কলকাতা 

ব্রিগেডের ঐতিহাসিক‘ ইউনাইটেড ভারত‘-র সভা থেকে মোদী সরকারকে উৎখাতের ডাক দিলেন সমাবেশের মধ্যমণি বাংলার কন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেয়ার করুন
  • 82
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ ইবাদুল ইসলাম : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থেকে সর্বভারতীয় নেত্রীর মর্যাদা আদায় করে নিলেন ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড সভা থেকে । মূলত মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ডাকা এই সমাবেশের তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘ ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ‘ । সমাবেশে সেই নামের সার্থকতা প্রতি মূহুর্তে প্রমাণিত হয়েছে । আমরা সাধারনত এই ধরনের সভাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যেভাবে দেখি থাকি ; আজ তার সর্ম্পূণ উল্টো চিত্র চোখে পড়েছে । তিনি নিজে বললেন কম , শুনলেন বেশি । দেশের নক্ষত্র সমাবেশ বললে ভুল হবে না । ব্রিগেড সমাবেশ দেখে মনে হচ্ছিল যেন সমগ্র ভারতে এখানে নেমে এসেছে । পশ্চিম থেকে পূর্ব , আর দক্ষিণ থেকে উত্তর সব দিক থেকেই জনপ্রিয় আঞ্চলিক নেতারা এই সভায় উপস্থিত হন । এই সব আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে বিভেদ রয়েছে ; রয়েছে সংঘাত তো তারপরও মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে মোদী বিরোধী শ্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড ।

এদিনের সভার সূচনাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তব্য দিতে আহ্বান করেন মোদীর রাজ্যের নেতা হার্দিক প্যাটেলকে । তিনি বক্তব্য রাখতে গিয়ে সরাসরি কোনো রাখ-ঢাক না রেখে মোদী সরকারকে চোর-গুন্ডাদের সরকার বলে অভিহিত করেন এবং এই সরকারকে দিল্লি থেকে সরানোর ডাক দেন । দ্বিতীয় বক্তা হিসাবে যার নাম বলা হয় , তিনি গুজরাটের মানুষ । জিগনেশ । তিনিও মোদী সরকারকে হটানোর ডাক দেন ।

Advertisement

এরপর বক্তব্য রাখতে উঠে বিজেপির অন্যতম নেতা এবং অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য যশবন্ত সিনহা বলেন , শুধু মোদী নয় , ভাবনার বদল করতে হবে । বিচার ধারার বদল করতে হবে । তিনি আরও বলেন , স্বাধীনতা পর এই প্রথম এমন একটি সরকার দেশে প্রতিষ্ঠা হয়েছে , যে সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নষ্ট করতে চাইছে । প্রজাতন্ত্র , লোকতন্ত্র ও গণতন্ত্র ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে ।

বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার আর এক সদস্য অরুণ শৌরি বলেন , বর্তমান সরকার মিথ্যার সরকার । এই আমলের দূনীর্তি সবাইকে ছাপিয়ে গেছে । তিনি বলেন , এই সরকারের পতন ঘটাতে  হলে ভোট ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে । আর এজন্য নিজের স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে দেশের স্বার্থে । এমনকি প্রয়োজন হলে আত্মত্যাগ করতে হবে ।

জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ  ইভিএম মেশিনের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেন । তিনি বলেন এই মেশিনটা চোর মেশিন আছে । এটার বদল দরকার । বিশ্বের কোনো দেশে এই মেশিন দিয়ে ভোট হয় না , সুতরাং এর বিরুদ্ধে আমাদের এক সাথে লড়তে হবে । মেশিন নয় , ব্যালটে ভোটের দাবিতে প্রয়োজন হলে সবাই মিলে নির্বাচন কমিশনের কাছে দরবার করতে হবে ।

তামিলনাড়ুর বিরোধী নেতা এম .কে স্টালিন ব্রিগেড সভার জনতাকে আহ্বান দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য । তিনি বলেন , ২০১৯-র নির্বাচন দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ এটা মাথায় রেখে আমাদের লড়াই করতে হবে । মোদী সরকার সমগ্র দেশজুড়ে ভয়ংকর অবস্থা তৈরি করেছে । মানুষের স্বাধীনতাকে হরণ করেছে তা আমাদেরকে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হবে । ওঁরা বলছেন , তোমাদের প্রধানমন্ত্রী  কে ? আমরা বলব , আগে মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও । দেশের প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী মানুষ ঠিক করে নেবে ।

কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী কুমারস্বামী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন , মোদী  অগণতান্ত্রিকভাবে সরকার চালাচ্ছেন । আমার সরকারকেও ভাঙানোর চেষ্টা করা হয়েছে । সমগ্র দেশজুড়ে তারা এই ধরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে । তবে সফল হবে না । কারণ মানুষ বিজেপির ধাপ্পাবাজি ধরে ফেলেছে ।

সমাজবাদী পার্টির নেতা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আবেগ মোথিত কন্ঠে বলেন , মোদী এখন তার জোট সঙ্গীদের হারিয়ে সিবিআই-ইডির সঙ্গে সমঝোতা করে বিরোধীদের জব্দ করতে চাইছে । এটা আর সম্ভব হবে না । ২০১৯-এ এই সরকারের পতন হবেই । নতুন সরকার দায়িত্ব নেবে । মানুষই ঠিক করে দেবে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন ? তবে এটা সত্য দেশ এক নতুন প্রধানমন্ত্রী পাবে আগামী লোকসভা নির্বাচনের পর । সেই প্রধানমন্ত্রীই দেশের কৃষক শ্রমিক দলিত সংখ্যালঘুদের কথা ভাববে ।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বিজেপি সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন , মোদী-অমিত শাহ দেশটাকে কারবালা করে দিয়েছেন । দেশের মানুষকে আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে কষ্টের মধ্যে রেখেছে । বেকারত্ব বেড়েছে ; সংখ্যালঘু-দলিত-আদিবাসীদের উপর অত্যাচার চলছে । ওঁরা বলছেন মোদীর বিকল্প কে ? আমি তাদের বলি , আমাদের প্রধান লক্ষ্য অমিত-মোদীকে বিতাড়িত করা । ২০১৯-এর শ্লোগান হবে দিল্লি থেকে মোদীকে ক্ষমতাচ্যুত করা । প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা মানুষই ঠিক করে দেবে ।

অন্ধের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এদিন ব্রিগেড ময়দানে দাঁড়িয়ে কড়া ভাষায় মোদী সরকারের সমালোচনা করেন । তিনি বলেন , এই সরকার কোনো ভাল কাজ করেনি । উপরন্ত নোটবন্দী থেকে শুরু করে রাফাল ডিলে ব্যাপক দূনীর্তি করেছে । তাই কোনভাবে এই সরকারকে ক্ষমতায় রাখা যাবে না । এরা দেশের সংবিধানকে অমান্য করছে , সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে নষ্ট করছে । এবার আমাদের লক্ষ হবে দিল্লি থেকে মোদীকে হঠানো । এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার বলেন , দেশকে একনায়কতন্ত্র থেকে বাঁচাতে অবশ্যই জোটবদ্ধ হতে হবে ।

কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এদিন সোনিয়া গান্ধীর পাঠানো একটি বার্তা পড়ে শোনান । তাতে সোনিয়াজি বার্তা দিয়েছেন সময়ের দাবি মেনে লোকতন্ত্র , সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য মোদী সরকারের পতন জরুরি । এই অবস্থায় আমাদেরকে সংঘবদ্ধ হতে হবে দেশের স্বার্থে । তিনি বলেন, ড. আম্বেদকর যে সংবিধান রচনা করেছিলেন সেই সংবিধান মোদীর আমলে বিপন্ন । তিনি জাতি ধর্ম,বর্ণ সকলকে সমানাধিকার দিয়েছিলেন সংবিধানে । তা এখন নষ্ট হতে বসেছে । আর স্বচ্ছ ভারত গড়ার যে অঙ্গিকার মোদী করেছিলেন তা তিনি রক্ষা করতে পারেননি । রাফালে যে দূনীর্তি হয়েছে তা ইতিপূর্বে আর হয়নি । এই দূনীর্তি ইস্যুতে মোদী  নিরব কেন ? ৩০হাজার কোটি টাকা একটি বেসরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিকে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে । তাহলে অনিল আম্বানীকে কার স্বার্থে এই টেন্ডার দেওয়া হয়েছে তা মোদীজিকে বলতে হবে ? তিনি আরও বলেন , মোদীজি ক্ষমতায় আসার আগে দেশের মানুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতি বছর ২কোটি বেকারের চাকরি দেব । তা তিনি দিতে পারেননি । বরং ১.৬০ কোটি মানুষের চাকরি চলে গেছে ।

বিজেপি সাংসদ এবং নরেন্দ্র মোদী প্রধান সমালোচক শত্রূঘ্ন সিনহা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মোদী সরকারের সমালোচনা করেন । তিনি এদিন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর প্রশংসা করে বলেন , উনি একজন সফল রাজনীতিবিদ যিনি এক বছর দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনটি রাজ্যে ক্ষমতায় ফেরাতে পেরেছেন কংগ্রেসকে । রাহুল গান্ধীর বহু চর্চিত শ্লোগান চৌকিদার চোর হ্যায় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিজেপি সাংসদ বলেন , মোদীজি আপনি সমগ্র দেশজুড়ে তানাশাহি চালাচ্ছেন । আপনার তানিশাহি আর চলবে না । রাতের অন্ধকারে তুঘলকী সিদ্ধান্ত নিয়ে নোট বন্দী করে দেশের মানুষকে আপনি নিঃস্ব করে দিয়েছেন কার স্বার্থে ? কার পরামর্শে একাজ করেছেন ? পার্টির তো নয় । বিজেপি দলের পরামর্শ হলে লালকৃষ্ণ আদবানী থেকে শুরু করে আমরা সবাই জানতাম । তাহলে সিদ্ধান্তটা কে নিয়েছিলেন ? তিনি বলেন , জিএসটি যখন কংগ্রেস সরকার চালু করতে গিয়েছিল তখন আপনি তার বিরোধিতা করেছিলেন এখন আবার রাতে সংসদে জিএসটি পাশ করতে গিয়ে আপনি বলছেন দ্বিতীয়বার দেশ নাকি স্বাধীন হল । অথচ জিএসটি চালু করে দেশের মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন আপনি । অপরিকল্পিত জিএসটি চালু করেছেন বলেই আজ বারবার তার পরিবর্তন করতে হয় । রাফাল ডিল কার স্বার্থে করা হয়েছে ? কেন এত গোপন করা হচ্ছে ? রাহুল গান্ধীর তিনটে প্রশ্নে উত্তর আপনি দিতে পারেননি । কেন ১২৬ টি বিমানের বদলে ২৬ বিমান কিনছেন ? কেন তিনগুন টাকায় কিনছেন ? কেন সরকারি সংস্থা হ্যালকে দায়িত্ব না দিয়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা আপনার বন্ধুর সংস্থাকে বরাত দিলেন ? তিনটি প্রশ্নের উত্তর যতদিন না দেবেন ততদিন আমরা বলতে থাকব চৌকিদার চোর হ্যায় ।

আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন , মোদীর তাবেদারি না করলে তাদের প্রতি সিবিআই ইডি লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে । সোনিয়া গান্ধী থেকে শুরু করে লালু প্রসাদ যাদব এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না । তবে মোদীজি মনে রাখবেন সিবিআই লেলিয়ে আমাদের কাউকে বশ করতে পারবেন না । ২০১৯-র নির্বাচনে দেশ এক নতুন প্রধানমন্ত্রী পাবে যিনি দেশের মানুষকে যথাযথ ইনসাফ ও আচ্ছে দিন ফিরিয়ে দেবেন । আপনার বিদায় শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র । বাংলার মাটি থেকে যে পরিবর্তন যাত্রা সূচনা হল তা দিল্লিতে গিয়ে শেষ হবে ।

শেষ বক্তা বাংলার জনপ্রিয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি তেজস্বীর বক্তব্যের রেশ ধরেই বললেন , মোদীবাবুর ডেট এক্সপায়ার হয়ে গেছে । এবার আপনার যাবার পালা । আপনি কাউকে ভয় দেখাতে বাকি রাখেননি । সোনিয়া গান্ধী থেকে শুরু করে প্রত্যেককে আপনি সিবিআই ইডি লেলিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন । দিন শেষ হয়ে এসেছে । মোদীর আমলের সিবিআইতে  ধস, ইডিতে ধস ,আরবিআইতে ধস ,সবতেই ধস বিজেপি বস । তবে আগামী নির্বাচনে বিজেপি আর থাকবে না , মোদীবাবু প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না ।এদিন মুখ্যমন্ত্রী মোদী-অমিত শাহর কড়া সমালোচনা করে বলেন , রাজনৈতিক শিষ্টাচার এদের নেই । অন্য দল তো দূরের কথা নিজের দলের প্রবীণ নেতাদের সম্মান দেখান মোদী-শাহ । লালকৃষ্ণ আদবানী থেকে  শুরু করে যশবন্ত সিনহা , অরুণ শৌরি শত্রূঘ্ন সিনহা , সুষমা স্বরাজ এমনি রাজনাথ সিংকেও এরা গুরুত্ব দেন না । এদের হাতে দেশ নিরাপদ নয় । তাই আমাদের শ্লোগান লড়ব করব জিতবো রে , করতে হলে কর , না করলে গদি ছাড়াও । এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত সকল বিজেপি বিরোধী নেতাদের অনুরোধ করেন নিজের নিজের রাজ্যে এধরনের সভা করার ।


শেয়ার করুন
  • 82
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

nineteen − two =