ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে আলেম সমাজকে/ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল
মোঃ মোস্তফা কামাল : একদা স্পেন মুসলিম শাসনাধীন ছিল(৭১২-১৪৯২) দীর্ঘ সাত শত আশি বছর। ইতিহাসের পাতায় মুসলিম শাসনামলে কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এই কর্ডোভা। ক্রুসেড যুদ্ধে মুসলমানদের হত্যা করে তাদের বিভিন্ন আবিষ্কার অমুসলিমরা নিজেদের নামে চালিয়ে দেয় যা এখনো চলছে।এই দেশটি এখন মুসলিম শূন্য দেশ।১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে সুকৌশলে মুসলিম উৎখাত অভিযান শুরু হয়। স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ঘোষণা দেন স্পেনে মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না কিন্তু মুসলমানরা মসজিদ সংলগ্ন বিদ্যালয়গুলো(মাদ্রাসা )থেকে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করতে পারবে।ইতিহাস ভূগোল অঙ্ক বিজ্ঞান দর্শন শিক্ষা তারা গ্রহণ করতে পারবে না।মুসলমানরা ধর্মীয় শিক্ষার অধিকার পেয়েই খুশি ছিল।তার ফলশ্রুতিতে একটু একটু করে মুসলমানরা তাদের গৌরবময় ইতিহাস, বৈজ্ঞানিক চেতনা,সত্ত্বা ভুলে একটা নিষ্ক্রিয় গোলামে পরিণত হয়। কালক্রমে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আমাদের মাদ্রাসাগুলো থেকে বিজ্ঞান ভূগোল অঙ্ক দর্শন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ স্পেনের মুসলিম নির্মূলের ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও আলেম সমাজের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।এই আলেম সমাজ ছিল নির্ভিক বীর বিপ্লবী।তারা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল।তাই তো ইংরেজরা আলেমদেরকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করতো। সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রায় সাড়ে একান্ন হাজার আলেমকে ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়েছিল ইংরেজরা। দাঁড়ি টুপি দেখলেই তাদের ধরে ধরে ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে দিতো।কখনো শূকরের চামড়ায় ভরে সেলাই করে জলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করতো। কখনো কখনো শূকরের চর্বি তাদের শরীরে লাগিয়ে তারপর আগুন লাগিয়ে দিত।ঐ সময় শুধুমাত্র দিল্লিতেই পাঁচশ আলেমকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। তাদের রক্তে রঞ্জিত ভারতবর্ষ পরবর্তীতে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছিল।স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এই আলেমদের কেউ মূল্যায়ন করেনি। তাদের আর্থিক দূরাবস্থার কথা কেউ ভাবেনি। বরং তাদের অবদান অস্বীকার করা হয়।আলেম সমাজও গতানুগতিক ধর্মীয় শিক্ষার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষাকে অস্বীকার করেছে। ফলে, ক্রমশঃ আলেম সমাজ পরানুগ্রহ হয়ে জীবন ধারনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।হারিয়েছে তাদের গৌরব। হারিয়েছে তারা নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা।
একসময় যে আলেম সমাজ জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছে সেই আলেম সমাজের অনেককেই দেখা যায়, শিক্ষার নামে বেনামে রশিদ ছাপিয়ে জাকাত ফেতরা আদায় করে থাকেন জীবিকা নির্বাহ করতে। আলেমদের সম্মানসূচক কোনো আর্থিক সমাধান না হওয়ায় তারা হাত পাততে বাধ্য হোন। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। সমাজের শীর্ষ স্থানে যাদের অবস্থান করার কথা তারা আজ অসহায়, অপদস্থের জীবন যাপন করে। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে এরা অনেকেই স্বপ্ন দেখেন স্বল্প বেতনে কোনো মসজিদের ইমাম হওয়ার। বিয়ে পড়ানো, জানাজা পড়ানো, নামাজ পড়ানোর মতো কাজ করার। কারণ এছাড়া তাদের জন্য বিকল্প কোনো পথ নেই।অথচ মাদ্রাসা শিক্ষা এমন হওয়া উচিত ছিল যে, মাদ্রাসায় একজন ছাত্র ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করার পর পরের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন।একজন মাদ্রাসার ছাত্র জাতির নেতৃত্ব দিতে পারবেন। IAS ,IPS হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন। বিভিন্ন প্রশাসনিক সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন।আদর্শ ডাক্তার হতে পারবেন।বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন।দক্ষ রণবীর হতে পারবেন। আদর্শ রাজনৈতিক নেতা হতে পারবেন।জাতির নেতৃত্ব দিয়ে শতধা বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন। সমাজকে পথ দেখাবেন। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে!! কারণ ,স্পেনীয় ইহুদী খৃষ্টানদের ষড়যন্ত্রের শিকার আমাদের আলেম সমাজ।এর জন্য দায়ী আমাদের অজ্ঞতা, আমাদের অদূরদর্শিতা।
আজকাল তো আনাচে কানাচে প্রচুর মাদ্রাসা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কোন মাদ্রাসা থেকে কত ছাত্র ছাত্রী সরকারি কর্মকর্তা হতে পেরেছেন তার পরিসংখ্যান জানা আমার নেই।বিভক্ত জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে কতজন মৌলানা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়াজ তুলছেন সেটাও চোখে পড়ে না। জলসা মিলাদ মাহফিল,সোস্যাল মিডিয়া ইত্যাদি থেকে প্রায় সর্বত্রই আকছার দেখে থাকি এক মৌলানা আরেক মৌলানার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করছেন। এক মাযহাব অন্য মাযহাবের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন। একজন অন্যজনকে কাফের ফতোয়া দিয়ে হাততালি নিচ্ছেন। কতিপয় আলেম জালসার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা পকেটে পুরছেন। তাতে সমাজের কতটুকু লাভ হচ্ছে? বরং এতে সমাজ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে।এতো এতো মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে এতো এতো মৌলানা তৈরি হয়ে যদি সমাজকে কল্যাণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারেন, পক্ষান্তরে হাদীস কোরআন নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেন তাহলে এমন মাদ্রাসার প্রয়োজন কতটুকু তা জানার ইচ্ছে রইল।
কেউ কেউ বলতে পারেন ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে আমার এতো চুলকানি কেন?কেউ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করবেন কেউ বা বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করবেন আবার কেউ বা দর্শন ইতিহাস ভূগোল নিয়ে পড়বেন এতে আপত্তি কোথায়?তার জন্য তো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমি বলবো হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন কিন্তু বিগত বিভিন্ন কমিটির রিপোর্টে (সাচার কমিটি, অ্যাসোসিয়েশন স্ন্যাপ এবং গাইডেন্স গিল্ড, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষা রিপোর্ট)প্রকাশিত হয়েছে উচ্চ শিক্ষায় মুসলমানদের উপস্থিতি অতি নগণ্য। সেখানে সরকারের ঔদাসীন্যকেই তারা দায়ী করেছেন। কোনো সরকারই চাইনা মুসলমান সম্প্রদায় উন্নত হোক,তারা বিজ্ঞানী হোক,তারা ডাক্তার হোক,নেতা হোক বা নেতৃত্ব দিক। ঠিক যেমনটি স্পেন করেছিল।এই দেশে স্পেনীয় ব্লুপ্রিন্ট রচিত হয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সম্প্রতি আল আমিন মিশনের মতো কিছু মিশনের জন্ম হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে কিছু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের দেখা মেলে। সেখানেও সুকান্ত মজুমদারদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ ওরা চাই মুসলমানরা শুধুমাত্র ধর্ম নিয়ে থাকুক আর সারাজীবন ওদের দাসত্ব করুক। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ করে ওরা যেখানে সেখানে মরুক,জেল খাটুক কিন্তু যেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হতে পারে, জাতির নেতৃত্ব দিতে না পারে।এসব স্পেনীয় ষড়যন্ত্র বুঝতে হলে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করলে হবে না।ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।না হলে গোলামী করে আর হাত পেতে পরের দরজার কড়া নাড়াতে হবে।
মদীনায় থেকে হজরত মুহাম্মদ (স:) একাধারে যেমন ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করেছেন তেমনি একজন আদর্শ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। একজন দক্ষ রণবীরের ভূমিকা পালন করেছেন। অন্ধকারময় ছিন্ন ভিন্ন সমাজকে শুধু আলোর দিশা দেখাননি, তিনি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ন্যায় সাম্য ও মৈত্রী। জ্ঞান বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারায় অবগাহন করেছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু আজকে জ্ঞান বিজ্ঞানকে উপেক্ষা করে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা মুসলমানদের কতটা পিছিয়ে দিচ্ছে সেটা ভেবে দেখা দরকার। কোরআন যদি ‘সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা’ হয় তাহলে আমি মনে করি সম্পূর্ণ জীবন ব্যবস্থার সন্ধান যে গ্রন্থে রয়েছে তাকে অনুধাবন করতে এবং সমাজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে বিজ্ঞান, ইতিহাস ভূগোল দর্শনের শিক্ষা আবশ্যিকভাবে দরকার।নচেৎ বর্তমান যে ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তাতে শুধু তথাকথিত ডিগ্রিধারী আলেম তৈরি হবে কিন্তু শতধা বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার কোনো নেতা তৈরি হবে না।