বিনোদন, সংস্কৃতি ও সাহিত্য 

শারদীয়া সাহিত্য : বাংলার বিশিষ্ট কবিদের একগুচ্ছ কবিতা

শেয়ার করুন

এক 

শারদ শুভেচ্ছা

ড. ঋতা ভট্টাচার্য

শারদ প্রাতে, শিউলির গন্ধে,

আনন্দের স্রোতে, জাগে আশা বহু প্রাণে।

Advertisement

চারদশক আগে বাংলা, যখন দুর্গোৎসবে মাতোয়ারা,

আমার স্মৃতির দরজা খুলে যায় শৈশবে,

যখন হই মাতৃহারা।

তখনের সঙ্গে এখন!

বহু পরিবর্তন আছে বিলক্ষণ!

সে বছরের সঙ্গে এবছরের

একটাই মিল,

অপ্রত্যাশিত দুঃখ অনাবিল।

আবার পুজোর আনন্দ যেন হয়েছে নিরানন্দ।

তিলোত্তমার ঘটনাকে করি যখন বীক্ষণ,

বিভীষিকা ধেয়ে আসে প্রতিক্ষণ।

এই মর্মান্তিক ঘটনার ফাঁদে

বিশ্বের মানুষ কাঁদে।

এ বছরে এতো আয়োজন,

আছে কী তার কোন প্রয়োজন?

মা দুর্গা তো পরম শক্তি,

জানি আমার আছে শাশ্বত ভক্তি।

তবু প্রশ্ন জাগে—তিলোত্তমার হবে তো মুক্তি?

এই মর্মান্তিক ঘটনার ফাঁদে, বিশ্ব মানব কাঁদে।

মায়ের কাছে প্রার্থনা, হবে না কখনো বঞ্চনা।

আমরা যেন সাথে থাকি সকলে,

অন্যায় প্রতিবাদের কলরবে।

সুবিচার অবশ্যম্ভাবী হোক।

মুছে যাক সকল শোক।

দুই.

“খোঁজ”

আঞ্জু মনোয়ারা আনসারী

বুকের মধ্যে আগুন নিয়ে বসবাস আজন্মের

সেই আগুনেই প্রদীপ জ্বালা–

ভালোবাসা হারিয়ে গেছে,

নীল আকাশ ছাড়িয়ে, মহাশূন্যে।

শিশির পায়ে রাতের আলপথে

ধানশিষের কানাকানি

টুপ করে ঝরে পড়ে বিন্দু শিশির

আমার ফিরে আসা নদীবক্ষে।

ভালোবাসা পুড়ছে‌ নদীপাড় ভেঙে

লেলিহান চুল্লির হলুদ শিখায়,

কাঁচজলে ভাঙা-চাদেঁর লুটোপুটি

ছায়াপথ ভেঙে অন্তঃসলীল

অথচ,

প্রেম কুড়বো, অনন্তকাল হাঁটছি।।

তিন.

তিলোত্তমা

অমূল্য রতন মাল

হিম ঝরানো শরৎ

মিঠে রোদ্দুর,মাটির আঙিনা

বেল শিউলি,নিকানো উঠান

অপরাজিতা,ধানের গোলা

ইটের ভাঁজে সিমেন্ট বালি

মিত্রবাড়ির তুলসী তলা।

বাড়ির মেয়ে ছোট্ট উমা

দৌড়ে এসে বললো মাকে

কে এসেছে আমাদের বাড়ি

এদিকে চাও,এই দেখোমা ।

মা বললো, কে রে উমা ?

বললো মেয়ে,খেলার সাথী

আমার সই তিলোত্তমা।

মায়ের দু`পায়ে হাত

প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই

চিবুক ছুঁয়ে মা বললো

এই সময়ে দেওয়ার মতো

আমার কাছে কী আর আছে !

কী পেলে তুই খুশি হবি ?

আশীর্বাদ? না শুধুই বিচার ?

চার.

প্রত্যাশার প্রদীপ

সেখ আব্দুল মান্নান

তিলোত্তমা,লাম্পট্যের পৈশাচিক অত্যাচারে

নিভে যাওয়া তোমার জীবন দীপ

সহস্র কোটি প্রদীপ হয়ে জ্বলছে দিকে দিকে,

অগণিত ভারতীয় নারীর সম্ভ্রম রক্ষার

অদম্য লড়াইয়ের জিয়ন কাঠি হয়ে।

তিলোত্তমা,সৃষ্টির আদিকাল থেকে যারা

গৃহবন্দি হয়ে রাতের পর রাত

সহ্য করেছে নির্মম লাঞ্ছনা নীরবে,

তাদের দিয়েছে তুমি রাতের অধিকার।

চেয়েছ বুঝিয়ে দিতে

রাত শুধু কামনা চরিতার্থর নয়,

রাত শুধু পুরুষের নয়,

রাতের নির্যাস পান করার

সম অধিকার আছে সব নারীর।

তিলোত্তমা,তোমার নির্দয় হত্যাকাণ্ডের

তীব্র প্রতিবাদে সবলা হয়ে আজ

নেমেছে পথে লক্ষ কোটি বঙ্গনারী,

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ সমবেত শ্লোগানে

অন্ধকারে প্রত্যাশার দীপ জ্বেলে।

তিলোত্তমা,কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে

সাম্যবাদী পুরুষও হয়েছে তাদের সাথী

বস্তাপচা ধ্যান ধারণার মূল উপরে

অন্ধকারের একাধিপত্যকে খানখান করে

জ্বালাতে নতুন দিনের নতুন আলো।

তিলোত্তমা, আজ তুমি জীবন দিয়ে

প্রমাণ করলে নারীর সম্ভ্রম রক্ষায়

সময় হয়েছে মুখোস খোলার,

ছদ্মবেশী আইন রক্ষকদের

পুরুষের অহংকারের খাস তালুকে

পুঁতে দিয়ে নারী সম্ভ্রমের বিজয় নিশান।

পাঁচ.

প্রার্থনা হোক সমবেত

কৃষ্ণা গুহ

প্রার্থনা হোক সমবেত!! আমরা যেন

হারিয়ে না ফেলি দিশে,

সারারাত ধরে বুকের ভেতর এখনো

ব্যথা চিনচিনে ।

পাকদন্ডী আলস্য ভেঙেছে কবেই

বুকের ক্ষতে আগুন জ্বেলেছে সবাই!!

গলিত লাভা ঝরছে, কথাটা হাঁটছে

বিব্রত সুরে দেশ থেকে দেশান্তরে ।

সীমাহীন প্রতিবাদে রাত্রি জাগছে

শহর বিচারের আশ্বাসে ।

হাজার হাজার জনতার স্লোগানে চিরধরা সমাজ

বাধ্য হবে কি সঠিক বিচার দিতে !!

সুবিচার পাবোই আমরা। জনতার মহোল্লাস

এগিয়ে যাবে অন্ধকার ভেঙে জ্যোৎস্নায়।

কলঙ্কিনী রাতের গুঁড়িয়ে দেবে ধর্ষণেতে

ধস্ত যত কালো হাত।

ছয়.

ষ্টেথো হাতে হাসপাতাল

       অদৃশ্য নাথ

আমরা অভয়া খুঁজতে বেড়িয়েছি

সাত সকালে হাসপাতাল !

অভয়া সাত সকালে বেড়িয়ে গেছে

ষ্টেথো হাতে গতকাল।

অভয়া কোথায়, কোথায় অভয়া

বুক চাপড়ে ডাক ছাড়ি,

পথ ভিজে যায় অশ্রু ধারায়

আয় অভয়া, আয় বাড়ি ।

আজ পাথর চাপা হৃদয় নিয়ে

কোথায় যাবো অভয়া বল !

কোথায় যাবো খুঁজতে তোকে

দু নয়নে ঝরছে জল !

আজ কাকে নিয়ে কাটবে জীবন

কে ধরবে তরীর হাল ?

অভয়া সাত সকালে বেড়িয়ে গেছে

ষ্টেথো হাতে হাসপাতাল !

আজ সবার মেয়ে ঘরে ফিরেছে

আমার দুর্গা ফিরবে না

আর আমাদের কেউ মধুর স্বরে

মা বাবা বলে ডাকবে না !

আজ কেমন করে থাকবো বল

কেউ আমার ব্যথা বুঝবে না

আজ কেমন করে বোঝাই বল

সন্তান হারার বেদনা !

রোগ বালায় তার ছিল না কিছু

কাল হল তার ডাক্তারী ?

চোখের জলে বাঁধ ভেঙে যায়

আয় অভয়া, আয় বাড়ি।

তোকে ছাড়া আজ শূন্য জীবন

তোকে ছাড়া কি বাঁচা যায় !

আজ নয়নের জলে নদীর প্লাবন

ফিরে আয়, বাছা ফিরে আয় !

সে যে হাজার রুগীর সেবা করে

বাঁচিয়ে তুলত তাদের প্রাণ

দোষ হলো তার ডাক্তার হওয়া

হাসপাতালেই গেল প্রাণ ।

ফিরবে না আর আসবে না সে

আমার দুর্গা হাসবে না,

সে যে সকাল দুপুর হাসপাতালে

আর তো রুগী দেখবে না।

তাজা শরীরটা ছিঁড়ে খেলো তোর

ডাক্তারী পড়াই হল কাল ?

দুর্গা সাত সকালে বেড়িয়ে গেছে

ষ্টেথো হাতে হাসপাতাল ।

শোনো, আমার দুর্গা যুদ্ধে গেছে

করবেই ও যুদ্ধে জয়,

এবার স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল ফুঁড়ে

সকল অসুর করবে ক্ষয়।

ওগো, আমার দুর্গা বীরাঙ্গনা

যুদ্ধে কোনদিন হারবে না,

আমার দুর্গা প্রতিবাদী মুখ

অন্যায় কভু মানবে না।

ওগো, আমার দুর্গা রণাঙ্গনে

কখনো পিছে থাকবে না,

এই পুজোতে মাতবে সবাই

শুধু আমার দুর্গা থাকবে না।

এবার আমার দুর্গা, করবে নিধন

অসুর দেশে থাকবে না,

আজ আমার দুর্গা যুদ্ধ করছে

আর তো বাড়ি ফিরবে না।

তাজা শরীরটা ছিঁড়ে খেলো তার

ডাক্তারী পড়াই হল কাল ?

দুর্গা সাত সকালে বেড়িয়ে গেছে

ষ্টেথো হাতে হাসপাতাল ।

আমার দুর্গা মেঘনাদ হয়ে

অদৃশ্য রূপে যুদ্ধ করে,

আজ আমার দুর্গা অমর হয়ে

রয়েছে সে বিশ্ব জুড়ে।

আমার দুর্গা মেঘনাদ হয়ে

সব অভয়ার করবে বিচার,

এবার অসুর দানব নিকেষ হবে

মানবে না তো দুর্গা হার।

ওগো, আমার দুর্গা চিন্ময়ী

মৃন্ময়ী হতে জানে না,

রণাঙ্গনে আমার অভয়া

কোন দিন সে হারবে না।

আমার দুর্গা লিখেছে ইতিহাস

কোন দিন তা মুছবে না,

আমার দুর্গা দশপ্রহরণধারিনী

কোন দিন সে মরবে না।

লক্ষ প্রদীপ জ্বলছে রোজ

আমার ঘরে নিকষ আঁধার

আমার দুর্গাকে মেরে ফেলেছে

কি হবে নিয়ে, ফালতু বিচার ?

আজ রাজপথে দেখি বৈশাখী ঝড়

দেখি লক্ষ প্রদীপ প্রতিবাদ

তবু আমার বুকে থামবে কি ঝড়

ঘুচবে কি মনের অবসাদ ?

পথে পথে দেখি তীব্র প্রতিবাদ

দেখি নর নারীদের হৈ চৈ,

আজ সবার দুর্গা ফিরছে ঘরে

আমার দুর্গা এলো কৈ ?

আমার দুর্গা, আমার দুর্গা হারিয়ে গেছে

কোন দিন আর ফিরবে না,

বাবা মার সাথে একসাথে বসে

কোন দিন আর হাসবে না ।

সাত.

 পূজার মজা

 মুকুল রঞ্জন দাশ

বর্ষা যেতেই পূজার হাওয়া

লাগলো গায়ে ভাইরে !

আনন্দে মন উঠলো নেচে

তাইরে নাইরে নাইরে।

শিউলি ফুলের গন্ধ-মাঝে

পূজার আমেজ পাইরে,

কাশের বনের শুভ্র-শোভায়

উদাস হয়ে যাইরে।

পূজা এলেই নূতন নূতন

জামা-জুতো চাইরে,

পূজা-সংখ্যার গল্প-ছড়ায়

বিভোর হয়ে যাইরে।

পূজার ছুটি হয়ে গেলে

স্কুলে যাওয়া নাইরে,

পূজা দেখে ঘুরে ঘুরে

কত কিছুই খাইরে।

বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে

আনন্দে গান গাইরে,

পূজার মতো এমন মজা

আর কিছুতে নাইরে।।

আট.

 কবিতা

মহ:সাগীর হাসনাইন

কবিতা তোমার অনেক অহঙ্কার,

তোমার সৃষ্টিতে হাজার শব্দ

ভেঙে হয় চুরমার!

কলমের ডগে অনেকেই আসে

নিজের রূপ আর রঙে

এক জনই পারে ঠাঁই নিতে সেথা

তোমার চলার ঢঙে।

তখন তুমি আদরে দুলালী

বড় হও ধীরে ধীরে,

বাছাই করেই বরণ কর

বাকিরা অন্ধকারে!

শব্দযুদ্ধে হেরে গিয়ে যারা

মরণের পথে যায়,

কোনোদিনই তারা ফিরবেনা আর

তোমার এ রাস্তায়।

যারা রয়েগেলো তারাই তোমার

গুরুকুল জানো কিতা?

যুদ্ধের জয়ে পূর্ণ হলে তুমি,

তুমিই হলে কবিতা।

নয়

ফুলের মতো

  মানিক দে

ফুলের মতো জীবন যদি

সব মানুষের হতো

থাকতো কি আর হানাহানি

হিংসে বিভেদ যতো ।

রাম রহিমের বিভেদ ভুলে

সকল ভারত বাসী,

মিলে মিশে এই ভারতে

থাকতো পাশাপাশি।।

দশ

ঋণাত্বক বিদ্যুত স্রোত

   হান্নান বিশ্বাস

পিছু হটতে হটতে

দেওয়ালের কাছাকাছি পিঠ

বিন্দুর দুপ্রান্তে প্রায়

গোধূলির সূর্যের মতো

একেবারেই দিগন্তের সিমানার

ধারে একটি পা

সাগর পাড়ে আশ্রিত

জলের অবাঞ্ছিত ফেনার মতো

জীবনপঞ্জি হাতড়াই

তীর্থক্ষেত্রের প্রসাদের ন্যায়

বিক্রিত হই আর ফিরে আসি

ঠাকুরের পায়ে

সিলিং ফ্যানের পঞ্চম পয়েন্টের মতো

বুকে ঋণাত্বক বিদ্যুৎ স্রোত

তবু নিস্তব্ধ,নিঝুম

ভোর হতেই বাড়ির মোরগ

ডেকে উঠবে নিশ্চিত

তাই তারাদের সাক্ষী রেখে ঘুমাই

বাবুই পাখির মতো

ঠোঁট দিয়ে বাসা বুনি নিরালায়

অকাল ঝঞ্ঝার আলিঙ্গনে

পাঁজর ভাঙ্গে।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ