কিসসা কন্নড় কুরসি কা হাই ভোল্টেজ হাত, লো ভোল্টেজ পদ্ম
মুদাসসির নিয়াজ : এবার কর্ণাটক ছিল হাইভোল্টেজ। দাক্ষিণাত্যে একমাত্র এই রাজ্যেই ছিল বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার। ফল প্রকাশের পর দেখা গেল ডাবল নয়; ট্রাবল ইঞ্জিন সরকার ছিল ওখানে। অনেক আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, এবার বিজেপিকে খালি হাতে ফেরাবে কর্ণাটক। কারণ, গতবার জেডি (এস) ও কংগ্রেস জোট সরকারকে যেভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছিল, তা কন্নড়রা ভুলে যায়নি। এক পৌষে শীত পালায় না। এবার মোক্ষম জবাব দিল তারা। সুদে আসলে মাশুল গুণতে হল গেরুয়া শিবিরকে। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে জোট সরকার ভাঙিয়ে যে ১৪জন বিধায়ককে পকেটে পুরেছিল বিজেপি, এবার সেইসব দলবদলুরা সব গোহারা হয়েছে।
শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ কয়েকমাস আগেই নস্যাৎ করে মল্লিকার্জুন খাড়গেকে সর্বভারতীয় সভাপতির আসনে বসিয়েছিল কংগ্রেস। খাড়গে কর্ণাটকেরই ভূমিপুত্র। তাই এই নির্বাচন খাড়গে, গান্ধী পরিবার তথা কংগ্রেসের কাছে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল। বিজেপিকে লাল কার্ড দেখিয়ে এক ঢিলে তিন পাখি মেরে সেই অগ্নিপরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ কংগ্রেস। কর্ণাটক ছিল এবার বিজেপির অ্যাসিড টেস্ট এবং প্রেস্টিজ ইস্যু।
আর কয়েক মাস পরেই তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিধানসভা ভোট। সুতরাং কর্ণাটকে যেন তেন প্রকারে জিততে পারলে চার রাজ্যে হয়ত গেরুয়া শিবির কিছুটা মাইলেজ পেত। কিন্তু আপাতত সে গুড়ে বালি, ব্যাকফুটে বিজেপি। অগত্যা পরের বছর এপ্রিল নাগাদ লোকসভা নির্বাচনে হয়ত ঢাকি সমেত বিসর্জন হয়ে যাবে – এই আশঙ্কায় নিন্দ হারাম হয়ে যাচ্ছে মোদি-শাহ-নাড্ডাদের। বিজেপি নেতারা হয়ত এখন থুড়ি কেটে বলছেন, আনলাকি থারটিন। আব কী বার ১৩-র গেরোয় আর নয় বাখুরদার।
কর্ণাটকে কংগ্রেসের ঐতিহাসিক জয় এবং বিজেপির পরাজয়ের নেপথ্য রহস্য কী? যতদূর জানা যাচ্ছে, এবার কংগ্রেসের ভোটকুশলী হিসেবে কাজ করেন সুনীল কানুগোলু। একদা প্রশান্ত কিশোরের ভাবশিষ্য কানুগোলুর পরামর্শে ও রণকৌশলে কর্ণাটকে এককভাবে সরকার গড়তে সক্ষম হয়েছে কংগ্রেস। অর্থাৎ ভূমিধ্বস জয়ের নেপথ্য কারিগর হিসেবে উঠে এসেছেন সুনীল কানুগোলু। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের চিফ ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট। তাঁরই সুনিপুন পরিকল্পনায় দক্ষিনী রাজ্যে ধরাশায়ী বিজেপি।
গত বছর মার্চে ভোটকুশলী হিসেবে তাঁকে নিযুক্ত করেছিল কংগ্রেস। পরে অবশ্য তিনি কংগ্রেস দলে যোগ দেন। সুনীলের টিমের সমীক্ষার উপর নির্ভর করেই টিকিট বিলি করেছিল কংগ্রেস। আর তাতেই বাজিমাত করল হাত শিবির, কুপোকাত হল পদ্ম শিবির।
বছর চল্লিশের সুনীলের অতীত রেকর্ড বেশ ঈর্ষনীয়। আদতে কর্ণাটকের বাসিন্দা হলেও তাঁর বেড়ে ওঠা চেন্নাইয়ে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রণকৌশল টিমে ছিলেন। ২০১৭ সালে তাঁর পরিকল্পনায় উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসেন যোগী আদিত্যনাথ। তামিলনাড়ুতে ভোটকুশলী হিসেবে ডিএমকে এবং এআইএডিএমকের হয়েও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে কানুগোলুর। পাঞ্জাব অকালি দলের হয়েও কাজ করেছেন। এছাড়াও উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাত ভোটেও গেরুয়া শিবিরের ভোটকুশলী হিসেবে ছিলেন কানুগোলু।
কর্ণাটকে পদ্মশিবিরকে সাফ করতে এই কানুগোলুর উপর অনেকখানি নির্ভরশীল হয় কংগ্রেস। বিজেপিকে হটাতে দিনরাত কাজ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, দলের অন্তর্দ্বন্দ্বকেও অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সামলেছেন কানুগোলু। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ডি.কে শিবকুমারের মতো দুই বর্ষীয়ান নেতার অন্তর্দ্বন্দ্ব চিন্তায় ফেলেছিল কংগ্রেস হাইকমান্ড মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং রাহুল সোনিয়াকে। তবে কোনও রকম বিবাদ ছাড়াই সুকৌশলে অত্যন্ত দক্ষ হাতে সবকিছু সামলেছেন কানুগোলু। উল্লেখ্য, সম্প্রতি রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রার পরিকল্পনাও ছিল তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত।
কানুগোলু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন বলে কংগ্রেস ব্রিগেডের আশা। সেই হিসেবে তার আপাতত পাখির চোখ তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড় রাজ্য।
উন্নয়নের বার্তা নিয়ে ডাবল ইঞ্জিল চালু হলেও তা শেষপর্যন্ত গিয়ে পৌঁছয় হিন্দুত্বে। সুতরাং বিজেপির কর্ণাটকী রেল বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল। হিজাব ইস্যুতে বিজেপি তোলপাড় করেছিল গোটা রাজ্যকে। কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে বজরং দলকে নিষিদ্ধ করবে বলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণকে হাতিয়ার করে হিন্দুত্বের পালে হাওয়া তোলার জোরালো চেষ্টা করেছিল এবং সেই হাওয়ায় এবার বৈতরণী পেরনোর স্বপ্ন দেখেছিল গেরুয়া শিবর। কিন্তু মানুষ তা নেয়নি। হিজাব ব্যান করার প্রধান পুরোহিত বিজেপির শিক্ষামন্ত্রী হেরে ভূত হয়েছেন।
হিজাব ছাড়াও বিজেপির হাডকোর এজেন্ডায় ছিল হালালা, আযান নিষিদ্ধের পক্ষে সওয়াল, শিক্ষা ও চাকরীতে সংখ্যালঘু কোটা বা সংরক্ষণ বাতিল করা, টিপু সুলতানের জন্মদিনকে নিয়ে বিতর্ক ইত্যাদি সব স্পর্শকাতর ইস্যু। কিন্তু আপসোস, মেরুকরণের কোনও প্রসেক্রিপশনই কাজে এল না। বরং কংগ্রেসের মরা গাংয়ে জোয়ার আনল রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা। মানুষের রুটি-রুজির ইস্যু তুলে ধরে বাজি জিতল কংগ্রেস।
কিন্তু কেন এমন পরাজয় বাসবরাজ বোম্বাই সরকারের? আসলে ভোটের আগেই হেরে বসেছিল বিজেপি। কর্নাটকে বিজেপির হারের পেছনে হরেক কিসিমের ফ্যাক্টর রয়েছে। সেগুলো হল:
দেশের যে প্রান্তেই ভোট হোক না কেন, মোদী-শাহই শেষ কথা। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনেও রাজ্যে মমতা ব্যানার্জী সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারে কার্পেট বম্বিং করেছিলেন বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতারা। তাতেও কোনও ফল হয়নি।
কর্ণাটকেও প্রচারের সব আলো একাই কেড়ে নিয়েছিলেন মোদী। তাঁর উপরেই সবথেকে বেশি নির্ভর করেছিল প্রদেশ বিজেপি। রাজ্য নেতারা সেখানে খুব বেশি কল্কে পাননি। মোদী নিজের ক্যারিশমা ও কেন্দ্রের প্রকল্পগুলোর কথাই বেশি প্রচার করেন। রাজ্যের ইস্যু চলে যায় ব্যাকফুটে। অর্থাৎ ভোটারদের দেওয়াললিখন পড়তে ব্যর্থ হয়েছে বিজেপি। তাই রাজ্যবাসীও বুঝে উঠতে পারেনি যে, এটা বিধানসভা নাকি লোকসভা ভোট?
এবার রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ হিসেবে সেভাবে কাউকে তুলে ধরতে পারেনি বিজেপি। রাজ্যে সবথেকে জনপ্রিয় ছিলেন ইয়েদুরাপ্পা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ। তাই তাকে একসময় বিতাড়িত করা হয়। এরপর মুখ্যমন্ত্রী হন সদানন্দ গৌড়া। তারপর জগদীশ সেটটার, অবশেষে বোম্বাই। কিন্তু কারো রেকর্ড ভালো হয়নি। সবাই দুর্নীতির সাগরে অবগাহন করে আকন্ঠ নিমজ্জিত হোন। তাই শেষমেষ মোদীর প্রচারে উড়িয়ে আনা হয় ইয়েদুরাপ্পাকে।
কিন্তু এতদিন ইয়েদুরাপ্পাকে দূরে সরিয়ে রাখায় তার সম্প্রদায় লিঙ্গায়েতরা বিজেপি-বিমুখ হয়ে যায়। তাছাড়া বিজেপির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার পরিস্থিতি আঁচ করে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিলে বিজেপির সামনে আর কোনও উল্লেখযোগ্য নেতাই ছিল না। ফলে কংগ্রেসে যেমন নেতার আধিক্য দেখা যায়, বিজেপিতে তেমনি নেতার অভাব প্রকট হয়।
কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে ছিলেন সিদ্ধারামাইয়া, ডিকে শিবকুমার, মল্লিকার্জুন খাড়গে, কেসি বেনুগোপাল প্রমুখ। এই সুযোগে অন্যদিকে, কংগ্রেস ওবিসি, দলিত ও মুসলিমদের ভোট ঘরে তুলেছে। জাফরান শিবিরের হারের আরও একটা কারণ হল, দুর্নীতির দায় ঝেড়ে ফেলতে বিজেপি এবার অনেক পরিচিতকে বাদ দিয়ে প্রার্থী তালিকায় ৭২জন নতুন মুখ আনে।
সর্বোপরি খুলে আম মুসলিম বিদ্বেষ ও কট্টর হিন্দুত্বর ফেরি করা দক্ষিণের এই শিক্ষিত মানুষ মানতে পারেনি। আর রাজ্য নেতাদেরকে একরকম বয়কট করে নিজেকে মসীহা হিসেবে তুলে ধরে মোদীর সাওদাগর সাজাকে পছন্দ হয়নি ভোটারদের। অগত্যা কর্ণাটকে বিজেপির ঝাঁপ বন্ধ হল। দাক্ষিনাত্যের সবেধন নীলমণিতেও নাড্ডাদের নোটে গাছটি মুড়োলো। কেরলের স্টোরি দিয়ে কর্ণাটকের চিঁড়ে ভিজলো না।।