কবি আশিস সান্যালের জীবনাবসান
মোহাম্মদ সাদউদ্দিন, কলকাতা:চলে গেলেন বিশিষ্ট কবি আশিস সান্যাল (৮৬)। মঙ্গলবার তার মৃত্যুর খবর চাউর হতেই দুই বঙ্গেই নেমে আসে শোকের ছায়া। শোক প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি গোষ্ঠী। উল্লেখ্য, কবি আশিস সান্যালের জন্ম ৭ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে। প্রয়াণ ২৫ নভেম্বর ২০২৪। জন্মগ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুরের সুসং গ্রামে। পিতা দ্বিজেন্দ্রনাথ সান্যাল এবং মাতা তরুলতা দেবী। দেশভাগ পর নয় বছর বয়সে কলকাতায় আসেন, যেখানে দীর্ঘ সংগ্রাম তাকে আরও দৃঢ় এবং দৃঢ় করে তুলেছিল।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হয়ে তিনি অধ্যাপনাকে নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন।
তাঁর বিশাল রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে কবিতা, উপন্যাস ও গল্প, ভ্রমণ কাহিনি। পাশাপাশি তিনি অনেক বইয়ের সম্পাদনা ও অনুবাদও করেছেন। কবির কবিতা ও উপন্যাস হিন্দি ও গুজরাটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
ছাত্রাবস্থায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই- “শেষের আলো”-এর মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য প্রয়াস আলোর মুখ দেখেছিল।
আশিস সান্যালের সাহিত্যিক জীবন শুধু কবিতাই নয় – গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং শিশুসাহিত্যও শুরু করে। তিনি বিভিন্ন ভারতীয় এবং বিদেশী ভাষা থেকে কাজ অনুবাদ করেছেন। তার কবিতাও বহু বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
লেখক হিসেবে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেমিনার ও কবিতা উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস তাকে ১৯৬৮ সাল থেকে সর্বভারতীয় কবি সম্মেলনের আয়োজন করতে অনুপ্রাণিত করেছে, যা ভারতে প্রথমবারের মতো। প্রথম পূর্বাঞ্চলীয় লেখক সম্মেলন, প্রথম আফ্রো। এশিয়ান লেখক সম্মেলন এবং প্রথম সার্কভুক্ত দেশগুলোর লেখক সম্মেলনের আয়োজন করেন তিনি। বিশ্ব কবিতা উৎসবের সভাপতি হিসেবে তিনি প্রতি বছর কলকাতায় তিন দিনব্যাপী বিশ্ব মিলনের আয়োজন করে আসছেন, যেখানে বিভিন্ন দেশের কবিরা নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন।
সরলতা তাঁর কবিতার প্রধান গৌরব। তিনি মানবতা এবং প্রকৃতির প্রেমিক, যেখান থেকে তিনি অবাধে তার চিত্র এবং প্রতীকগুলি আঁকেন তার চিন্তার ধরণ এবং প্রকাশের পদ্ধতিটি আকর্ষণীয়ভাবে নতুন এবং মৌলিক।
ষাটের দশকের কয়েকজন কবির মধ্যে আশিস সান্যালের নাম গণনা করার মতো। শব্দ ও চিত্রকল্পের অলংকৃত মুদ্রা, শব্দচয়ন ও পদচারণা বাদ দিয়ে, তাঁর কবিতাগুলিকে করেছে সূক্ষ্ম, সুস্পষ্ট এবং অনুরণিত। আশিস সান্যালের কবিতাগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং প্রতিশ্রুতিশীল।’
তিনি ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ভারত সরকারের সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের অধীনে বাংলায় অনূদিত আম্বেদকর রচনার সম্পাদক ছিলেন।
আজ অবধি তাঁর প্রকাশনার অনূদিত সংস্করণ সহ তাঁর ১২৩টি বই বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দিতে প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— প্রথমআলো” (১৯৬১), “মৃত্যুদিন জন্মদিন” (১৯৬২), “আজ বসন্ত” (১৯৬৪), “স্বপ্নের উদ্যান ছুঁয়ে” (১৯৭০), “পটভূমি কম্পমান” (১৯৭২), “জন্মে প্রতিজন্মে” (১৯৭৪), “জলপাই অরণ্যে প্রতিদিন” (১৯৭৭), “যেতে যেতে” (১৯৮১), “এখন তথাগত” (১৯৮৭), “শ্রেষ্ঠ কবিতা” (১৯৯৩), (২০০৩), “বারুদ পারে না” (১৯৯৩), “স্রোতের অবিরল শব্দে” (১৯৯৫), “নির্বাচিত কবিতা” (১৯৯৮), “নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” (১৯৯৮), “নির্বাচিত প্রেমের কবিতা” (২০০০), “কাছেই রয়েছে নদী” ( ২০০২), “শ্রেষ্ঠ কবিতা” (২০০৩), “অমৃত যন্ত্রণা (কাব্য নাটক)” (২০০৪), “নদী জানে” (২০০৫), “এই সময়” ( ২০০৫), “রোদ্দুরের দিকে” (২০০৬), “রূপকথা নয়” (১৯৭২), “অমৃত সমান” (১৯৭৪), “মৃত্যুত্তীর্ণ” (১৯৭৬), “অন্বেষা” (১৯৮১), “দশ দেশের রূপকথা” (১৯৮৩), “নদীর ওপার” (১৯৮৯), “বাংলার লোক-কথা” (১৯৯১), “কালো পাথর” (১৯৯২) “এক যে ছিল” (১৯৯৫), “ভারত পথিক জহরলাল” (১৯৮৯), “পরীর পালক”
তিনি ১০০ টিরও বেশি পুরস্কার পেয়েছেন যেমন:
জাতীয় কবি – ১৯৮৯
ভূয়ালকা পুরস্কার – ১৯৯২
মিশেল মধুসূদন পুরস্কার – ১৯৯৬
‘সাহিত্য মহোপাধ্যায় পুরস্কার’ – হিন্দি সাহিত্য সম্মেলন – ১৯৯১
ত্রিপুরা রবীন্দ্র পরিষদ সম্মান, উদয়পুর – ১৯৯৭
ICCLP (নরওয়ে) – ২০০৩
বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, টাঙ্গাইল – ২০০৬
প্রভৃতি।
……………
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি/কবি আশিস সান্যালের একটি কবিতা।
(পটভূমি কম্পমান কাব্যগ্রন্থ থেকে, ১৯৭২)
এত জাগরণ তবু জাগরণহীন আলো চৈতন্য অবধি।
রোদের ভেতরে দুঃস্থ রোদের ঝঙ্কার-
ভালোবাসা মধ্যরাত্রে শ্বাপদসঙ্কুল বনে স্তব্ধ বনস্পতি।
এত প্রেম বিরাজিত তবু প্রেম তোমার আমার
কুয়াশায় ভেসে ভেসে ক্রমাগত ক্ষীণ।
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি হেঁকে যায় প্রতিদিন অরব প্রান্তরে-
মানুষ কি রমণীয় হবে কোনোদিন?
কেননা রক্তাক্ত স্মৃতি যতদূর প্রতিভাত মানব সংসার,
নিসর্গে বিজন বৃষ্টি প্রখ্যাত ছলনা।
প্রত্যেক কান্তারে বৃক্ষ অবনত। শাশ্বত আঁধার
হরিণের মতো ত্রস্ত যেন ধ্রুব মৃত্যুর উপমা।
সর্বত্র বিরাজে ক্লান্তি। নিমগ্ন উচ্ছ্বাসে
দুর্লভ কিশোরী এক কবেকার সজল আকাশে
চোখ মেলে স্নেহময়। গোপন পাহাড়ে
বাউল প্রেমিক তার হেঁটে যায় ম্লান অন্ধকারে।
শব্দময়, ধ্বনিময়, রৌদ্রময় প্রতিদিন প্রথম আঙিনা।
জাগরণহীন আলো তবু দৃপ্ত চৈতন্য অবধি-
ক্রমে ক্লান্তি আবির্ভূত, ক্রমে দুঃখ আবির্ভূত, ক্রমে
নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে প্রতিহত নদী
প্রবল আঘাত হানে চৈতন্যের নির্জন প্রস্তরে-
ভেঙে যায় পটভূমি। ভেঙে যায় নৈঃশব্দ্যে বিলীন
মৌলকন্ঠ প্রতিধ্বনি হেঁকে যায় প্রতিদিন অরব প্রান্তরে
মানুষ কি রমণীয় হবে কোনদিন?