কলকাতা 

নারী নিরাপত্তার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একাধিক নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছে ‘নাগরিক চেতনা’

শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিনিধি : ‘নাগরিক চেতনা’ সুশীল সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র – শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সঙ্গীতজ্ঞ, সমাজকর্মী, আইনজীবী, ডাক্তার এবং আরও অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে আসা নাগরিকদের সংগঠন, যারা বাংলার নারী ও ট্রান্স-ক্যুয়ার ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার জন্য গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য কিছু নীতি ও কাঠামোগত পরিবর্তনের দাবি জানিয়ে, ইমেল মাধ্যমে *মাননীয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে* এবং আজ কোলকাতা প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে সেই চিঠি প্রকাশ করা হয়েছে। ঐ চিঠির প্রতিলিপি(১) শ্রী মনোজ পান্ডে, আইপিএস, পুলিশ কমিশনার, কোলকাতা (২) ডাঃ শশী পাঁজা মাননীয় মন্ত্রী, স্বাস্থ্য দপ্তর (৩) শ্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী, মাননীয় মন্ত্রী, পরিবহন দপ্তর এবং (৪) মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষা দপ্তর, শ্রী ব্রাত্য বসুর কাছেও পাঠান হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে বিশিষ্ট চলচিত্র পরিচালক ও নাগরিক চেতনার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা *অপর্ণা সেন* বলেন: “আর জি কর মেডিকেল কলেজর ভয়াবহ ঘটনাটি রাজ্যজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যা পশ্চিমবঙ্গে নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে। এই সমাজে নারীদের যে অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে, নিউটাউন, বাঁকুড়া, জয়নগর, পটাশপুর, আলিপুরদুয়ার এবং আরও অনেক জায়গায় পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিই তার মর্মান্তিক উদাহরণ। যদিও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) কোলকাতাকে মহিলাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যেখানে প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় ৮৬.৫টি এমন ধরনের অপরাধের খতিয়ান রয়েছে, তবুও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি পারিবারিক হিংসা, অ্যাসিড আক্রমণ এবং পণের কারণে মৃত্যুর মতো অপরাধের ক্ষেত্রে উদ্বেগজনকভাবে উঁচু স্থান অধিকার করেছে। এই তীব্র বৈপরীত্য আমাদের রাজ্যে নারী নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে ধারণা রয়েছে এবং বাস্তবতার মধ্যে যে ফারাক, তাকেই প্রতিফলিত করে। তবে, আমরা বিশ্বাস করি যে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল এবং সুচারু পদক্ষেপের মাধ্যমে পরিস্থিতির প্রতিকার করা সম্ভব। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে লেখার পাশাপাশি, নারীদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভূমিকা রয়েছে এমন অন্যান্য কর্তৃপক্ষকেও আমরা চিঠি লিখেছি এবং যতক্ষণ না একটা কার্যকর পরিণতিতে পৌঁছান যাচ্ছে ততক্ষণ আমরা এই প্রয়াস চালিয়ে যাব।”

Advertisement

নাগরিক চেতনা র আহ্বায়ক *ডঃ রত্না পাল* বলেন: “প্রতিষ্ঠানগুলোতে এবং সাধারণ জায়গায় নারীদের উপর ঘটে চলা আক্রমণ কেবলমাত্র আঞ্চলিক সমস্যা নয় – এটি দেশের সর্বত্র ঘটছে এবং একটি জাতীয় উদ্বেগের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা চাই আমাদের রাজ্য এর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক এবং দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে দেশের বাকি অংশের জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করুক।”

নাগরিক চেতনার প্রতিষ্ঠাতা *রিমঝিম সিনহা* বলেন: “আরজি করের জঘন্য ঘটনার পর পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও, এই চিঠির মাধ্যমে যে করা দাবিগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক, কারণ পশ্চিমবঙ্গের নারীদের অবস্থা এখনও আশঙ্কাজনক অবস্থায় আছে। আমরা কিছু পদক্ষেপের দিকে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমরা বিশ্বাস করি যেগুলো গ্রহণ করে, বাংলাকে নারীর অধিকার রক্ষায় পথপ্রদর্শক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কোনরকম আপোষ করা চলবে না এবং *Sexual HarraSSment At Workplace (Prevention, Prohibition And Redressal) Act, 2013-এর পূর্ণ বাস্তবায়ন অবিলম্বে করা উচিত। যৌন হয়রানির ঘটনার প্রতিকারের জন্য কর্মক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি (আইসিসি) এবং জেলা পর্যায়ে স্থানীয় অভিযোগ কমিটি (এলসিসি) গঠন করার বিধান এই আইনে দেওয়া হয়েছে। তবে, এখনও অবধি এগুলোর বাস্তবায়ন অসঙ্গতিপূর্ণ এবং আংশিক, যার ফলে নারীদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এবং বিচার পাচ্ছেনা।”

নাগরিক চেতনার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা *ছন্দক চ্যাটার্জী* বলেন: “পুলিশি ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো আবশ্যক। নারীদের অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পুলিশ কর্তাদের অনীহা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে রয়ে গেছে। রাজ্যজুড়ে লিঙ্গ-সংবেদনশীল পুলিশি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য পুলিশ সংস্কার অপরিহার্য। আমাদের মৌলিক দাবি হলো Sexual Harrassment At Workplace (Prevention, Prohibition And Redressal) Act, 2013-এর পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা, পুলিশ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার ও সচেতনতা প্রচার, স্কুলে আইনি সচেতনতা এবং লিঙ্গ সংবেদনশীলতা তৈরি এবং নারীদের জন্য নিরাপদ গণপরিবহন। সাধারণ জায়গায়, বিশেষ করে যাতায়াতের সময়, নারীর নিরাপত্তা তাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ”

নাগরিক চেতনার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা *অভীক সাহা* বলেন: “স্কুলগুলিতে আইনি সচেতনতা এবং লিঙ্গ সংবেদনশীলতার পাঠ থাকা আবশ্যক। নারীর প্রতি হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই একদম মূল থেকে শুরু করতে হবে এবং তাঁর জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।”

*নাগরিক চেতনার দাবি ও পরামর্শের মধ্যে রয়েছে:*

* সমস্ত প্রতিষ্ঠান যাতে ICC-র নির্দেশাবলী মেনে চলে, তা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলক অডিট চালু করা।

* সমস্ত রাজ্য জুড়ে LCC প্রতিষ্ঠিত করা। এগুলি সম্পদযুক্ত, সক্রিয় এবং সুগম হতে হবে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে মহিলাদের স্বর প্রায়শই শোনা যায় না।

* সংবেদনশীলতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কমিটির সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং সক্ষমতা-বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি স্থাপন করা।

* রাজ্যের ব্যয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচী রাখা, যাতে পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রতিটি মহিলা (ক) তাঁর অধিকার এবং (খ) তাঁর প্রতি অন্যায়ের প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন।

* পুলিশ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মধ্যে লিঙ্গ সংবেদনশীলতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া, বিশেষ করে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারী অফিসারদের জন্য।

* সিভিক ভলানটিয়ার নিয়োগের ক্ষেত্রে যথাযথ অনুশীলন (ডিউ ডিলিজেন্স) প্রক্রিয়া বাধ্যতামূলক করা এবং সেইসঙ্গে প্রত্যেকটি ভলানটিয়ারের মানসিক মূল্যায়ন করা।

* নারী পুলিশ অফিসারদের নেতৃত্বে একটি রাজ্যব্যাপী সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করা, যার দ্বারা অভিযোগ খারিজ হয়ে যাওয়ার ভয় বা ভিক্টিম-ব্লেমিংয়ের ভয় ছাড়াই প্রতিকারকামী নারীদের এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করা যায়।

* একটি নারী সুরক্ষা টাস্ক ফোর্স প্রতিষ্ঠা করা, যা লিঙ্গ-ভিত্তিক হিংসা সংক্রান্ত মামলাগুলির দ্রুত এবং কার্যকর পরিচালনা নিশ্চিত করবে।

* প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলা পুলিশ অফিসারদের সমন্বয়ে একটি সেল তৈরি করা, যা শুধুমাত্র মহিলাদের উপর ধর্ষণ, হিংসা বা যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত এফ-আই-আর গুলির জন্য সংরক্ষিত থাকবে৷

* রাস্তায় নিয়মিত এবং ঘন ঘন পুলিশ টহল চালানো, বিশেষ করে অন্ধকার হয়ে যাবার পর, যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা অগোচরে না থাকে, এবং দ্রুত সমাধান করা যায়।

* পুলিশ কর্মীদের কর্মক্ষেত্রের উন্নতিসাধন, বিশেষ করে মহিলা পুলিশদের জন্য সংরক্ষিত নিরাপদ টয়লেটের ব্যবস্থা করা। পুলিশের কাজের জায়গা পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত না হলে, তারা সর্বোচ্চ দক্ষতায় কাজ করবে এমনটা আশা করা যায় না।

* পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে স্কুল পাঠ্যক্রমের অংশ হিসাবে বাধ্যতামূলক আইনি সচেতনতা এবং লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা শিক্ষার প্রবর্তন।

* স্কুলগুলোতে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের অংশগ্রহণ সহকারে নিয়মিত কর্মশালা এবং সেমিনারের প্রবর্তন করা, যা শিক্ষার্থীকে অল্পবয়স থেকেই সম্মান ও সমতার সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহিত করবে।

* প্রধান রুটে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য প্যানিক বোতাম সহ ২৪ x ৭ বাসের প্রবর্তন, যাতে ২৪×৭ নিরাপদ এবং নিগ্রহমুক্ত পরিবহন নিশ্চিত করা যায়।

* বর্ধিত নিরাপত্তা এবং দায়বদ্ধতার জন্য শহর ও গ্রামীণ উভয় এলাকাতেই সিসিটিভি নজরদারীসহ উজ্জ্বল আলোকিত নিরাপদ বাস আশ্রয়স্থল স্থাপন করা।

নাগরিক চেতনার পক্ষে বক্তারা দৃঢ় বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন যে সারা দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ লিঙ্গ ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে মানদণ্ড স্থাপন করার সম্ভাবনা রাখে এবং তাই আমরা এই জাতীয় সংকট থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারি; বাংলা ঐতিহাসিকভাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং এখন, নারীর সুরক্ষা এবং মর্যাদার লড়াইয়ে আমাদের জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এসেছে। নারীর সুরক্ষার সঙ্গে কোনরকম আপোষ নয় – তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাকে অগ্রণী ভূমিকা নিক।

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিতে চলচ্চিত্র নির্মাতা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা চূর্ণী গাঙ্গুলী, সমাজ বিজ্ঞানী পার্থ চ্যাটার্জি, পরিবেশকর্মী বনানী কক্কর এবং প্রদীপ কক্কর, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা কঙ্কণা সেনশর্মা, সাবেক এমপি ভারতের সংস্কৃতি সচিব জহর সরকার, লেখক অমিত চৌধুরী, অভিনেতা ও থিয়েটার ব্যক্তিত্ব সোহাগ সেন, চলচ্চিত্র নির্মাতা বিরসা দাশগুপ্ত, অভিনেতা বিদীপ্তা চক্রবর্তী, চলচ্চিত্র নির্মাতা অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী এবং বিজ্ঞানী ডক্টর দেবল দে সহ ৫০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ