অন্যান্য 

২০ জমাদিউস সানি : নবীকন্যা হযরত ফাতিমাতুজ্জাহারা (রা)–এক পূত-পবিত্র জীবন/ নায়ীমুল হক 

শেয়ার করুন

নায়ীমুল হক  : ২০ জামাদিউস সানি এমন এক দিন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এদিন সেই মহীয়সী নারীর পৃথিবীতে আগমনের দিন। এসেছিলেন মা খাদিজা (রা)-এর গর্ভে। মহানবী সাল্লাল্লাহু সাল্লাম এর কন্যা জান্নাতে রমনীদের সরদার হযরত ফাতিমাতুজ্জাহারা সালামুল্লাহ আলাইহে। যাঁর শানে পবিত্র কুরআনে সূরা আল কাওসার অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহপাক তাঁকে কাওসারের পবিত্র ঝর্ণাধারার সঙ্গে তুলনা করেছেন। মহানবীকে (সাঃ) এত নিবিড়ভাবে পাশে থেকে পেয়েছেন যাঁরা, সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে অন্যতম হিসেবে তাঁকে অনায়াসে অভিষিক্ত করা যায়। মা খাদিজার পাশে দাঁড়িয়ে নবীজির প্রতিটি কষ্টের সঙ্গে যুঝতে শিখেছিলেন একদম ছোট থেকে। নবীজিও হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন প্রাণের কন্যাকে দুনিয়ার জিন্দেগিকে কেমন ভাবে দেখতে হয়, চলতে হয়। নবীজির জীবনের প্রতিটি আদর্শকে পুঙ্খানুপুরূপে জীবনে অনুশীলনে আনার অভ্যাসকে রক্ত করেছিলেন কন্যা ফাতিমা।

এক হাদীসে রাসুল পাক (সাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া মুমিনের জন্য কষ্ট ও কাফিরের জন্য আরামের”। পিতা মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখনিসৃত পবিত্র এই বাণীর যথাযথ এক প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় কন্যা হযরত ফাতিমাতুজ্জাহারা

Advertisement

সালামুল্লাহ আলাইহের জীবনে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর জীবনের কষ্ট কেবল তাঁর নিজের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। এহেন এক জীবন, যা পাঠ করলে, নিজেদের জীবনের নিরিখে ভাবলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে, বিষাদগ্রস্ততায় ভরে যায়। নবী বংশ (আহলুল বাইত)-এর সদস্য হযরত ফাতিমাকে (রা) কিন্তু কখনো জীবনে দুঃখ কষ্টের কারণে নিজেকে আক্ষেপ করতে দেখা যায়নি। দুনিয়ার চাহিদায় কত অল্পেতে তুষ্ট থাকতে শিখেছিলেন নবীকন্যা, তা আশ্চর্য হয়ে ভাবতে হয় আজকের এই সময়ে। ছোট থেকেই নবীজি এবং মা খাদিজা (রা) তাঁকে শিখিয়েছিলেন অল্পে সন্তুষ্ট হতে। আল্লাহ তায়ালার প্রিয়ভাজন মুমিন বান্দা হওয়ার যে শর্ত এটাই, তা বুঝেছিলেন হযরত ফাতিমাতুযযারা। অতি সাধারণ পোশাক আশাকে দিন গুজরান করতেন তিনি। কত তালি যুক্ত পোশাক যে তিনি পরতেন তা আমরা আজ ভাবতেও পারি না! একবার হযরত সালমান ফারসি তার পরনে বহু তালি দেওয়া কাপড় দেখে ভীষণ কষ্ট পেয়ে বলেন, হায়! রোমান ও পারস্য সম্রাটদের কন্যারা স্বর্ণের সুতা যুক্ত রেসমি কাপড় পরিধান করে, দামি পালঙ্কে বসে। অথচ নবী কন্যার পরনে একী অবস্থা, যার বারো জায়গায় রয়েছে তালি! নির্বিকার হযরত ফাতিবার উত্তর ছিল, হে সালমান, মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য সুন্দর পোশাক ও ততোধিক সুন্দর আসন সজ্জিত রেখেছেন বিচার দিবসের জন্য।

এবার আসা যাক নবীজির দেওয়া একখণ্ড জমি প্রসঙ্গে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে মহানবীর (সা) দেওয়া এই জমি নবীজির ওফাতের পর তাঁকে ফিরিয়ে দিতে বলায় তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন। পিতৃস্মৃতি হিসেবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি ফাদাকের এক ফালি জমি। এটি তাঁর কাছে অন্যান্য পার্থিব যে কোনো কিছুর চেয়েও ছিল মূল্যবান। পিতার দেওয়া স্মৃতি। জীবনে সম্ভবত এই একটি বার-ই দুনিয়ার সম্পদের জন্য ব্যথাতুর হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ফাদাকের এই জমি নিয়ে পানি গড়ায় বহুদূর। সত্য-মিথ্যায় আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায়। তাঁকে কিন্তু দমে যেতে দেখা যায়নি, ছিলেন তিনি সত্যের পক্ষে অনড়। তাঁর সত্যকথন প্রসঙ্গে এক বর্ণনায় পাওয়া যায় হযরত আয়েশা (রা) বলছেন, ‘আমি তাঁর পিতা রাসূলুল্লাহ (সা) ছাড়া তাঁর চেয়ে বেশি সত্যবাদী কাউকে দেখিনি।’

হযরত ফাতিমা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে নবীজির পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করতেন। স্বামী হযরত আলী, হাসান-হোসাইনের মতো পুত্র নিয়ে আদর্শ একটি পরিবারও গড়তে পেরেছিলেন তাই তিনি। হযরত আলীর সঙ্গে বিবাহের পর মহানবী ফাতিমার আচরণের বিষয়ে প্রশ্ন করলে আলী বলেন, মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথে আমি তাঁকে সর্বোত্তম সাহায্যকারী হিসেবে পেয়েছি।

অতি আদরের কন্যাকে নবীজি হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন, কোন কাজটি কোন সময়ে কার জন্য শ্রেয়। হযরত ফাতিমা বলতেন, আমি তাঁর পরামর্শে যে কি সুখ পেয়েছি তা একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন। নবীজি তাঁকে শেখাতেন, যখনই ঘরের কাজে ক্লান্ত পড়বে তখন আল্লাহ তায়ালার তসবিহ করবে, কাজকর্ম সহজ হয়ে যাবে। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহু আকবার- এই তসবিহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর পাঠ করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হাজরত ইমাম বাকির (আ)বলেন, এই তসবিহ পড়ে আল্লাহর কাছে গোনাহর জন্য ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন, শয়তান দূর হয়ে যায় এবং দয়াবান আল্লাহ খুশি হয়ে যান।

নবীজির ওফাতের পর কন্যা ফাতিমা পিতার বিচ্ছেদ ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন, তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারেননি। ‘জান্নাতুল বাকী’-এর এক প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘর তৈরী করে দেওয়া হয় তাঁর জন্য, যা ‘বাইতুল আহ্যান’ বা ‘শোকের ঘর’ নামে আখ্যায়িত হয়।

নবীজির ইন্তেকালের পর মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে শোকগ্রস্ত ফাতিমার ইন্তেকাল হয়। নবীজির ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয়। তিনি বলেছিলেন, তাঁর ওফাতের পর বংশের প্রথম যিনি তাঁর সঙ্গে মিলিত হবেন, তিনি আর কেউ নন, তাঁর আদরের দুলালী, বেহেশতে নারীদের সর্দার হযরত ফাতিমাতুজ্জাহারা (সা) ।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ