বাংলার একজন সজ্জন পরোপকারী সমাজসেবী ভাল মানুষ চলে গেলেন!
সেখ ইবাদুল ইসলাম : সপ্তাহখানেক আগেও টেলিফোনে কথা হয়েছিল বললাম কেমন আছেন উনি বললেন চলে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে ৯৪ বছর পেরিয়ে এলাম আর কদিনই বা বাঁচবো পারলে একদিন আসুন কথা বলব। মাসখানেক আগে উনার বাড়িতে গিয়েছিলাম ঘন্টা দুয়েক কথা বলেছিলাম অসুস্থ শরীর নিয়েও অনেক কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন দেশের কথা সমাজের উন্নয়নের কথা সমাজ কিভাবে এগিয়ে যাবে তার কথা। মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছিলাম প্রবীণ এই নাগরিকের কথা। ব্যক্তিগতভাবে আত্মার সম্পর্ক ছিল না অর্থাৎ রক্তের কোন সম্পর্ক ছিল না ,তবু যেন কোথায় উনাকে আমার অভিভাবক মনে হত? মেয়ের ভর্তি থেকে শুরু করে তাদের পড়াশোনা আমার চাকরি জীবনের নানা সমস্যার কথা বলার একটি মাত্র জায়গা ছিল সেটাও আজ শেষ হয়ে গেল। যার কথা বলছি তিনি এই বাংলার সবচেয়ে ভালো মানুষ ছিলেন আফতাব উদ্দিন সরকার।
সোমবার রাত নটার কিছু পরে কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সাড়ে নটা থেকে মারুফ সাহেব আমাকে বারবার ফোন করতে থাকেন কিন্তু তখন আমি সংশোধিত ওয়াকফ আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অন্তবর্তী নির্দেশের ওপর অনলাইনে আলোচনা করছিলাম ফোন ধরিনি। রাত্রি সাড়ে দশটার পর যখন ফোনটা মারুফ দা কে করলাম ফোন তুলেই তিনি বললেন সব শেষ হয়ে গেছে ইবাদুল। মামা চলে গেছে।

প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনি যখন তাল কাটলো তখন বুঝলাম মামা হলেন আফতাব উদ্দিন সরকার। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে গেলাম একটা ইতিহাস, একটা সংস্থা, একটা প্রতিষ্ঠান, বিদায় নিল বাংলা থেকে। আফতাব উদ্দিনের চলে যাওয়ার শুধুমাত্র তার আত্মীয়-স্বজন বা সন্তানদের কাছেই শূন্যতা তৈরি করবে না এই শূন্যতা তৈরি হবে পরিচিতজনদের মধ্যে তো বটেই এই শূন্যতা তৈরি হবে বাংলার মানুষের মধ্যে। আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে অনেক মানুষের সান্নিধ্যে এসেছে রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজ কর্মী পর্যন্ত, শিক্ষাবিদ থেকে শুরু করে মন্ত্রী আমলাদের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি কিন্তু আফতাব উদ্দিন সরকার এর মত এত ভালো মানুষ এত সজ্জন ব্যক্তি এত পরোপকারী খুব কম মানুষকে দেখেছি।
অনেক মানুষ সাহায্য করার পর নানাভাবে সেই সাহায্যের কথা শুনিয়ে থাকে আফতাব সাহেব কোনদিন কাউকে এ ধরনের কথা বলতেন না। আমার সঙ্গে একান্ত আলোচনায় প্রায়ই বলতেন আপনি যদি কাউকে সাহায্য করেন তার প্রতিদান আপনাকে স্রষ্টা দেবেন। আর ওই ব্যক্তি যদি আপনার সাহায্য অস্বীকার করে কোনদিন তার সঙ্গে বিতর্কে যাবেন না। কোনদিন বলবেন না আমি আপনার উপকার করেছি। কারণ সে যদি তখন অস্বীকার করে তাহলে আপনার কাছে তা হবে অপমান। যদি কোন ব্যক্তি আপনার ক্ষতি করেন, বা ক্ষতি করার চেষ্টা করে সেটা যদি আপনি অনুধাবন করেন তাহলে তাকে কিছুই বলবেন না তার সঙ্গে দূরত্ব রচনা করবেন। আফতাব সাহেবের এই দার্শনিক চিন্তাভাবনা আমার জীবনে সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে। ব্যক্তিগত জীবনে যারা আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছেন বা ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন তাদের সঙ্গে কোন সময় বিতর্কে জড়ায়নি। সময় এবং সুযোগ বুঝে দূরত্ব রচনা করেছি।
আফতাব উদ্দিন সরকার সাহেব অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন যাকে ভালোবাসতেন তাকে উজার করে ভালবাসতেন। আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয় ২০১০ সালে। আমানত ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের এক অনুষ্ঠানে। সেই সময় বাংলার জনরব সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতো। আমাকে একদিন বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। তারপর তিনি নিজে থেকেই বললেন এই রাজ্যের একটি দৈনিক পত্রিকার প্রয়োজন আছে। আমি বললাম সেটা এখনো করার মত সময় আসেনি আর তার যে নেটওয়ার্ক তৈরি করাটা খুব কঠিন ব্যাপার। উনি সেই সময় থেকে বাংলার জনরবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার সাধ্যমত এই প্রতিষ্ঠানকে সাহায্য করে গেছেন। একটা কথা বলতে কোন দ্বিধা নেই আফতাব উদ্দিন সরকার বাংলার অন্যান্য সাধারণ মুসলিমদের মতো ছিলেন না তিনি যা চিন্তা করতেন সেটা বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেকটা আগে। প্রথাগত ধর্মচিন্তার চেয়ে মুসলিম সমাজের শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং চিন্তার ক্ষেত্রে যাতে প্রসার ঘটানো যায় সেই কাজে তিনি তার জীবনকে অতিবাহিত করেছেন।
নিজের জন্মস্থান বালিপুরে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছেন একটি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র এবং একটি কলেজ। যেখানে ছেলেমেয়েরা উন্নত ও আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। একটি আবাসিক বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন যে কোন কারনেই হোক সেটা খুব বেশি জনপ্রিয়তা পায়নি। মাঝখানে চেষ্টা করেছিলেন ওই আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে আল আমিন মিশনের হাতে তুলে দিতে। বর্তমানে জোর কদমে একটি কলেজ তৈরি করার উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। তাঁর দুই পুত্র সন্তান প্রতিষ্ঠিত। একজন বড় ব্যবসায়ী আরেকজন কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক, ছোট বৌমা কলকাতার নামকরা একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, এক মেয়ে নাতি-নাতনিদের ভরা সংসার রেখে গেলেন। আফতাব উদ্দিন সরকারের চলে যাওয়া বাংলার একজন সুসন্তানের চলে যাওয়া। দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে সমাজে দেশে মানুষের কাছে নিজেকে নিজের নামে চিহ্নিত করার যে প্রচেষ্টা প্রতিটা মানুষের থাকে সবাই সফলকাম হন না আফতাব উদ্দিন সরকার সফল হয়েছিলেন। আল্লাহ তার জান্নাত নসিব করুন এই কামনা করছি। শুধু তাই নয় কবির ভাষায় বলতে হয়,
‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ!/ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান!