দ্রনাথ ‘আমি -তুমি’র লীলা খেলায় আত্মনিবেদনে ব্যস্ত ছিলেন, এমন একটা ব্যাখ্যা সিলেবাসের অধ্যাপক-মার্কা নোটে ঘুরে বেড়ালেও, আদপে তা সর্বাংশে সত্যি নয়।

ভূমি থেকে ভূমা, কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রাতিগ এক অবাধ পদচারণায় রবীন্দ্রনাথ অভ্যস্ত ছিলেন। তাই তো ‘গীতাঞ্জলি’ র শান্ত-সমাহিত আত্মনিবেদন পর্বেও ক্ষত-বিক্ষত ছিলেন কবি।

একদিকে মহাকাব্যসম ‘গোরা’ উপন্যাস লিখে চলেছেন অন্যদিকে ‘গীতাঞ্জলি’। সেখানেই ঘটলো এই অদ্ভুত ঘটনা। ‘গোরা’ র নিজেকে খুঁজে পাওয়ার উপলব্ধি প্রকটভাবে ছাপ ফেললো ‘গীতাঞ্জলি’ তেও। ১৮, ১৯, ২০ আষাঢ় ‘১৩১৭ বঙ্গাব্দে পরপর তিনদিন রবীন্দ্রনাথ যথাক্রমে লিখলেন ‘গীতাঞ্জলি’র কালজয়ী তিনটি কবিতা.. ১)’ভারত তীর্থ’ ২) ‘দীনের সঙ্গী’ এবং ৩) ‘অপমানিত ‘। এর সাতদিন বাদে ২৭ আষাঢ় ‘১৩১৭ তে লিখলেন ‘সাধনা’ শীর্ষক কবিতা…
“ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।”

‘ভারততীর্থ’ কবিতায় লিখলেন…
“কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা..” –এই স্রোতেই তো ‘গোরা’ ও এসে পড়েছিলো ভারতের মাটিতে।

‘গোরা’ র আত্মপরিচয় উদঘাটনের সঙ্গে ‘ইদিপাস’ -এর কাহিনির ভাবগত মিল আছে। কিন্তু পার্থক্যও আছে। আত্মপরিচয়ের সামনাসামনি হয়ে ইদিপাস ধ্বংসের পথে চলে গিয়েছিলো; কিন্তু ‘গোরা’ হয়ে উঠলো বিশ্বমানব, যে
“হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে
নমি নরদেবতারে” –বলে ভারতবর্ষের মূল আত্মাকে আত্মস্থ করেছিলো। ‘গোরা’র পালিতা মা ‘আনন্দময়ী’ই কি সেই আবহমান ভারতবর্ষ নন? যে ভারতবর্ষ সকলকে সন্তান স্নেহে আপন করে নিয়েছে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে।

এতক্ষণের গৌরচন্দ্রিকার মূল কথা একটাই, ইতিহাস ও সভ্যতার ঘাত-প্রতিঘাতে আত্মপরিচয়ের গহন দরজা খুলে গেলে এদেশের বুকে হয়ত আমরা সবাই বুঝতে পারব…

“রণধারা বাহি,জয়গান গাহি
উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্ব্বত
যারা এসেছিলো সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে
কেহ নহে নহে দূর,
আমার শোণিতে রয়েছে ধ্বণিতে
তার বিচিত্র সুর।”

—তবে আত্মপরিচয়ের এই কঠিন বাস্তবের সামনে দাঁড়িয়ে ‘ইদিপাস’ -এর মতো আত্মধ্বংসের পথ বেছে নেব, না কি ‘গোরা’র মতো “সবার পরশে পবিত্র -করা তীর্থনীর’ ভারতবর্ষকে বুকে টেনে নিয়ে জন্ম দেব উর্বরা শস্যভূমির…তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।
#অশোক_ভট্টাচার্য_রাজা
১৫/০১/২০২০


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

eight + five =