কলকাতা 

চিকিৎসকদের ভগবান বানাবেন না, তাঁরা মানুষ, ভুল করেন, আবার জীবন বিপন্ন করে জান বাঁচাতেও কসুর করেন না, চিকিৎসক দিবসে বিশিষ্ট ক্যান্সারবিদ সুবীর গাঙ্গুলী

শেয়ার করুন

নায়ীমুল হকের প্রতিবেদন : প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ১লা জুলাই মহা সমারোহে পালিত হল জাতীয় চিকিৎসক দিবস। চিকিৎসা কেবলমাত্র একটি পেশা নয় এটা একটা সেবা। অনেক সময় চিকিৎসকেরা নিজ স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে এই সেবা দানে নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করেন, বাঁচিয়ে তোলেন আশা ছেড়ে দেওয়া মুমূর্ষু রোগীদের জীবন।

সেবা দানের এই মহান ব্রতকে সম্মান জানাতে প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের জন্মদিনে পালিত হয় চিকিৎসক দিবস। অনুসন্ধান কলকাতা এবছর চিকিৎসা দিবসে আয়োজন করেছিল অনলাইন আলাপচারিতা। সকলের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই আলাপচারিতা শুনতে যোগ দিয়েছিল ছাত্র-ছাত্রীরাও। ওদের জন্যও ছিল বিশেষ আয়োজন। ‘আশা-ভরসা-স্নেহের হাত বাড়িয়ে দাও ওদের দিকে’ এই বিষয়ে।

Advertisement

বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার সুমন দাস

এ দিনের অনুষ্ঠান স্মারক বক্তব্য দিয়ে সূচনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ দেবব্রত মুখোপাধ্যায়। তিনি ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের নানাদিক অতি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরেন। চিকিৎসক হিসেবে তাঁর গুণের সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতার দিকের কথাও তুলে ধরেন তিনি। উল্লেখ করেন, আজকের সমাজে অনেক বদল হয়েছে। ডাঃ রায় যেমন মুখ দেখে বুঝে নিতে পারতেন রোগীর অবস্থা, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে পারতেন আজ কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতিতে মুখ দেখে চিকিৎসা শুরুর দিন আজ আর নেই। কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার দায়ভার আজ অনেকখানি বহন করতে হয় চিকিৎসকদের। সমস্ত ঝক্কি আজ পোহাতে হয় তাঁদের।

তবু নানা ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিতে পিছোপা হন না চিকিৎসাকেরা। এটা এমনই এক পেশা!

প্রখ্যাত চিকিৎসক ডাক্তার সুমন দাস বলেন আজকের প্রেক্ষিতে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আর্থসামাজিক পরিকাঠামোর বাইরে রাখা সম্ভব নয়। ‘রোগী নয়, রোগের চিকিৎসা’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ডাক্তার দাস আরও বলেন, বর্তমান সমাজে আমরা আমাদের জীবনশৈলীতে নানা রকম পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। কায়িক পরিশ্রম আমরা করি না, ঘরে বানানো খাবারের প্রতি আমাদের অনীহা, সকাল-দুপুর- বিকেল সবসময়ই ফাস্টফুডের উপর আমরা নির্ভরশীল। ছোটদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওরাও অতি দ্রুত রপ্ত করে ফেলছে বড়দের মত জীবন আচরণে। সকালে ওঠার অভ্যাস, জোরে পড়ার অভ্যাস এসব কিছু আজ ছোটদের মধ্য থেকে লুপ্তপ্রায়। একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করার অভ্যাস ছেড়ে যাচ্ছে। মোবাইল হাতে না পেলে তাদের যেন কোনো কাজই করা সম্ভব নয়। ফলে নানা রকমের জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারে আধিক্য আসার ফলে গল্পের বই পড়া কমে গেছে, শখ-আহ্লাদ তাদের আর প্রায় নেই বললেই চলে। অবিলম্বে বাচ্চাদের জন্য হবি ডেভেলপ করার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন ডাক্তার সুমন দাস।

বিশিষ্ট মনোবিদ তৃণা গুহ ঠাকুরতা আগের কথার রেশ ধরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা, টেনশন, উত্তেজনা ক্রমশ তাদের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে বলে উপস্থিত অভিভাবকদের সাবধান করে দেন। তিনি বলেন সন্তানদের জন্য সময় দিতে হবে, তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, কথা বলতে হবে, তবেই তাদের মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তিনি আরো বলেন বাচ্চাদের বোঝাতে হবে, ব্যর্থতা সবার জীবনেই আসে। আমরা আজ যাদের রোল মডেল বলে দেখি, তাদেরও জীবনে ব্যর্থতা এসেছিল। তা ওভারকাম করতে পেরেছেন বলেই তাঁরা আজ রোল মডেল। নিজের সম্পর্কে জানতে হবে, বুঝতে হবে, তবেই আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দায়িত্ববোধের মিশেল সন্তান-সন্ততিদের বড় হতে সাহায্য করে বলে মনে করেন মনোবিদ তৃণা।

বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুবীর গাঙ্গুলী

এদিনের আলাপচারিতায় পৌরোহিত্য করেন বিশিষ্ট ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সুবীর গাঙ্গুলী। তিনি বলেন চিকিৎসকদের সম্পর্কে গুণগান করতে গিয়ে তাঁদেরকে যেন ভগবানের আসনে বসিয়ে না দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে তাঁরাও মানুষ, মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ওঠা ডাক্তারদের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই ডাক্তারদেরও ভুল হয়। ভুল হলেই এক লহমায় ভগবানের আসন নেমে আসবে নিচে আর তাঁদেরকে হেনস্তার শিকার হতে হবে, এই অসহনশীলতা একেবারেই ঠিক নয়, এটা পরিত্যাগ করতে হবে। এরপর তিনি বলেন, কেবলমাত্র করোনা কালেই নয়, প্রতিনিয়ত ডাক্তারদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোগীদের স্বার্থে কাজ করে চলতে হয় দিনের পর দিন বছরের পর বছর। ডাক্তার গাঙ্গুলী আরো বলেন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে সরকারি কার্যক্রমের অপ্রতুলতার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি খেলোয়াড়রা আজ খোলা মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এটা কখনো কাম্য নয়। সাধারণ দরিদ্র শ্রেণী তাহলে যাবে কোথায়? সরকারের ভূমিকাই বা কী? ডাক্তারিতে ভর্তির পরীক্ষা ‘নিট’ নিয়েও মৌলিক প্রশ্ন তোলেন তিনি। বারবার তিনি বলেন আমাদেরকে ভাবতে হবে একেবারে গোড়া থেকে। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভাবলে তবেই সার্বিক উন্নতি সম্ভব।

এদিনের চিকিৎসক দিবসের অনুষ্ঠান সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষিকা ডঃ শর্মিষ্ঠা শীল এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বিশিষ্ট কৃষি বিজ্ঞানী অনুসন্ধান কলকাতার চিফ অ্যাডভাইজার অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান।


শেয়ার করুন

সম্পর্কিত নিবন্ধ