Mamata Banerjee: কোন সংস্থা থেকে ফোন আসলে ধরবেন না বিধায়কদের নির্দেশ মমতার! নাম না করে আইপ্যাক-কে কেন নিশানা দলনেত্রীর?
বিশেষ প্রতিনিধি : আইপ্যাক এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চলেছে তৃণমূল কংগ্রেস এই খবরটা অনেকদিন ধরেই বাজারে রটেছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাষায় গতকাল বিধানসভার নওশাদ আলী কক্ষে দলীয় বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়ে বললেন তা এক কথায় অভাবনীয়। চুক্তি মতে ২০২৬ সাল পর্যন্ত আইপ্যাক তৃণমূল কংগ্রেসের পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গতকাল বলে দিয়েছেন কোন সংস্থার কাছ থেকে ফোন এলে ফোন ধরবেন না। সংস্থা বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন তা উপস্থিত বিধায়কদের বুঝতে বাকি ছিল না।
তিনি অবশ্য আইপ্যাকের নাম করেননি। কিন্তু যা বলেছেন এবং যে ভাবে বলেছেন, তাতে তাঁর লক্ষ্য আইপ্যাক ছাড়া অন্য কোনও সংস্থা হওয়া প্রায় অসম্ভব। তৃণমূলের এক বিধায়ক বলেন, ‘‘নেত্রী কোনও সংস্থার নাম করেননি। তবে তিনি বলেছেন, কোনও সংস্থা যদি ফোন করে তাদের ফোন ধরার প্রয়োজন নেই। আপনার এলাকার ব্লক সভাপতি বা অন্য কোনও দলীয় পদাধিকারী নিয়োগ নিয়ে মতামত চাইলেও দেবেন না। ওদের কিছু বলার দরকার নেই। আমি যা করার করব।’’
মমতার মুখনিসৃত সেই ‘ওরা’ আইপ্যাক বলেই মোটামুটি নিঃসন্দেহ ওই বিধায়ক-সহ দলের অনেকে। তৃণমূলের একটি অংশ মনে করছে, আইপ্যাকের কার্যকলাপ ‘পছন্দ’ না হওয়ায় নতুন করে দলীয় সংগঠনের রাশ হাতে নিতে চলেছেন তৃণমূলনেত্রী। সোমবার তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে সেই বার্তাই দিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, আইপ্যাকের সঙ্গে তৃণমূলের অঘোষিত ‘দু-নম্বর’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পর্ক মসৃণ। দলের অন্দরে এ তথ্য অজানা নয় যে, ওই পরামর্শদাতা সংস্থা অভিষেকের দফতরের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে কাজ করে। সারা রাজ্য থেকে তথ্যসংগ্রহ করা, কোথায় সরকারি কাজ কতটা হয়েছে বা হয়নি থেকে শুরু করে কোনও জনপ্রতিনিধি কেমন কাজ করছেন, সে সমস্ত নিয়েই সমীক্ষা করে আইপ্যাক। সেই সমস্ত তথ্য তারা দলীয় স্তরে সরবরাহ করে। যার ভিত্তিতে রিপোর্ট তৈরি করে অভিষেকের দফতর সরকারকে সরবরাহ করে।
তৃণমূলের একটি সূত্রের দাবি, মমতা বিধায়কদের বৈঠকে এমনও বলেছেন যে, কোনও সমীক্ষার জন্য কাউকে তথ্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই তথ্যের সমর্থন মেলেনি। কিন্তু মমতা যদি ‘সমীক্ষা’র কথা বলে বিধায়কদের তাতে সহযোগিতা করার নির্দেশ না-দিয়ে থাকেন, তা হলে তা আরও বেশি করে আইরপ্যাকের দিকেই আঙুল তোলে। কারণ, রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিবিধ সমীক্ষা তারাই চালায়।
তৃণমূল দলের মধ্যে আইপ্যাক এর এই অতি সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছিল। বিশেষ করে যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন তাদের মূল সমস্যা এখানেই ছিল। আরেকটা বিষয় হল আইপ্যাক রাজ্যজুড়ে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছিল। যে সিন্ডিকেট এতটাই দাপট দেখাতে শুরু করেছিল পুলিশ প্রশাসন থেকে সমস্ত স্তরে যাদের প্রচন্ড পরিমাণে বিরক্ত বোধ করতে থাকে সাধারণ নাগরিক। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিন পর কেন এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছেন তা পরিষ্কার নয়। এর আগেও বাংলার জনরব বারবার বলেছে এই আইপ্যাক সংস্থাটি আসলে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষতি করতে চাইছে। কিভাবে ক্ষতি করতে চাইছে তার বিস্তারিত তথ্য আমরা না দিলেও শুধু এটুকু বলতে পারি তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক পরিকাঠামোর সমস্ত হদিস বিরোধী দলগুলো পেয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, আইপ্যাক এর কর্তারা দাবী করতেন তারাই নাকি এই রাজ্যকে চালাচ্ছেন। ডিজিটাল আনন্দবাজারে তৃণমূল কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতার মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘‘আইপ্যাকের কাছে কি রাজনীতি করা শিখতে হবে?’’ সেই মর্মে অভিযোগ যে তাঁরা দলনেত্রী মমতার কাছে করেননি, তা নয়। এমন অভিযোগও মমতার কাছে জমা পড়েছে যে, এক প্রবীণ মন্ত্রী সাংবাদিক বৈঠক শুরু করেও থামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, আইপ্যাক ফোন করে তাঁর বক্তব্যে আরও কিছু বক্তব্য জুড়েছে। সেগুলি জেনে নিয়ে আবার তাঁকে সংবাদমাধ্যমের সামনে ফিরতে হয়েছে। এ ছাড়াও দলীয় পদাধিকারী মনোনয়ন এমনকি, পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা ভোটে প্রার্থী নির্বাচনেও আইপ্যাকের বিরুদ্ধে ‘আধিপত্য’ দেখানোর অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের অন্দরে। দলীয় পদাধিকারী এবং প্রার্থী নির্বাচনে ‘অনিয়মে’ জড়িত থাকার অভিযোগও কালীঘাটে জমা পড়েছিল। তবে সেগুলিকে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল।
আইপ্যাক যখন প্রথম তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন জেলায় জেলায় তাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ তুমুল আকার নিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, আইপ্যাকই ‘নেতৃত্ব’ ঠিক করে দিতে চাইছে। যদিও ২০২১ পর্যন্ত সে সবে আমল দেননি তৃণমূলের প্রথম সারির নেতৃত্ব। দেখা গিয়েছিল, পরামর্শদাতা সংস্থার কথায় চলে ভোটে লাভ হয়েছে তৃণমূলের।
তবে ভোটের মুখে এইভাবে আইপ্যাক এর সঙ্গে সম্পর্ক সরাসরি ছিন্ন করাটা মমতার কাছে অনেকটাই রিক্স হয়ে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। কারণ আইপ্যাক এই মুহূর্তে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক পরিকাঠামোর সমস্ত স্তরটি খুব ভালো করে জেনে গেছে। এর আগেও রাহুল গান্ধীর সঙ্গে যখন আইপ্যাক যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছিল তখনও কংগ্রেস নেতাদের দাবি ছিল এইভাবে নয় তারা শুধুমাত্র দলকে পরামর্শ দেবে দলের অভ্যন্তরে বসে কোন নীতি-নির্দেশিকা জারি করতে পারবে না। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই হয়তো আইপ্যাক ছাড়াই আগামী নির্বাচনে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্যই প্রশংসা করতে হয় ঠিক সময়ে তিনি আইপ্যাক সম্পর্কে নেতাকর্মী ও বিধায়কদের সতর্ক করে দিলেন। না হলে আগামী দিনে এই আইপ্যাক সামনে রেখে পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে বড় কোনো অঘটন ঘটে যেতে পারতো। আর এটা আগাম বুঝতে পেরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কঠিন সিদ্ধান্তটি নিলেন।