কলকাতা 

২০১৬ নিয়োগ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের তোপের মুখে এসএসসি, নিয়োগ প্রক্রিয়া বিশবাঁও জলে

শেয়ার করুন

বাংলার জনরব ডেস্ক : বহু টানাপোড়েনের পর নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আর তার পরই নতুন করে জটিলতা তৈরি হল। নতুন চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে নতুন বিধিতে পরীক্ষা নেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টে প্রশ্নের মুখে পড়ল স্কুল সার্ভিস কমিশন। আদালতের রায়ে যাঁরা চাকরিহারা হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কেন নতুনদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হল, কেন নতুন বিধি তৈরি করে পরীক্ষা নেওয়া হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলল দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত মামলা কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত। শিক্ষক-অশিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রশ্ন তুলে যে ৪৪টি আবেদন জমা পড়েছিল, সেগুলিকে কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আর সেই সঙ্গেই আজ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে আদালত। আদালত জানায়, আগের রায়ে বলা হয়েছিল, ২০১৬ সালের গোটা প্যানেল বাতিল। দাগি নন যাঁরা, তাঁদের জন্য নতুন করে প্রক্রিয়া সংঘটিত করতে হবে। এদিন আদালত বলে, ওই রায়ে কোথাও বলা হয়নি যে, চাকরিহারাদের নিয়ে সংঘটিত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নতুন চাকরিপ্রার্থীরা অংশ নিতে পারবেন। নতুন করে বিধি তৈরি হবে এবং সেই মতো কাজ হবে বলে নির্দেশনামায় কোথায় ছিল না বলে জানান বিচারপতি সঞ্জয়কুমার। (SSC Recruitment Case)

Advertisement

SSC-কে ভর্ৎসনা করে বিচারপতি সঞ্জয়কুমার বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল, যাঁরা চিহ্নিত অযোগ্য ছিলেন না, যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন,তাঁদের চাকরির সুযোগ দেওয়া। তার জন্য নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংঘটিত করা। এই যে নতুন করে শূন্যপদ তৈরি করা হল, নতুন প্রার্থীরা যাঁরা নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অংশ নিলেন, এই সিদ্ধান্ত SSC নিয়েছে। আদালত এমন নির্দেশ দেয়নি।”

এর আগে, SSC-র তরফে যখন নতুন বিধি আনা হয়, সেই সময় ২০১৬ সালের প্রার্থীরা একাধিক বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাঁরা জানান, নতুন বিধিতে একাধিক অসঙ্গতি রয়েছে। আগে ৪৫ শতাংশ পেলেই হতো, নতুন বিধিতে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫৫ শতাংশ। ফলে বৈষম্য তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। এদিন আদালতও বলে, যাঁরা ২০১৬ সালে পরীক্ষা দিয়েছিলেন, যাঁরা আদালতের নির্দেশে নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নতুন বিধি প্রযোজ্য নয়। আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, ২০১৬ সালের প্রার্থীদের উপর নতুন বিধি চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাঁরা যদি কোনও ভাবে বঞ্চিত হন, তা আদালতের রায়ের উদ্দেশ্য ছিল না। আদালত জানিয়েছে, মূল মামলার রায়ে কোথাও বলা ছিল না নতুন প্রার্থীদের নিয়োগ করতে হবে, নতুন বিধি আনতে হবে। নতুন বিধি প্রয়োগের কথা বলা হয়নি মূল রায়ে। এই যে বার বার অভিযোগ হচ্ছে, মামলা দায়ের হচ্ছে, এর জন্য SSC-কেই দায়ী করেছে আদালত।

SSC-র উদ্দেশে এদিন আদালত বলে, “রায়ে বলেছিলাম নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া করতে হবে। বলিনি যে নতুন শূন্যপদ তৈরি করে নতুনদের নিয়ে আসুন। নতুন শূন্যপদ করে নতুন প্রার্থীদের আনতে বলিনি, ওটা আপনারা করেছেন। আপনারা নতুন বিধি নিয়ে এসেছেন, নতুন শূন্যপদ তৈরি করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদ্দেশ্য ছিল যোগ্য প্রার্থীদের জন্য নতুন করে নিয়োগ। আদালতের রায়ে চাকরিহারাদের সুযোগ দিতে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংঘটিত করতে বলা হয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনারা নতুন বিধি করে পরীক্ষা নেবেন।”

SSC-র নবম ও দশম এবং একাদশ ও দ্বাদশের ফলাফল সামনে আসার পরই একাধিক মামলা দায়ের হয় কলকাতা হাইকোর্টে। সেই সময় কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অমৃতা সিনহা জানিয়েছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট যা বলবে, সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি। আজ সর্বোচ্চ আদালত প্রত্যেকটি মামলাই কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠিয়েছে। বিচারপতি অমৃতা সিনহার এজলাসেই মামলাগুলির শুনানি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

নতুন বিধি অনুযায়ী একাদশ-দ্বাদশে ১২ হাজার ৪৪৫ এবং নবম-দশমে ২৩ হাজার ২১২ শূন্যপদে নিয়োগের কথা জানানো হয়। চাকরিহারাদের সঙ্গে নতুন চাকরিপ্রার্থীরাও পরীক্ষা বসেন। চাকরিহারাদের জন্য বরাদ্দ করা হয় বাড়তি ১০ নম্বর। কিন্তু এদিন আদালত প্রশ্ন তুলেছে, চাকরিহারা শিক্ষকদের সঙ্গে নতুনদের পরীক্ষা নেওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে আদালত। ফলে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়ে গেলেও, ইন্টারভিউ শুরু হলেও, নতুন করে নিয়োগ নিয়ে জটিলতা বাড়ল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া ফের সঙ্কটে পড়ল।

আজ সুপ্রিম কোর্টে SSC-র নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে পড়েছে। আদালত স্পষ্ট জানিয়েছে, ২০১৬ সালে যাঁরা চাকরিপ্রার্থী ছিলেন এবং তাঁর মধ্যে যোগ্য চাকরিহারা, যাঁরা আবেদন করেছেন, অর্থাৎ ২০১৬ সালের SSC পরীক্ষায় যাঁরা নির্দিষ্ট ভাবে দাগি নন, তাঁদের জন্য় নতুন করে পুরনো বিধি অনুযায়ী পরীক্ষা সম্পন্ন করতে বলা হয়েছিল। তার পরিবর্তে SSC শূন্যপদ বাড়িয়ে নতুনদের সুযোগ করে দিয়েছে। নতুন বিধি তৈরি করেছে SSC, যাতে শিক্ষাগত যোগ্যতার নম্বর কমানো হয়েছে, অভিজ্ঞতার জন্য যোগ করা হয়েছে বাড়তি ১০ নম্বর, নতুন চাকরিপ্রার্থীদের সংযুক্ত করা হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। এই নির্দেশ দেয়নি সুপ্রিম কোর্ট। আদালতে নির্দেশে বলা হয়েছিল, শুধুমাত্র বঞ্চিত হয়েছেন যাঁরা, ২০১৬-র যোগ্য চাকরিপ্রার্থী যাঁরা, তাঁদের জন্যই নতুন করে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর দায়িত্ব তাই SSC-কেই নিতে হবে। কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট মিলিয়ে ৪৪টি মামলা হয়েছে এই নতুন বিধি ও নিয়োগ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে। অভিজ্ঞতার নিরিখে বাড়তি ১০ নম্বর দেওয়া নিয়ে, অ্যাকাডেমিকসের নম্বর কমানো, ২০১৬-র পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে নতুনদের যুক্ত করা নিয়ে, শূন্যপদ বাড়ানো নিয়েও মামলা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, এটা করতে বলেনি তারা। শুধুমাত্র ২০১৬ সালের যে যোগ্যরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে বলা হয়। SSC নিজেদের মতো করেছে, আদালতের রায় মেনে চলেনি, ফলে দায় নিতে হবে তাদেরই।

এই সংংক্রান্ত সব মামলা কলকাতা হাইকোর্টে ফেরত পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কলকাতা হাইকোর্টই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থাৎ শিক্ষক নিয়োগের ভবিষ্যৎ ফের কলকাতা হাইকোর্টের হাতে চলে গেল। ইতিমধ্যেই বিচারপতি অমৃতা সিংহের কাছে মামলা জমা পড়েছে। বিচারপতি অমৃতা জিনহা আগের দিনই জানান, দাগি প্রার্থীদের নাম-পরিচয় বিস্তারিত বিবরণ-সহ প্রকাশ করতে হবে। আজ একই নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টও। দাগিদের সমস্ত বিবরণ প্রকাশ করতে বলা হয়েছে।

আদালতের এই রায়ের পর আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেন, “টেন্টেড প্রার্থীরা নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে না, তাদের চাকরি দেওয়া যেতে পারে না। SSC-র গোড়া থেকেই উদ্দেশ্য ছিল, তাদের চাকরি দেওয়ার। আর বাড়তি ১০ নম্বর দেওয়া-সহ বাকি ইস্যু কলকাতা হাইকোর্ট শুনবে। আদালতের পর্যবেক্ষণ পরিষ্কার, আসলে নতুন শূন্যপদ তৈরি করে SSC জটিলতা তৈরি করেছে। আদালত কোথাও নতুন শূন্যপদ, নতুন বিধি আনার কথা বলেনি।”

আদালতের এই রায়ের পর চাকরিহারা শিক্ষক সুমন বিশ্বাস বলেন, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে পরিষ্কার বলতে চাই, ২০১৬-র প্যানেলের একজন যোগ্য শিক্ষককেও যদি বঞ্চিত করা হয়, এই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করব আমরা। মামলার যে এই করুণ পরিস্থিতি, তার জন্য একমাত্র দায়ী রাজ্যের সরকার, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। ২৮ নভেম্বর পরবর্তী শুনানি কলকাতা হাইকোর্টে। আমি সুমন বিশ্বাস সেই মামলায় ইন পার্সন হিসেবে দাঁড়াব। চাকরিহারাদের সকলকে আবেদন, আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকব। নিয়োগ দিতে হবে। চাকরিচুরির ক্ষত মেটানোর জন্য ২০১৬-র প্যানেলের পৃথক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।”

আদালতের বক্তব্য একনজরে-

আমরা আমাদের রায়ে বলেছিলাম যে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সংগঠিত করতে হবে। আমরা আপনাদের বলিনি যে নতুন শূন্যপদ তৈরি করে নতুন প্রার্থীদের নিয়ে আসুন। ওটা আপনারা করেছেন। আপনারা নতুন বিধি নিয়ে এসেছেন, আপনারা নতুন শূন্যপদ তৈরি করেছেন। – এসএসসি কে উদ্দেশ করে মন্তব্য বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের উদ্দেশ্য ছিল Un-tainted প্রার্থীদের জন্য নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া সংগঠিত করা। – মন্তব্য বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের।

আদালতের রায়ে এদের চাকরি বাতিল হয়েছে। নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে, তারা আবার সুযোগ পাবেন।কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনারা তাদের ক্ষেত্রে নতুন বিধি প্রযোজ্য হবে। – মন্তব্য বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ