জগদীশচন্দ্র-এর বেড়ে ওঠা : আমরা কী সত্যিই শিক্ষা নিতে চাই?
বিশেষ প্রতিনিধি :একটা টাট্টু ঘোড়া কিনে দিয়েছিলেন তাকে, বাবা ভগবানচন্দ্র। ছোট্ট সোনা, জগদীশকে কাঁধে করে নিয়ে যেত স্কুলে রঘু। শোনাতো ডাকাতি করতে যাওয়ার গল্প, দেখাতো গায়ের কাটা-কাটা দাগ আর আফশোস করতো– ফেলে আসা দিনগুলোতে কত মানুষের সে ক্ষতি করেছে! আসলে রঘু ছিল দাগি ডাকাত, জেল খাটার পর সমাজে স্থান পাচ্ছিল না। নিজ বাড়িতে জায়গা করে দিল তাকেই, ছেলেকে দেখাশোনা করবে, স্কুলে নিয়ে যাবে। সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর– এভাবেই ছেলের হবে প্রকৃত বেড়ে ওঠা আর রঘু ডাকাতের রিহ্যাবিলিটেশন। একেই বলে গুড প্যারেন্টিং। এরকমই এক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর ছেলেবেলার কথা, পারিবারিক
শিক্ষা থেকে বিজ্ঞানচর্চা সহ সত্য অন্বেষণের কথা। লিখেছেন নায়ীমুল হক।

—————————————–
দেড়শ বছরেরও আগের কথা। সাল ১৮৫৮ নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ। বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জে বিখ্যাত এক পরিবারে জন্মেছিলেন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু। কথায় আছে না! মর্নিং সোজ দ্যা ডে। ছোটবেলায় তার হাবভাবে, চলন-বলনে তা বেশ বোঝা যেত। আর পাঁচটা ছেলেদের মতো একেবারে সাধারণভাবে খেলেধুলে বড় হয়েছেন তিনি। বরং বলা যায়, তাদের থেকে বেশি খেলাধুলো, বন্ধুদের সাথে মেলামেশার মধ্যে দিয়ে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি।
আসলে পিতা ভগবানচন্দ্রের দৃষ্টিকোণই ছিল আলাদা। ব্রিটিশ আমলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া খুব সহজ ছিল না। তাদের ক্ষমতা এবং মান মর্যাদাও ছিল একদম ভিন্ন ধরনের। তাদের পোশাক-আসাক, কেতাই ছিল আলাদা। এ সমস্ত ভগবানচন্দ্রকে মেনে চলতে হত বটে, কিন্তু তার মন ছিল অতি উদার, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্ন, প্রাচুর্যকে কখনোই বড় করে দেখতেন না। ধনী-দরিদ্রের সামাজিক ভেদাভেদ, বৈষম্য এসবের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। জগদীশের মা বামাসুন্দরীদেবীও ছিলেন অত্যন্ত দয়ার্দ্র ব্যক্তি। অপরের কষ্ট দেখতে পারতেন না। হাতের কাছে যা পেতেন, তা দিয়ে দিতেন। ছোট্ট জগদীশের এই পরিবেশে বেড়ে ওঠা। ছোটো থেকেই তিনি দেখতেন বাবা-মা দুজনেরই সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে সহজ সরল মেলামেশা, তাদের প্রয়োজনে তাঁরা কিভাবে পাশে দাঁড়ান। এসব কিছু তার মনে খুব দাগ কাটতো। ফলে ছোটো থেকেই গ্রামের কামার, কুমোর, জেলেদের ঘরের ছেলেরা তার বন্ধু হয়ে উঠেছিল। তাদের সঙ্গেই খেলে বেড়াত সারাদিন আম জাম কাঁঠালের ছায়ায়। শিক্ষা সংস্কৃতি মানুষকে দূরের জিনিস দেখতে শেখায়, ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে শেখায়। বাবা-মা দুজনেই মানস চক্ষে দেখতে পেতেন, পুত্রের এই গুণগুলোই তার ভবিষ্যৎ গড়ে দেবে, কিছু না হয় ভালো মানুষ তো হবে!
ছোট্ট জগদীশের এবার শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব। বয়স তখন প্রায় পাঁচ। পিতা বদলি হয়ে এলেন ফরিদপুরে। মা বললেন, এবার একটা স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করো। ফরিদপুরে উচ্চবিত্তদের জন্য একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ছিল। সবার মত, সেখানে ভর্তি করা হোক। জগদীশকে ইংরেজি মাধ্যমে নয়, পিতার নিজ হাতে গড়া গরিব দুঃখী মানুষদের জন্য বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এই স্কুলটি ভগবানচন্দ্র তাঁর মায়ের নামে গড়েছিলেন এলাকার অতি সাধারণ পিছিয়ে পড়া মানুষদের কথা ভেবেই। ছেলেকে ভর্তি করার সময়ে তিনি বললেন, বই পড়ে আর মানচিত্র দেখে দেশকে জানা যায় না। দেশকে জানতে হলে সবার আগে দেশের মাটি আর মানুষকে জানতে হয়। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে মিশে যেতে হয়। জীবনে বড় হতে হলে মন বড় করতে হয়, গরিব দরিদ্রদের বুকে টেনে নিতে হয়। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন এটাই সত্য। পাশাপাশি তিনি এও বললেন, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, মাতৃভাষা যত সহজে মানুষের বোধ ও ধারণাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, অন্য কোনো ভাষা তা পারে না। তাই জগদীশ আমাদের বাংলা স্কুলেই পড়বে আর তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসার দায়িত্বে থাকবে রঘু। রঘু হলো জেল খাটা এক ডাকাত। ভাগ্যের কী ফের! এই রঘুর বিচারের শাস্তি দিয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট ভগবানচন্দ্র বসু স্বয়ং। শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে সে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে চায় তার গ্রামে ফিরে। কিন্তু গ্রামের লোক কোনোমতেই তাকে থাকতে দিতে রাজি না। তার অনুনয়-বিনয় কাতর প্রার্থনা সবকিছু বিফল হলে তখন সে কী করবে! সোজা চলে আসে ভগবানচন্দ্র বসুর বাড়িতে এবং আশ্রয় চায়। অসহায় লোকটিকে নিয়ে কি আর করা যায়, ঠাঁই দিলেন নিজের বাড়িতে, কাজ দিলেন পুত্রকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার। রঘু তো দারুন খুশি। ছোট্ট জগদীশ হেঁটে দৌড়ে স্কুলে যেতে চায়, কিন্তু সে কথা শুনবে কেন রঘু! কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে তাকে। এর ফাঁকে গল্প শোনাতো তার জীবনের নানান দস্যুপণার। অনুতাপে মাঝে মাঝে কেঁদেও ফেলতো সে। কত ক্ষতিই না করে দিয়েছে কত সংসারে! জগদীশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো তার দিকে। পিতা ভগবানচন্দ্র নিভৃতে এসব লক্ষ্য রাখতেন। তিনি বুঝলেন, জগদীশ কাঁধে চেপে যেতে কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে। তিনি করলেন কী, একটা টাট্টু ঘোড়া কিনে আনলেন আর বললেন, এখন থেকে এর পিঠে করেই তোমরা স্কুলে যাবে আর এটার দেখভাল করার দায়িত্ব রঘুর। স্কুলে যেতে এমনিতেই ভালো লাগতো জগদীশের, এখন তা যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মাঝেমধ্যে বেশ ঘোড়ার পিঠে চড়ানো যাচ্ছে বন্ধুদেরও। এর আনন্দই আলাদা। বন্ধুদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। কোন বাছবিচার ছিল না। কার পিতা মিস্ত্রি, কে জেলের ছেলে, কার পিতা মুসলমান কিংবা হিন্দু। মা-ও তাকে শেখাতেন টিফিন ভাগ করে খেতে হয়। বড়দিনে, ঈদে, মহরমে যেতে হয় বন্ধুদের বাড়িতে। বন্ধুদের সঙ্গে এত নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল জগদীশের, তবু একটি বিষয় কিন্তু কখনো তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। তা হল– অকারণে কাউকে কষ্ট দেওয়া, মিথ্যা কথা বলা। এমনকি গাছের ডালপালা ভাঙলেও তিনি সরব হতেন–ওরা কথা বলতে পারে না বলে এমন ভাবে ব্যথা দিতে হয় বুঝি! ওদের ফল খেয়ে তো আমাদের বেঁচে থাকা! ওদের ছায়া, ফুল সব কিছুই আমরা কত না ভালবাসি!
গাছ-পালা ভর্তি রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে সহপাঠীরা লজ্জাবতী গাছ নিয়ে ম্যাজিক দেখাতো। ছুঁলেই পাতা মুড়ে যায়! এই ম্যাজিক দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতেন জগদীশচন্দ্র। কেন পাতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বাবার কাছে জানতেন চাইতেন তিনি। বাবা বলতেন আরো জানার চেষ্টা করো, সব বুঝতে পারবে বড় হয়ে। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রকৃতির প্রতি তার অনুসন্ধিৎসু মনের সৃষ্টি হয়।
জগদীশের ছোটবেলার সামগ্রিক এই শিক্ষা তাঁর গোটা জীবন পরিবৃত হয়েছিল। তাঁর আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা, মূল্যবোধের প্রতি সম্মাননা, পারিবারিক বন্ধন, শিক্ষা চিন্তা, তরুণদের প্রতি আস্থা, সমাজ ভাবনা, দেশজ শিল্প পরিকল্পনা, সাহিত্য চর্চা– প্রতিটি ক্ষেত্রই নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে।
নিবন্ধ শেষ করব তাঁর বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে দু’একটি কথা বলে। মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন–জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনোটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত। আসলেই বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর যাবতীয় উপহার, আবিষ্কার, চর্চা ছিল এক বিশাল সাধনা, এর মাধ্যমে তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃত সত্যের উদঘাটন করতে। তাঁর কথায়, ‘বিজ্ঞান প্রাচ্যেরও নহে, পাশ্চাত্যেরও নহে, ইহা বিশ্বজনীন৷ তথাপি ভারতরবর্ষ উত্তরাধিকারসূত্রে বংশ পরম্পরায় যে ধীশক্তি পাইয়াছে, তাহার দ্বারা সে জ্ঞানপ্রচারে বিশেষ করিয়া সক্ষম৷ যে জ্বলন্ত কল্পনা বলে ভারতবাসী পরস্পর বিরোধী ঘটনাবলীর মধ্য হইতে সত্য বাছিয়া লইতে পারে, সে কল্পনাই আবার ভারতবাসী সংযত করিতে পারে৷ এই মনঃসংযমই সত্যান্বেষণের শক্তি দিয়া থাকে৷’ এখন দেখার একবিংশ শতাব্দীতে আমরা সেই সত্য অন্বেষণের উত্তরাধিকারী কতটা হতে পারি!
দ্রষ্টব্য : ডাকাতের নাম রঘু (কাল্পনিক)

