দেশ 

‘‘সংবিধান ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যে বাধা দেয়। আপনারা বিদ্বেষ ছড়ান। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেন। সংবিধানে এ সব কোথায় লেখা আছে?”: রাহুল গান্ধী

শেয়ার করুন

বাংলার জনরব ডেস্ক : ‘‘সংবিধান ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যে বাধা দেয়। আপনারা বিদ্বেষ ছড়ান। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেন। সংবিধানে এ সব কোথায় লেখা আছে?” সংসদে সংবিধানের ৭৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোদি সরকারকে লক্ষ্য করে এই কথাগুলি বলেছেন দেশের বিরোধীদল নেতা রাহুল গান্ধী। রাহুল গান্ধীর এই বক্তব্যে হতচকিত হয়ে যায় মোদি সরকারের উপস্থিত মন্ত্রীরা এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও। বক্তব্যের শেষে তিনি দৃঢ় কন্ঠে বললেন এই সংসদে দাঁড়িয়ে শপথ করে বলছি জাতি গণনা আমরা করব চালু করব। দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিচার করব পঞ্চাশ শতাংশের সংরক্ষণ চালু করব। রাহুল গান্ধীর কন্ঠে যে আওয়াজ ছিল যে দীপ্ত ছিল তাতে হারিয়ে গিয়েছিল মোদি সরকারের উপস্থিত সাংসদরা।

স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখতে উঠে এ দিন রাহুল গান্ধী মহাভারতের একলব্যের গল্প বলতে শুরু করেন। প্রথমে বিজেপি সাংসদরা বিষয়টি বুঝতেই পারছিলেন না। গল্প সোনার ভান করছিলেন ধীরে ধীরে পড়তে পড়তে পেঁয়াজের খোলস ছাড়ানোর মতোই একটার পর একটা ইস্যু এক লব্য কে কেন্দ্র করে তুলে নিয়ে নেন। দ্রোণাচার্য এক লব্যকে অস্ত্রশিক্ষা দেননি কারণ তিনি নিচু জাতের ছেলে ছিলেন। তিনি দ্বিজও ছিলেন না তাই দোনাচার্য সেই শিক্ষা থেকে তাকে বঞ্চিত করেছিল। একদিন বনের ভিতর দিয়ে দ্রোণাচার্য যখন যাচ্ছিলেন পথে দেখেন একটি কুকুর চিৎকার করছে তারপরেই চুপ করে যায়। দ্রোণাচার্য কুকুরটার কাছে গিয়ে দেখেন তাকে তীর শয্যায় চারদিকে তীর মেরে কুকুরটাকে আটকে দেয়া হয়েছে। আর মুখে তার বান মেরে মুখ বন্ধ করে দিয়েছে ওই বাচ্চা ছেলেটি একলব্য। তখন দ্রোণাচার্য ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করে কে এই কাজটি করেছে তখন ওই ছেলেটি বলে এটা আমি করেছি। কোথায় শিখেছো এই বিদ্যা? উত্তরে একলব্য সেদিন বলেছিল আপনার কাছে গিয়েছিলাম আপনি আমাকে শেখাননি আমি যেহেতু নিচু জাতের সন্তান! আমি আপনার মূর্তি গড়ে সেই মুহূর্তের সামনে বসে তপস্যা করেছি, এই অস্ত্রবিদ্যা শিখেছে নিজের ইচ্ছায়। তখন দ্রোণাচার্য অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে বলে আমি গুরুদক্ষিণা চাই।! এক লব্য গুরুদক্ষিণা দিতে চাইলে তিনি চাইলেন বৃদ্ধাঙ্গুলি! বুড়ো আঙ্গুলটা কেটে দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দিয়েছিলেন একলব্য। আজ দেশের মানুষ দেশের 142 কোটি মানুষের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিয়ে ছে বিজেপি সরকার!

Advertisement

হিন্দু সমাজের প্রচলিত এই গল্পকে বাই উপাখ্যানকে সামনে রেখে রাহুল গান্ধীর সরাসরি মোদি সরকার এবং বিজেপি আরএসএস-এর উপরে হামলা করবে এটা বুঝে উঠতে পারেনি। শাসকদলের এমপিরা। দেশের যুব দেশের শ্রমিক দেশের নারী দেশের কৃষক সবার বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিয়েছে মোদি সরকার বলে সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন রাহুল গান্ধী।

আদানি গোষ্ঠীকে সমস্ত সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে। আদানির হাতে সমস্ত সম্পদ তুলে দিচ্ছে। বেসরকারিকরণ, সরাসরি নিয়োগের ফলে দেশের দলিত, ওবিসি, আদিবাসীরা সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না, তাঁদের বুড়ো আঙুল কাটা যাচ্ছে। মুম্বইয়ের ধারাভি আদানির হাতে তুলে দিয়ে সেখানকার ছোট ব্যবসায়ীদের আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে। যাঁরা সেনার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অগ্নিবীর চালু করে তাঁদের আঙুল কেটে নিচ্ছে। হাথরসের দলিত তরুণীর ধর্ষণ ও সম্ভলে মন্দির-মসজিদ বিবাদের উদাহরণ দিয়ে বিজেপির দিকে দলিত-সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে রাহুল বলেন, ‘‘সংবিধান ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্যে বাধা দেয়। আপনারা বিদ্বেষ ছড়ান। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেন। সংবিধানে এ সব কোথায় লেখা আছে?”

লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীর প্রথম বক্তৃতার ‘থিম’ ছিল অভয়মুদ্রা। তা বোঝাতে ডান হাত তুলে দেখিয়েছিলেন। আজ একলব্যের চরিত্র তুলে ধরতে সাদা টি-শার্ট পরিহিত রাহুল সেই ডানহাতের বুড়ো আঙুল লুকিয়ে উল্টো করে দেখিয়েছেন। মিনিট কুড়ির মাথায় আচমকাই বক্তৃতা শেষ করার আগে রাহুল গান্ধী দাবি করেছেন, ইন্ডিয়া জোট জাতিগণনা করাবে।সংরক্ষণের ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা ভেঙে দেবে।

রাহুল গান্ধীর এই বক্তৃতার পরে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সঙ্গে শুক্রবার সংবিধান নিয়ে প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরার প্রথম বক্তৃতার তুলনা শুরু হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে অধিকাংশ সাংসদেরই মত, প্রিয়ঙ্কা প্রথম বক্তৃতাতেই ঠাণ্ডা মাথায় ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে সব বিষয় তুলে ধরেছিলেন। বিজেপিকে নিশানা করলেও পাল্টা আক্রমণের সুযোগ দেননি। সেই তুলনায় রাহুলের বক্তৃতায় ঝাঁঝ থাকলেও তিনি বিজেপির হাতে লোপ্পা বল তুলে দিয়েছেন। যেমন, একলব্যের কথা বলতে গিয়ে ছয়-সাত বছরের যুবক বলেছেন। তপস্যার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তপস্যার অর্থ হল ‘শরীর মে গর্মি পয়দা করনা’। তা নিয়ে সংসদের ভিতরে, বাইরে বিজেপির নেতারা হাসিঠাট্টা করতে ছাড়েননি। রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ‘‘এ সব কে শেখান? রাহুল গান্ধীর গৃহশিক্ষক বদল করা প্রয়োজন।’’ তৃণমূল সাংসদ শত্রুঘ্ন সিনহার মতে, ‘‘অনেকেরই মনে হয়েছে, রাহুল গান্ধীর বক্তৃতা ছোট হয়েছে। আরও একটু বলা উচিত ছিল। তবে বক্তৃতা ভাল লেগেছে। কিন্তু আমার মতে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর বক্তৃতা অনেক ভাল ছিল।’’

দাদা রাহুলের বক্তৃতার পরে প্রিয়ঙ্কা নিজে অবশ্য বলেছেন, আদানি গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে তরুণদের বঞ্চিত করা নিয়ে রাহুল যা বলেছেন, একদম ঠিক। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমার বক্তৃতা থেকে আদানি শব্দ মুছে দেওয়া হয়েছে। কেন? আদানি কি অসংসদীয় শব্দ? ওঁরা যে কারও নাম নিতে পারেন, আমরা আদানির নামোচ্চারণ করতে পারব না?”

আদানির মতোই রাহুল আজ ফের বিনায়ক দামোদর সাভারকরকে নিশানা করায় বিজেপি শিবির উত্তেজিত হয়েছে। সংবিধান নিয়ে বিজেপিকে নিশানা করতে গিয়ে আজ সাভারকরের নাম না করে তাঁকে নরেন্দ্র মোদীর ‘সুপ্রিম লিডার’ হিসেবে কটাক্ষ করেছেন রাহুল। তিনি বলেন, সংবিধান তৈরির পরে সাভারকর লিখেছিলেন, ‘এই সংবিধানের সবথেকে খারাপ দিক হল, এতে কিছুই ভারতীয় নেই। সংবিধানের থেকেও মনুস্মৃতি বড়। বেদের পরে সবথেকে পূজনীয়। মনুস্মৃতি মেনে দেশ চালানো উচিত’। রাহুল এক হাতে সংবিধান ও অন্য হাতে মনুস্মৃতি নিয়ে বিজেপি নেতাদের প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনারা কি মনুস্মৃতি মেনে চলেন? আপনারা যদি সংবিধানকে সম্মান করেন, তা হলে তো আপনারা সাভারকরের অপমান করছেন।’’

সাভারকরকে নিশানার পরে বিজেপি নেতারা পাল্টা জবাবে বলেছেন, খোদ ইন্দিরা গান্ধী সাভারকরকে দেশের সুপুত্র বলেছিলেন। তাঁর স্মৃতিতে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিলেন। সাভারকরের স্মারকের জন্য চাঁদা দিয়েছিলেন। শিবসেনার একনাথ শিন্দের পুত্র, সাংসদ শ্রীকান্ত শিন্দে প্রশ্ন তোলেন, সাভারকরের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর ভাবনা নিয়ে রাহুল কী বলবেন? রাহুল জবাবে বলেন, ‘‘আমি ঠাকুমাকে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি বলেছিলেন, সাভারকর ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েছিলেন।’’


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ