অন্যান্য আন্তর্জাতিক কলকাতা 

শ্রীলঙ্কা জ্বলছে : বিভেদের রাজনীতির মূল্য দিতে হলো শাসক ও আম জনতাকে

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ ইবাদুল ইসলাম : একুশ শতকের তথ্য প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়ে একটা রাষ্ট্রনায়কের বাড়ি উন্মত্ত জনতা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে প্রকাশ্যে এটা কল্পনা করা যায় না । প্রায় দু দশক ক্ষমতায় রয়েছে মাহিন্দা রাজাপক্ষ । কিন্ত এই দুই দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে শ্রীলঙ্কার পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ ও প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষ দুই সহোদর ভাই । এরা দুজনে শ্রীলঙ্কার শাসক হিসাবে মানুষের প্রতি সুবিচার করেননি, এটা জলের মতো পরিস্কার । তা না হলে রাজা আসে, রাজা যায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় বেশি দিন থাকতে পারে না। ক্ষমতার হাত বদল গণতান্ত্রিক কাঠামোতে স্বাভাবিক । কিন্ত ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর মানুষ যখন ক্ষমতাচ্যুত নেতার বিরুদ্ধে সরব হয় তখনই প্রশ্ন উঠে সেই নেতার কাজকর্ম নিয়ে । প্রশ্ন উঠেছে শ্রীলঙ্কার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে মানুষের এতো ক্ষোভ কেন? শুধু কী অর্থনৈতিক কারণ ? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে ?

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে পর্যালোচনা করার জন্য । শ্রীলঙ্কা একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের বাসিন্দারা অধিকাংশই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ । কিন্ত বুদ্ধদেব যেখানে সম্প্রীতি কথা, মানবতার কথা বলে গেছেন , সেখানে শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমার এমনকি খোদ কমিউনিষ্ট দেশ চিনেও আমরা দেখেছি জাতীয়তাবাদের নাম করে সংখ্যালঘু সমাজের উপর স্ট্রীম রোলার চালানো হয়েছে । শ্রীলঙ্কাতেও আমরা দেখেছি তামিলদেরকে ওই দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, সংখ্যালঘু সমাজের মানুষদের নানাভা্বে হেনস্থা করা হয়েছে । এটাই ছিল শ্রীলঙ্কার রাজনীতির ইতিহাস । বিভেদ ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তুলে বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে দমিয়ে রাখা ছিল শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষদের প্রধান দায়িত্ব । উগ্র জাতীয়তাবাদকে সামনে এনে মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়া হয়েছিল দেশের আর্থিক অবস্থার কথা । তাদের সামনে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নয়, তেলেগু হিন্দু এবং মুসলমানরা বিপদ বলে বার বার প্রচার করা হয়েছে ।

Advertisement

আমার যদি একটু খোঁজ খবর নিই তাহলে দেখতে পাব বিগত কয়েক দশক এই উগ্র জাতীয়তাবাদের নাম করে বিভেদের রাজনীতি করা হয়েছে । আর সংখ্যালঘুদের ভাতে মারা হবে এই উদগ্র কামনা থেকে ওই দেশের সাধারণ নাগরিক বছরের বছর রাজাপক্ষদের ক্ষমতাকে সুনিশ্চিত করেছে। এই সুযোগে রাজাপক্ষরা নিজেদের পারিবারিক রাজতন্ত্র কায়েম করেছে সমগ্র শ্রীলঙ্কা জুড়ে । সাধারণ মানুষ টের পায়নি । যখন টের পেল তখন দেখলো সমগ্র দেশ আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে । দেশের মানুষ যাদেরকে ক্ষমতার শীর্ষে বসিয়ে ছিল তারা নিজেদের আখের গোছাতে দেশকে বিপদে ফেলেছে । সাধারণ মানুষের কথা তারা ভাবেননি । অথচ একদিন যে সকল সাংবাদিক-লেখক সমাজের কথা, সম্প্রীতির কথা, মানুষের কথা বলেছেন সর্বোপরি দেশ বাঁচাতে হলে বিভেদ নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের জন্য কাজ করতে হবে । সেই সব সাংবাদিক –লেখককে হয় মেরে দেওয়া হয়েছে, না হলে জীবন বাঁচাতে কেউ ভারতে, কেউ বা বাইরের দেশে গিয়ে আত্মগোপন করেছেন । আজ তাঁদের কথা কী মনে পড়ছে শ্রীলঙ্কার অন্ধভক্তদের? যাদের চাপে ওই সব লেখক –সাংবাদিক শ্রীলঙ্কা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন । তাঁরা তো দেশপ্রেমিক ছিলেন , যারা দেশ বাঁচাতে সরব হয়েছিলেন অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কার মুসলিমদের প্রতি যে নারকীয় অত্যাচার করা হয়েছিল তা আগামী দিনে ইতিহাস হয়ে থাকবে । মসজিদে নামাজ পড়তে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে যত রকমভাবে মুসলিমদের হেনস্থা করা যায় তার সবটাই করেছিল অন্ধভক্তরা । এমনকি, মুসলিমদের কবরও দিতে দেওয়া হতো না বলে অভিযোগ । এক কথায় মুসলিমদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালাতো রাজাপক্ষের প্রশাসন।

আজ শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষ কার্যত বন্দী । নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষের রোষ থেকে মুক্ত হতে পারেননি । কারণ তাঁর এককালের অন্ধভক্তরা ওই নৌঘাঁটি ঘিরে ফেলে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে । আসলে অত্যাচারী শাসকের পরিণতি এটাই হয়ে থাকে । দেশের মানুষের কথা চিন্তা না করে গদি বাঁচাতে শুধু মাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রশয় দিলে সব শাসকেরই একই হাল হবে । রাজধর্ম পালন না করতে পারলে একদিন জনতা রাজধর্ম পালন করা শিখিয়ে দেবে । সুতরাং শ্রীলঙ্কা থেকে সব দেশের রাষ্ট্রনায়কদের শিক্ষা নেওয়া উচিত ।

মনে রাখতে হবে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে কিংবা জাতীয়তাবাদের নাম করে সাময়িকভাবে মানুষকে নিজের অধীনে আনা যেতে পারে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না । মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নিয়ে রাজধর্ম পালন করলে জনতার হৃদয়ে থেকে যাবেন সেই রাষ্ট্রনায়ক । আর অন্ধভক্তদের বোঝা উচিত দেশের প্রতিটি নাগরিকের সম অধিকার রয়েছে তাকে খর্ব করার চেষ্টা করা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে । খানিকটা নিউটনের সূত্রের মতো । তাই আমাদের দেশের যে সব অন্ধভক্ত মুসলিমদের হেনস্থা করার জন্য উৎফুল্ল হচ্ছেন তাদের মনে রাখা উচিত শেষের দিন খুব ভালো হবে না ।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ