অন্যান্য কলকাতা 

Begam Rokeya: চিন্তা, কর্ম ও প্রতিজ্ঞায় অদ্বিতীয়া বেগম রোকেয়া/ নায়ীমুল হক 

শেয়ার করুন

*চিন্তা, কর্ম ও প্রতিজ্ঞায় অদ্বিতীয়া বেগম রোকেয়া*

নায়ীমুল হক 

সোনার পিঞ্জরে ধরে রেখো না আমায়,

Advertisement

আমারে উড়িতে দাও দূর নীলিমায়।

মহীয়সী বেগম রোকেয়ার ১৪৪-তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁরই লেখা কবিতার দুটি পংক্তি দিয়ে শুরু করলাম। বেগম রোকেয়ার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমাদের সমাজে নারী শক্তি দমিয়ে রাখা হচ্ছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন হচ্ছে না। পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীর এগিয়ে যাওয়ায় হাজারো প্রতিবন্ধকতা। নানারকম নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল। কোনো সময়ে সামাজিক রীতির দোহাই, তো কোনো সময়ে ধর্মের দোহাই! তিনি এসবকে খুব একটা আমল দিতেন না। যুক্তির কষ্টিপাথরে বিচার করতেন। যুক্তির বাইরে কোনো অনুশাসন মানার ক্ষেত্রে তাঁর আপত্তির কথা দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করতেন বেগম রোকেয়া।

তিনি লিখছেন, আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্য্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।… তাহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিয়াছেন।… আর এই যে আমাদের অলঙ্কারগুলি– এগুলি দাসত্বের নিদর্শন। … কারাগারে বন্দিগণ লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা স্বর্ণ রৌপ্যের বেড়ী পরিয়া বলি “মল পরিয়াছি। উহাদের হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত “চুড়ি!”… অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি “হার পরিয়াছি!” গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া “নাকা দড়ী” পরায়, আমাদের স্বামী আমাদের নাকে “নোলক” পরাইয়াছেন। অতএব দেখিলে ভগিনি, আমাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কিছুই নহে! … অভ্যাসের কি অপার মহিমা!

নারীদের প্রতি সমাজের হেয় করার এই অভিলাষকে তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার কথা তিনি বলেছেন। রোকেয়া লিখছেন, পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরাণী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি-ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি-ব্যারিস্টার, লেডি-জজ — সবই হইব!…. আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে। এখন অনুশীলন দ্বারা বুদ্ধিবৃত্তিকে সতেজ করিব। যে বাহুলতা পরিশ্রম না করায় হীনবল হইয়াছে, তাহাকে খাটাইয়া সবল করিলে হয় না?

এই যে নারী ক্ষমতায়নের কথা তিনি বারবার বলেছেন, তা কিন্তু কখনো পাশ্চাত্যের নারী স্বাধীনতার নামে উশৃঙ্খলাকে সমর্থন করে নয় বরং মানুষ হিসেবে নারীর সামগ্রিক বিকাশ তিনি চেয়েছিলেন। এ কথা তাঁর ব্যক্তি জীবন, চরিত্র, কর্মজগৎ ও মনন থেকে পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়।

আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর পূর্বে সার্বিকভাবে আমাদের সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাৎপদ ছিল, সে যুগে নারীর শিক্ষা, অধিকার অর্জনে তাঁর লড়াই স্মরণ করিয়ে দেয় রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর পরবর্তীতে লেডি অবলা বসু, কাদম্বিনী গাঙ্গুলীদের সংগ্রামের ইতিহাস।

স্বাভিমান নিয়ে নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা ও তা নিজের জীবনে করে দেখানোর লড়াইয়ে বেগম রোকেয়া আজ সুপরিচিত একটি নাম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সমস্ত কিছুর পেছনে তাঁর মৌলিক দুটি চিন্তা কাজ করেছিল, যা প্রায় অনুল্লেখিত। প্রথমটি হল, দেশকে ব্রিটিশদের আগল থেকে মুক্ত করতে নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত শহীদ হওয়ার পর নজরুলের ‘ধুমকেতু পত্রিকায়’ ‘নিরুপম বীর’ নামক এক অসামান্য শ্রদ্ধার্ঘ্য রোকেয়া রচনা করেছিলেন। সৌম্য দর্শনধারী, শান্ত অসামান্য বিপ্লবী কানাইলাল দত্তের ফাঁসির পর একজন ইউরোপীয় প্রহরী আসিয়া চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন— “তােমাদের হাতে এ রকম ছেলে আর কতগুলি আছে?” এই কবিতাটি লেখার পর ব্রিটিশ পুলিশের নজরদারি বেড়ে যায়। বেগম রোকেয়া এ সমস্ত ভ্রুকুটিকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করেছিলেন।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল ধর্মীয় চিন্তার ভ্রান্ত ধারণাকে অপছন্দ করতেন তিনি। ধর্মের পথ অনুসরণে তাঁর আপত্তি তো ছিলই না, বরং তিনি অত্যন্ত ধর্মানুরাগী ছিলেন বললেও এতটুকু ভুল বলা হয় না। ধর্মের নামে মনগড়া প্রচলিত রীতির অন্ধ অনুসরণ ও ভন্ডামীর বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন ভীষণ রকমের খড়্গহস্ত। কারবালার প্রান্তরে পাষণ্ড এজিদের অন্যায়-অপশাসনকে তিনি বর্ণনা করেন তাঁর এক লেখনীতে। এগুলিও সমাজে তাঁর সম্পর্কে ভিন্ন দৃষ্টিতে সমালোচিত হয়। কিন্তু এ সবকিছুর অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। ‘পিপাসা’ প্রবন্ধে পবিত্র কোরআন ও ইসলামী ইতিহাসের কী গভীর অধ্যায়ন তাঁর ছিল, তা বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে

নবী পরিবারের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে কারবলার প্রান্তরে ইমাম হোসেন পরিবারে মর্মান্তিক পিপাসার বর্ণনা দিয়েছেন। ইমাম হোসেন, আলী আকবর, কন্যা সকিনা, ফাতেমা, কাসেম, শহরবানু, জয়নব সবার পানির পিপাসা ও শহীদদের বিবরণ মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করেছেন। তিনি ইমাম হোসেনের পিপাসার বিবরণ দিয়ে বলেন,

“বীর হৃদয়! একবার হোসেনের বীরতা সহিষ্ণুতা দেখ! ঐ দেখ, তিনি নদীবক্ষে দাঁড়াইয়া-আর কোন যোদ্ধা নাই, সকলে সমরশায়ী, এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। তিনি কোন মতে পথ পরিষ্কার করিয়া নদী পর্যন্ত গিয়াছেন। ঐ দেখ অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিলেন, বুঝি পান করেন; না, পান ত করিলেন না!- যে জলের জন্য আসগর তাঁহারই কোলে প্রাণ হারাইয়াছে, আকবর তাঁহার রসনা পর্যন্ত চুষিয়াছেন- সেই জল তিনি পান করিবেন? না, তিনি জল তুলিয়া দেখিলেন, ইচ্ছা করিলে পান করিতে পারেন। কিন্তু তাহা না করিয়া নদীর জল নদীতেই নিক্ষেপ করিলেন! বীরের উপযুক্ত কাজ।”

মহীয়সী বেগম রোকেয়া ছিলেন সৎ চিন্তা, কর্ম ও প্রতিজ্ঞায় অদ্বিতীয়া এক নারী। যথার্থই তাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছিল, লতাপাতা যেমন আপনা-আপনিই আলোকের পানে যাইতে উন্মুখ হইয়া থাকে, যতই বাধা পাক তবুও সেই দিকেই তাহার গতি। বেগম রোকেয়ার জীবনও তেমন-ই। সত্য ও সুন্দরের প্রতি অনিবার্য সেই গতি, আজও আমাদের যা সত্যের সন্ধানে গতিশীল রাখে, অনুপ্রেরণা জোগায়।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ