কলকাতা 

এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবকদেরও : অনুসন্ধান আয়োজিত ‘ড্রপ আউট ও ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রমবর্ধমান অনুপস্থিতি’ নিয়ে আলোচনায় বললেন বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত

শেয়ার করুন

নিজস্ব প্রতিবেদন : প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে অনুসন্ধান সোসাইটি আয়োজন করেছে একমাস ব্যাপী পাঁচ পর্বের আলোচনাচক্র। ‘ড্রপ-আউট ও ছাত্র-ছাত্রীদের ক্রমবর্ধমান অনুপস্থিতি’ নিয়ে আলোচনা ছিল রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) চতুর্থ পর্বের আলোচনার মুখ্য বিষয়বস্তু।

আলোচনার সূত্রপাত করে বিশিষ্ট শিক্ষা প্রশাসক ও বিশেষজ্ঞ মেচবাহার সেখ বলেন, মূলত তিনটি কারণে স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপস্থিতির হার বাড়ছে এবং ধীরে ধীরে তা ড্রপআউটে পরিণত হচ্ছে। অভিভাবকরা ভাবছেন, স্কুল ক্রমশ: উৎকর্ষ শিক্ষার পরিবেশ হারাচ্ছে, সরকারি স্কুলে পঠন-পাঠন ব্যয়বহুল নয়–এ কথা ঠিক, কিন্তু এমন এক আবহ তৈরি হয়েছে, যে মনে হচ্ছে প্রাইভেট টিউশন ছাড়া শিক্ষাই অসম্ভব। আমাদের ঘরের প্রায় একশো শতাংশ সন্তান আজ টিউশন-নির্ভর, দুঃখের হলেও সত্যি, স্কুল আজ ওদের কাছে গুরুত্বহীন। অভিভাবকেরা ভাবছেন, এত করেও শিক্ষার্জনের পর কর্মসংস্থানের সুযোগ কোথায়! তাহলে কি হবে লেখাপড়া শিখে!

Advertisement

এদিনের মুখ্য আলোচক বিশিষ্ট শিক্ষক ও গবেষক বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত বলেন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তার যে বাস্তবতা নেই এমন কথা বলা যাবে না। শিক্ষা মানচিত্রে বিভিন্ন আঙ্গিকে দ্রুত পতন ঘটছে আমাদের। উচ্চ শিক্ষায় ছেলেদের এনরোলমেন্ট রাষ্ট্রীয় স্তরে প্রায় সাতাশ শতাংশ, সেখানে আমাদের রাজ্যে কুড়ি শতাংশেরও কম। ছেলেদের এই পিছিয়ে যাওয়ার কারণ কী? অনেকে বলছেন রোজগারের চেষ্টা করছে ছেলেরা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, কেরালার মতো উন্নয়নশীল রাজ্যের ছেলেরা তো তা করছে না! ওরা তো পড়াশোনা করতে চাইছে। শুধু উচ্চশিক্ষায় নয়, মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও ছেলে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এরা ছোটো ছোটো কাজকর্মে জুড়ে যাচ্ছে। এমনটাও নয় যে, সে মোটা মাইনে পাচ্ছে বা সেখানে চাকুরীর নিরাপত্তা আছে। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ পেয়েছে, জেপটো, জোম্যাটো-এর মতো কোম্পানি গত এক বছরে আমাদের এখানে ৩৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। সাইকেলে ও মোটরসাইকেলে পণ্য বাহকের এই কাজে আমাদের রাজ্যের মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ড্রপ আউট ছাত্ররা কাজে লেগে পড়ছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের একশো শতাংশ স্কুলে ভর্তি হয়, কিন্তু দশ বছরের মধ্যেই সেই হার নেমে আসে কত নিচে। আমাদের রাজ্যে ৫৪.৪% যেখানে দেশের হার ৭০% অনেকেই বলেন দারিদ্র্যই–এর মূল কারণ। কিন্তু পড়াশোনায় তো এখন কোনো খরচ-ই নেই। তাহলে? টিউশন-সংস্কৃতি আমাদের রাজ্যে আগ্রাসী ভূমিকা ধারণ করেছে। কিন্তু কথা হল, এই অবস্থার জন্য দায় কার? দায় কি কেবলই টিউশন-টিচারদের? তাঁদের কাছে যাচ্ছেই বা কেন আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা? এসবেরও কিন্তু চিন্তা করার সময় এসে গিয়েছে।

শিক্ষা-গ্রাফের নিম্নগামীতা নিয়ে নানান কথোপকথন, চিন্তা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার থেকে বেশি প্রয়োজন এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যায় কীভাবে তার আলোচনা। বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত বলেন, এ ব্যাপারে এলাকাভিত্তিক ছোটো ছোটো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়। কাজের পূর্বে ক্ষেত্র সমীক্ষা করে, তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখে নিতে হবে সেখানকার শিক্ষা ও আর্থ সামাজিক অবস্থা। স্কুলে বাচ্চারা যাচ্ছে কিনা, গেলেও কতটা আনন্দের সঙ্গে যাচ্ছে কিংবা বাড়ির চাপে যাচ্ছে কিনা। কি পড়ানো হচ্ছে? কেমন ভাবে পড়ানো হচ্ছে ইত্যাদি ব্যাপারে নজর দেওয়ার জন্য অভিভাবকদের একটা দল গঠন করা যেতে পারে। এলাকার শিক্ষিত মানুষরা এগিয়ে এলে এই কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। প্রতি মাসে অভিভাবকরা সভা করে পড়াশুনার গতি-প্রকৃতি ও বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন। এ কাজে পঞ্চায়েত বা প্রশাসনিক স্তরে অনেকের সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে বলে মত ব্যক্ত করেন বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত। তবে এ ব্যাপারে সব থেকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে অভিভাবকদের। তাঁদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

এরপর বিশিষ্ট প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ ডঃ চন্দন মিশ্র ড্রপ-আউটের এই সংকট থেকে উত্তরণ কী করে ঘটতে পারে সে বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেন, দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমাদেরকে নিজেদের অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। একজন শিক্ষককে কেবলমাত্র শিক্ষাদানের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে চলবে না, তাঁকে অভিভাবক হিসেবেও ভূমিকা নিতে হবে, কাউন্সেলিং করতে হবে। বিভিন্ন দিকের সেতু রক্ষার কাজ করতে হবে মূলত একজন শিক্ষককেই, তাহলেই আমরা এই চরম বিপদ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।

এদিন আলোচনাপর্বের শেষলগ্নে বিশিষ্ট শিক্ষা প্রশাসক আরফান আলী বিশ্বাস এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, আরও বিস্তারিত আলোচনা থেকে ফল পাওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, শিক্ষক যত দরদী হবেন ততই ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার বাড়বে। আর এর সাথে প্রয়োজন অভিভাবককে সঠিকভাবে সচেতন করে তোলা।

আলোচনা পর্বের শেষে অনুসন্ধান সোসাইটির মুখ্য পরামর্শদাতা অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, ড্রপ-আউট আমাদের সমাজে প্রাইমারি থেকে সর্বস্তরে এক মারণ ব্যাধির মতো বিস্তার করেছে। এর প্রতিকারে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

এদিন অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক নায়ীমুল হক। তিনি বলেন, এই আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব আগামী ২৯ ডিসেম্বর রবিবার অনুষ্ঠিত হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে সকলকে ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ