অন্যান্য জেলা 

রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০-তম জন্মবর্ষে সেজে উঠেছে হুগলির রাধানগরে রামমোহনের জন্মভিটে, তার সঙ্গে কলকাতার রামমোহন লাইব্রেরি সহ দিকে দিকে

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

নায়ীমুল হকের প্রতিবেদন: আগামী রবিবার ২২মে ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের সার্ধ দ্বিশতবর্ষ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা রামমোহনকে ভাবতেন একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে। তাঁর উদ্দেশে তিনি লিখেছিলেন,

Advertisement

“হে রামমোহন, আজি শতেক বর্ষ করি পার

মিলিল তোমার নামে দেশের সকল নমস্কার।

মৃত্যু অন্তরাল ভেদি দাও তব অন্তহীন দান

যাহা-কিছু জরাজীর্ণ তাহাতে জাগাও নব প্রাণ।

যাহা-কিছু মূঢ় তাহে চিত্তের পরশমণি তব

এনে দিক উদ্বোধন, এনে দিক শক্তি অভিনব।”

রাজা রামমোহনের তিরোধানের একশো বছর পরে এক স্মরণসভায় তিনি বলেছিলেন, একশত বছর পূর্ণ হয়ে গেছে এখনো তার সত্য পরিচয় দেশের কাছে অসম্পূর্ণ, এখনও তাঁকে অসম্মান করা দেশের লোকের কাছে অসম্ভব নয়, যে উদার দৃষ্টিতে তার মহত্ব সুস্পষ্ট দেখা যেত সে দৃষ্টি এখনো কুহেলিকায় আচ্ছন্ন। কিন্তু, এতে সেই কুহেলিকার স্পর্ধার কোন কারণ নেই। জ্যোতিষ্ককে আবৃত্ত করে সমস্ত প্রভাতকে যদি সে ব্যর্থ করে দেয় তবু সেই জ্যোতিষ্ক কুহেলিকার চেয়ে ধ্রুব ও মহত।…….. আমরা যারা তাঁর কাছ থেকে মানুষের প্রচুর বিঘ্নের মধ্যে দিয়েও সত্য করে দেখবার প্রেরণা লাভ করি, আর প্রত্যেক অসম্মানে মর্মাহত হই, কিন্তু তার জীবিতকালেও শত শত অবমাননাতেই তাঁর কল্যাণশক্তিকে কিছুমাত্র ক্ষুন্ন করেনি, এবং তার মৃত্যুর পরেও সকল অবজ্ঞার মধ্যে সেই শক্তি জাগ্রত থেকে অকৃতজ্ঞতার অন্তরে অন্তরেও সফলতার বীজ বপন করবে।

আর ঠিক সেই বীজ বপনের তাগিদেই নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০-তম জন্মবর্ষ স্মরণ।

হুগলির গর্বের ভূমিপুত্রকে স্মরণীয় করে রাখতে তাঁর জন্মভিটেকে সাজিয়ে তুলেছেন রাধানগর রঘুনাথপুরের সর্বসাধারণ, আর তার পাশে দাঁড়িয়েছে হুগলি জেলা পরিষদ ও খানাকুল-১ গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতি। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এক অনন্য সুন্দর অনুষ্ঠান পেতে চলেছে আপামর জনসাধারণ। সকাল আটটায় শোভাযাত্রার পর গানে কবিতায় ছাত্র-ছাত্রীদের বক্তৃতায়, কুইজে,আলোচনায় ভরে থাকবে সারাদিন। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজ্য সরকারের এক তাৎপর্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত, তা’হল রামমোহনের জন্মভিটেকে হেরিটেজ সাইট এর মর্যাদা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা। হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন হাজির হবেন এই অনুষ্ঠানে এবং হেরিটেজ বাড়ির ফলকনামা উন্মোচন করবেন। নিঃসন্দেহে এই ঘোষণা এবং শিল্পী শুভাপ্রসন্ন-এর উপস্থিতি এদিনের এই অনুষ্ঠানকে অন্য এক মাত্রায় পৌঁছে দেবে। এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন এলাকার বিভিন্ন পেশার গুণীজনেরা, আর থাকবেন সাংসদ শ্রীমতী অপরুপা পোদ্দার, হুগলি জেলা পরিষদ সভাধিপতি আলহাজ্ব সেখ মেহেবুব রহমান প্রমূখ।

রামমোহনের জন্মের 250-তম বর্ষ ঐতিহাসিক ফ্রেমে বেঁধে রাখতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে কলকাতার আর-এক ঐতিহ্যশালী ভবন রামমোহন লাইব্রেরি এন্ড ফ্রি রিডিং রুম। যেখানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর প্রথম সংবর্ধনা নিতে সম্মত হন। যেখানে কবিগুরু গীতাঞ্জলি হাতে নিয়ে পাঠ করে শোনান ‘রাত্রি যখন আঁধার হল।’ তিনি রামমোহনকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে মানতেন। এই গ্রন্থাগারে দীর্ঘকাল প্রায় 30 বছর সহ সভাপতির পদ সামলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, বহু মিটিংও করেছেন তিনি এখানে। শুধু তাই নয়, রামমোহন গ্রন্থাগারের সভাপতি ছিলেন স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, সহ-সভাপতি ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, ভগিনী নিবেদিতা। এখানে রয়েছে রামমোহনের ব্যবহৃত একাধিক সামগ্রী দুষ্প্রাপ্য সমস্ত বই, নীলচাষ মামলার নানান গুরুত্বপূর্ণ নথি, এশিয়াটিক সোসাইটির মূল্যবান কাগজপত্র। কলকাতার এই রামমোহন লাইব্রেরি এন্ড ফ্রি রিডিং রুমের সাধারণ সম্পাদক শংকর ভট্টাচার্য্য জানালেন, এক বছর ধরে চলছে রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০-তম জন্ম বর্ষ উদযাপন। ২০২১-এর বাইশে মে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠানমালা। প্রথম পর্ব শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের হাত দিয়ে, গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েছে প্রেস ফ্রিডম এর উপর আলাপচারিতা, বক্তৃতা দিয়েছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। রাজা রামমোহন রায়ের ১৮৯- তম তিরোধান দিবস পালিত হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর। ‘সাম্প্রতিক সময়ে রামমোহন চর্চার উপযোগিতা ও গুরুত্ব’ বিষয়ক বক্তব্য রেখেছেন অধ্যাপক শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়। ‘ইন সার্চ অফ দা রাজা’ তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছিল সেদিন। বক্তব্য রাখেন চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। এ ছাড়া সতীদাহ নিবারণ দিবস পালিত হয় ৪ ডিসেম্বর। যেদিন মহিলাদের ক্ষমতায়ন এর প্রতীক হিসেবে ১০০ মহিলা সাইকেলে প্লেকার্ড সহ কলকাতা পরিক্রমা করেন।

এক বছর ধরে সার্ধ দ্বিশত বর্ষ উদযাপনের পরিসমাপ্তি ঘটবে ২২ এবং ২৩ মে দুদিনের নানাবিধ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে। প্রথম দিন প্রকাশিত হবে রাজা রামমোহন স্মরণিকা 250, বাংলা রেনেসাঁর উপর প্রদর্শনী, থাকবে অরিজিনাল পোস্টাল স্টাম্প প্রদর্শনী। এছাড়াও আলাপচারিতায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও গুণীজনেরা। বিচারক চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়, শিক্ষাবিদ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য সুরঞ্জন দাস, কলকাতা রিজিয়নের পোস্টমাস্টার জেনারেল নিরাজকুমার, বিশিষ্ট কবি ও লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রী, রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরী ফাউন্ডেশন কলকাতার ডাইরেক্টর জেনারেল অজয় প্রতাপ সিংহ প্রমূখ। দ্বিতীয় দিনে প্রকাশিত হবে স্যুভেনির এবং ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন স্কুলের সহযোগিতায় রামমোহনের জীবন ও কর্ম নিয়ে আকর্ষণীয় কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। এছাড়াও রামমোহন লাইব্রেরি এন্ড ফ্রি রিডিং রুম এর সহ-সভাপতি প্রসূন গাঙ্গুলী লন্ডনে রাজা রামমোহনের ২৫০-তম জন্মবর্ষ পালনের উদ্যোগ নিয়ে তিনি এখন সেখানেই আছেন বলে জানালেন রাজা রামমোহন রায় সার্ধ দ্বিশত জন্মজয়ন্তী উদযাপন কমিটির কোষাধ্যক্ষ সজল মিত্র।

এছাড়াও ছোট-বড় বহু সংগঠন আয়োজন করেছেন নানা ধরনের অনুষ্ঠান। উত্তর ২৪ পরগনার ঐতিহ্যশালী পঞ্চাশ বছরের প্রতিষ্ঠান গোবরডাঙ্গা রেনেসাঁস ইনস্টিটিউট, তাঁরা আয়োজন করেছেন ‘নবযুগের অগ্রদূত- পুঞ্জিভূত অন্ধকার অপসারণে’ একুশ-বাইশ মে দুদিন ধরে নানা অনুষ্ঠান। রেখেছেন প্রদর্শনী, বই ও পত্র-পত্রিকা মেলা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কুইজ ও বক্তৃতার আসর এবং সঙ্গে থাকবে বিদগ্ধজনের আলোচনা। আলোচনায় অংশ নেবেন শিক্ষাবিদ দীপাঞ্জন দে, বিশিষ্ট চিকিৎসক শংকর নাথ, ইতিহাসবিদ ডক্টর কনিষ্ক চৌধুরি, সুখেন্দু দাস প্রমুখ। সঞ্চালনায় থাকবেন গোবরডাঙ্গা গবেষণা পরিষদের আহ্বায়ক দীপক কুমার দাঁ ।

নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাঝে দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে অনুসন্ধান কলকাতার পক্ষ থেকে দেশ বিদেশের মানুষের উপস্থিতিতে অনলাইনে ‘সত্যের সন্ধানে আপসহীন রাজা রামমোহন’ শীর্ষক আলাপচারিতা। 22 মে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় অনলাইন আলাপচারিতায় অংশ নেবেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অমিত দে, গৌর খাঁড়া, শংকর ভট্টাচার্য্য প্রমূখ। অনলাইনে লন্ডন থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা নিয়ে কথিকা পাঠ করে শোনাবেন প্রসূন গাঙ্গুলী। বিশিষ্ট শিক্ষক নভেন্দু সামন্তের লেখা ‘রাজা রামমোহন রায়- স্টিল নেগলেক্টেড বাই হিজ নেশন’ পুস্তকটির ই-উন্মোচন হবে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীরা অনলাইনের এই আলাপচারিতায় অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন, অনুসন্ধান কলকাতার সম্পাদক ইতিহাস শিক্ষক সাহাবুল ইসলাম গাজী। তবে কেবল কোনো বিশেষ দিবস স্মরণ করেই শেষ হয়ে যায় না আমাদের দায়িত্ব, বরং তা কয়েক হাজার গুণ বৃদ্ধি পায়। আজ সময় এসেছে উত্তরাধিকার হিসেবে আমরা তাঁদের সেই পরম্পরা কতটুকু পালন করতে পারছি, তা ফিরে দেখার, বলছিলেন বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী অনুসন্ধান কলকাতার অ্যাডভাইজার অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ