Mamata Banerjee & TMC : মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন সিদ্ধান্ত আমিই নেব, অভিষেক বলছেন ব্যক্তি নয়, সমষ্টি বড়, নেতা কর্মীরা বিভ্রান্তিতে! কোন পথে সমাধান?
সেখ ইবাদুল ইসলাম: সদ্য সমাপ্ত রাজ্যের ছটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়ার পর ২৫শে নভেম্বর সোমবার কালীঘাটের বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠক ডেকেছিলেন। এই বৈঠক ঘিরে সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই বাংলার রাজনীতিতে একটা পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। সবাই মনে করছিলেন এবার হয়তো দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুরুত্ব ও ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করবেন। কিন্তু জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকের পরে যে নির্যাস বেরিয়ে এলো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তৃণমূল নেত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানালেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসনিক প্রধান অন্যদিকে দলনেত্রীর দায়িত্ব সমানভাবে বহন করবেন এর বাইরে আর কেউ নেই।
তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দলের সর্বোচ্চ নেত্রী এ বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই একইসঙ্গে তিনি যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেটাও বলার কিছু নেই। কিন্তু তবুও চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকের পর বেরিয়ে এসে এ কথা বললেন। কেন বললেন? তার অবশ্য ব্যাখ্যা তিনি দেননি! তবে মনে করা হচ্ছে পশ্চিমবাংলার উপমুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ মন্ত্রী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে করতে হবে এই দাবিতে বেশ কয়েকজন বিধায়ক এবং দলের নেতা মন্তব্য করতে শুরু করেছিলেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলো এই মুহূর্তে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের প্রশাসনের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে না!
সোমবারের জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের কাছে বলতে গিয়ে চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেছিলেন যে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মুখপাত্র হিসাবে কথা বলবেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ তথা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ঘোষণার দুইদিন পরে সম্ভবত বুধবার দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা এবং রাজ্যসভার সাংসদদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বৈঠকে তিনি দলীয় সাংসদদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন লোকসভা এবং রাজ্য সভায় আমাদের দলের সাংসদরা রাজ্যের বকেয়া দাবিতে সরব হবেন এমনকি মূল্যবৃদ্ধি ইস্যুতে সরব হবেন কিন্তু কারো ব্যক্তিগত বিদ্বেষ থেকে সংসদে মুলতবি প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন না। এই ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বলতে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলতে চেয়েছেন সেটা স্পষ্ট করে বললে বলা যায় আদানি বিরোধিতা। রাহুল গান্ধী আমেরিকার এক আদালতে আদানির বিরুদ্ধে এবং এই কোম্পানির বিরুদ্ধে যে এফআইআর দায়ের হয়েছে মামলা রুজু হয়েছে তা নিয়ে সংসদে সরব হয়েছেন। রাহুল গান্ধীর সহ কংগ্রেস নেতারা স্পিকারের কাছে দাবি করেছেন যে আগে আদানি ইস্যুতে সংসদে আলোচনা হবে তারপর তারা অন্য বিষয়ে আলোচনা করতে দেবে। কিন্তু এই ইস্যুতেই আপত্তি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন এটা রাহুলের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ।
কিন্তু এই ঘটনার ২৪ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঝাড়খন্ডে গিয়েছিলেন হেমন্ত সরেনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ঐদিন রাতে দমদম বিমানবন্দরে নেমে তিনি স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন সংসদে অবস্থান কি হবে তৃণমূল কংগ্রেসে তা তিনি নিজে ঠিক করবেন। শুধু তাই নয় দিল্লিতে অর্থাৎ সংসদের অভ্যন্তরে যে কমিটি তিনি পাঁচজনের করে দিয়েছেন সেই কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে যে অধিবেশনের ভেতরে তাদের অবস্থান কি হবে? সেই কমিটিতে কারা আছেন সেই কমিটিতে আছেন উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও ব্রায়েন, কাকলি ঘোষ দস্তিদার কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় সাগরিকা ঘোষ এবং নাদিমুল হক। এরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে মমতা বন্দোপাধয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন তারপর কী সিদ্ধান্ত হবে বলে দলনেত্রী জানিয়ে দেবেন। প্রকৃতপক্ষে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অগ্রাহ্য করছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এহো বাহ্য! গতকাল ৩০ শে নভেম্বর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ডায়মন্ড হারবারে এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে গিয়ে সেখানে তিনি বলেছেন ব্যক্তি বড় নয় সমষ্টি বড়। কাকে ইঙ্গিত করে এ কথাটি বললেন তা নিয়ে ইতিমধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। এদিকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে সওয়াল করে ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর শোকজ হয়েছেন। যদিও তিনি শোকজের উত্তর দিয়েছেন কি হতে পারে কি হতে পারে না তা ভবিষ্যৎ বলবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সমষ্টির কথা বললেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাতে কি আমল দিচ্ছেন? আমাদের মনে হয় এ কথায় কোন গুরুত্ব অন্তত দলনেত্রীর কাছে নেই।
অভিষেকের উপর এতটা ক্ষুব্ধ কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? শোনা যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশ মন্ত্রী করার জন্য বিভিন্ন বিধায়কের কাছে নাকি ফোন গিয়েছিল! ওই সব বিধায়কদের কাছে অনুরোধ করা হয় তারা যেন অভিষেকের পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেন। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে যে একটা অচল অবস্থা তৈরি হয়েছিল তার পেছনেও নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের একটা অংশের মদদ ছিল বলে অভিযোগ! বেশ কিছু বিধায়ককে ফোন করা হয়েছিল অভিষেকের পক্ষে সওয়াল করার জন্য কিন্তু তারা প্রকাশ্যে কেউ সওয়াল করতে রাজি হননি। সবাই দেওয়ালের ওপরে চড়ে বসেছিল যেদিকে পাল্লা ভারী সেদিকেই লাফিয়ে পড়বে বলে। শুধুমাত্র হুমায়ুন কবীর অভিষেকের পক্ষে সওয়াল করলেন তাতে নিজের বিপদ ডেকে আনলেন। অন্যদিকে কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বহুল প্রচারিত সংবাদ মাধ্যম পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ এক আইনজীবী। ওই আইনজীবী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন সেই পদ থেকেও তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় ওই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে আনন্দবাজারের পরেই বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছিল বেশি করে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সেই বিজ্ঞাপন বিগত তিন মাস ধরে বন্ধ আছে।
মমতা অভিষেকের এই দ্বন্দ্বে অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। শ্যাম রাখি না কুল রাখি এটা ভাবতে ভাবতেই এই সব নেতাকর্মীদের সময় চলে যাচ্ছে। কোন কথা কিভাবে বলতে হবে তা নিয়েও খুব সতর্ক অবস্থান রয়েছে নেতাদের। বিগত কয়েক মাস ধরে কল্যাণ ব্যানার্জি এবং ফিরহাদ হাকিমরা যে চাপের মুখে ছিলেন সেই চাপ থেকে তারা অনেকটাই মুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে। হুমায়ুন কবিরের ভাষায় বলতে হয় দিদিই তো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেকেন্ড ইন কমান্ড করেছিলেন আজ তার পাশে এবং তার পক্ষে কথা বলার জন্য আমাকে শোকোজ করা হচ্ছে। এটাই এখন বাংলার প্রতিটি তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী নেতাদের বক্তব্য,যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তার পাশে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম তার পক্ষে আমরা সওয়াল করেছি এখন আমরা কেন বঞ্চিতের তালিকায় থাকবো।
অভিষেকের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত ব্যক্তি নয় সমষ্টি বড়। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিটা সরিয়ে দিলে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত ব্যক্তিও অচল হয়ে যাবেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সাংসদ হয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আছেন বলে। মাইনাস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় শূন্য। সুতরাং অভিষেককে মনে রাখতে হবে সবকিছুর একটা সীমাবদ্ধ ক্ষমতা আছে তার বাইরে উঠতে গেলেই পড়ে যেতে হয়। অভিষেক অনুগত নেতাকর্মীদেরও এই সহজ কথাটা মনে রাখা উচিত।