“..গাছ কাটা হলে শোক সভা হবে বিধানসভায়” কবীর সুমনের গানের পঙক্তি ধরে অনুসন্ধানের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অনলাইন আলাপচারিতায় আরো একবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা
নায়ীমুল হকের প্রতিবেদন: বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গতকাল ৫ জুন বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন ভাবে পালিত হয় ছোট-বড় নানা ধরনের অনুষ্ঠান। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে পালিত হয় এই দিনটি। প্রতি বছরই রাখা হয় মূল থিম হিসেবে আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য বিষয়। এ বছরের থিম ছিল ‘ওনলি ওয়ান আর্থ বা ‘শুধু একটাই পৃথিবী’।
নানা অনুষ্ঠানের মাঝে অনুসন্ধান কলকাতার উদ্যোগেও নেওয়া হয়েছিল দশ দিনব্যাপী বিশেষ এক কর্মসূচি। উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ সম্পর্কে প্রথমত আমাদের নিজেদেরকে, তারপর আমাদের প্রতিবেশীকে প্রকৃত অর্থেই সচেতন করে তোলা। দশ দিন ব্যাপী এই কর্মসূচিতে মূল লক্ষ্য ছিল বিশেষত আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের এবং আপামর ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখা কতটা জরুরি সেই ভাবনা জাগ্রত করা এবং সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের প্রতি যত্নবান না হলে আমাদের জীবনে কত রকম ভাবে বিশৃঙ্খলা নেমে আসতে পারে, সে সম্পর্কে সচেতন করা ছিল এই কর্মসূচির বৃহত্তর লক্ষ। এর জন্য প্রয়োজন নিজেদেরকে সংশোধন করে পরিবেশ বান্ধব একটা সমাজ গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে গোটা অনুষ্ঠানের মূল থিম একই সুরে বেঁধে দেয়া হয়েছিল, একটাই বিশ্ব, প্রকৃতির সাথে মৈত্রী তবেই সুস্থিত বসবাস। পরিবেশ দিবসের এই ব্যাপক পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, প্রকল্প বানাও প্রতিযোগিতা, পরিবেশ সংক্রান্ত ফটো তুলে কোলাজ করে তার শিরোনামসহ প্রতিবেদন লেখার প্রতিযোগিতা এবং ছোটদের জন্য ছিল বায়ু দূষণ নিয়ে অঙ্কন প্রতিযোগিতা। সারা রাজ্য থেকে বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়ারা অংশগ্রহণ করেছিল এই প্রতিযোগিতায়। প্রান্তিক অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ এবং আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
এসমস্ত প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ উৎসাহ দিতে গতকাল পরিবেশ দিবসের সন্ধ্যায় অনলাইনে আয়োজন করা হয়েছিল বিজয়ীদের জন্য বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপন এর অনুষ্ঠান। যেখানে নির্বাচিত প্রবন্ধ গুলি পাঠ করারও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল খুদে লেখকদের জন্য। এছাড়াও অনুষ্ঠানে ছিল বিশেষ আলাপচারিতা আর সঙ্গে ছিল পরিবেশ সম্বন্ধীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিবেশনের আকর্ষণীয় মেলবন্ধন।
এদিনের সান্ধ্য অনলাইন আয়োজনে খুদে পড়ুয়াদের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল সত্যিই দেখার মতো। মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই অনুষ্ঠানে তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় যাতে ভাঁটা না পরে তাই উপস্থিত গুণী বক্তারা তাঁদের আলাপচারিতা সংক্ষিপ্ত করেন। এদিন আলাপচারিতার সূচনা হয় ভারত বিখ্যাত পক্ষী বিশারদ ডঃ টি কে রায়ের পরিশীলিত বক্তব্য দিয়ে। তিনি বলেন সময় এসেছে করে দেখানোর। শুধু কথা বললে চলবে না, যার যেখানে যেটুকু করণীয়, তা যেন আমরা করি। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের এই ছোট ছোট সংযোজন একদিন মহীরুহ হয়ে ফুটে উঠবে। তিনি খুদে প্রতিযোগীদের জন্য এই আয়োজনকে অসাধারণ এক উদ্যোগ বলে বর্ণনা করেন। তিনি সকলকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বলেন, বড়দের জন্য অনেক সেমিনার সিম্পোজিয়াম করা হয়, সেগুলোর প্রয়োজন আছে বটে, তবে সচরাচর নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এরকম সক্রিয় অংশগ্রহণ খুব একটা নজরে পড়ে না।
এদিন প্রারম্ভিক অধিবেশনে বিশিষ্ট লেখক ও প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক ডঃ শুভময় দাস তাঁর জোরালো বক্তব্যে বলেন, আজ কেবলমাত্র আমাদের জন্য আর ভাবলে চলবে না, ভাবতে হবে সন্তানের সন্তানদের জন্য। তিনি বলেন উন্নতির দাপটে বিভিন্নভাবে ধ্বংস হয়ে চলেছে সুন্দর এই বিশ্বব্যবস্থা। আমাদের নেই কোনো তাপ উত্তাপ, নেই কোনো সবল উচ্চারণ। বিদগ্ধ গায়ক কবীর সুমনের গানের পঙক্তি উচ্চারণ করে তিনি বলেন ‘আমি চাই গাছ কাটা হলে শোক সভা হবে বিধান সভায়/আমি চাই প্রতিবাদ হবে রক্ত পলাশে রক্ত জবায়।’ এদিন তার উদাত্ত আহ্বান ছিল মর্মস্পর্শী, আজ সুস্থিত উন্নয়নের জন্য আমাদের কিছু ত্যাগ এর প্রয়োজন। অতিমাত্রায় লোভ সংবরণ করতে হবে, ভোগবিলাস কিছুটা হলেও ত্যাগ করতেই হবে। পরিবেশের বাস্তুতন্ত্রে যেমন বৈচিত্র্য প্রয়োজন, তেমনি সমাজতন্ত্রে প্রয়োজন বৈচিত্র্য। এটাই তো আমাদের মন্ত্র,”নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান”।
এদিনের আলাপচারিতায় প্রধান বক্তা ছিলেন ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড অফ বায়ো ডাইভারসিটির অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডক্টর অশোক কান্তি সান্যাল। বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তিনি উপস্থিত থাকতে পেরে অত্যন্ত পুলকিত, সে কথা ব্যক্ত করেন তিনি বলেন এ ধরনের আয়োজন বিশ্বকে বাঁচাতে পারে। ছোটদের জন্য তিনি বিশ্ব পরিবেশ দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সহজভাবে তুলে ধরেন। এই দিনটিতেই জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্স শুরু হয়েছিল। এই কনফারেন্স হয়েছিল ১৯৭২-এর ৫ থেকে ১৬ জুন। এই কনফারেন্স ঐ বছরই চালু করেছিল জাতিসংঘের সাধারণ সভা। তখন থেকেই প্রতি বৎসর এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। দিবসটি প্রথম পালিত হয় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে।
এদিন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নাম ঘোষণার পর্ব ছিল উৎকণ্ঠায় ভরা। সকলেই অপেক্ষা করছিল এই মুহুর্তের জন্য। একে একে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সম্মানীয় বিচারকগণ নাম ঘোষণা করেন বিজয়ীদের।
প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার
বিষয় ছিল, প্রাত্যহিক জীবনে খাদ্য অপচয় বন্ধ করা ও বাতিল করা জামা কাপড়ের পুনর্ব্যবহার।
প্রথম হয় অনন্যা দোলুই (অষ্টম শ্রেণি), দ্বিতীয় সুমনা মন্ডল( সপ্তম শ্রেণি) এবং তৃতীয় হয় দীপ্তজিৎ কারক (নবম শ্রেণী)।
ফটোগ্রাফি কোলাজ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় সালকিয়া কে.বি.আর গার্লস হাই স্কুলের প্রতীক্ষা দাস (অষ্টম শ্রেণি) ও তিরনা গিরি (সপ্তম শ্রেণি),; দ্বিতীয় হয় বামনঘাটা হাইস্কুলের প্রার্থনা নস্কর (দশম শ্রেণি) এবং তৃতীয় স্থানটি দখল করে সালকিয়া কে.বি.আর গার্লস হাই স্কুল শর্মিষ্ঠা বসু (অষ্টম শ্রেণি), ।
প্রকল্প বানাও প্রতিযোগিতায় একমাত্র পুরস্কারটি জিতে নেয় সালকিয়া কে.বি.আর গার্লস হাই স্কুলের অদ্রিজা সাউ (দশম শ্রেণী)।
অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম হয় দক্ষিন চাতরা হাই স্কুলের সৌমাল্য দাস (ক্লাস ফাইভ) ; দ্বিতীয় হয় নবাব বাহাদুরস ইনস্টিটিউশনের জাহিরউদ্দিন চৌধুরী (ক্লাস ফাইভ) এবং তৃতীয় স্থান দখল করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রম শিশু বিদ্যা বিথীর, সমাদৃত দাস (ক্লাস ফোর)। এই প্রতিযোগিতাগুলির সামগ্রিকভাবে যাঁরা মুখ্য বিচারক ছিলেন, তাঁরা হলেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, আপ্পু পাল, মিতালী মুখার্জী, গৌরাঙ্গ সরখেল, প্রত্যুষ মুখার্জী, নাফিসা ইসমাত, সোহানা তাবাসসুম, ওয়াসেকা রহমান প্রমূখ।
এদিন সভাপতির বক্তব্যে বারাসাত মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং অনুসন্ধান কলকাতার সভাপতি শেখ আলী হাসান নিজের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন আমরা কিছুটা অনাবশ্যকভাবে কীভাবে আজ বিশ্ব উষ্ণায়নে সঙ্গী হয়েছি। একটু সংযমী জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে পরিবেশের নানা রকম বিশৃংখলা এবং ঝঞ্জা। এদিকে তিনি আন্তরিকভাবে দৃষ্টি দেওয়ার জন্য প্রথমে নিজেকে এবং পরে সকলকে আহ্বান জানান।
সবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে গিয়ে বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী অনুসন্ধান কলকাতার মুখ্য পরামর্শদাতা অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চল থেকে যেভাবে সাড়া পাওয়া গিয়েছে তাতে তিনি মুগ্ধ এবং অত্যন্ত আনন্দিত বলে জানান। তিনি সকলকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। এদিন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন আর্যা শীল, আফনান গাজী, অরিত্রি সাহু, সপ্তাশ্ব ঘোষ প্রমূখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় বিশিষ্ট ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা শীলের অনবদ্য ভূমিকা ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।