NCERT পাঠ্যপুস্তক থেকে বাবরি মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণ আন্দোলনের ইতিহাস বাদ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে এদেশের সনাতনী করসেবকদের অপমান করেছে এনসিআরটি এবং মোদি সরকার!
সেখ ইবাদুল ইসলাম : লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে রাহুল গান্ধী বারবার বলছিলেন মোদি সরকার এবার বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলে সংবিধান বদলে দেবে। লোকসভা নির্বাচনে মোদি সরকার বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেনি ঠিকই সংবিধান বদল করেনি, কিন্তু বদলে দিয়েছে ভারতের ইতিহাস। ভারত সরকার পরিচালিত এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে বাবরী মসজিদের ইতিহাসই পাল্টে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নোত্তর আলোচনায় বলা হয়েছে অযোধ্যায় যেখানে এখন রাম মন্দির আছে সেখানে আগে কি ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরে এনসিইআরটি-র নতুন পাঠ্যপুস্তক বলছে, ‘‘সেখানে ছিল তিনটি গম্বুজওয়ালা এক স্থাপত্য। যা ১৫২৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল রামের জন্মস্থলে। যার দেওয়াল জুড়ে ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতীক এবং হিন্দু পুরাণের নিদর্শনের ছড়াছড়ি।’’
গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছে এনসিইআরটি (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং)-এর দ্বাদশ শ্রেণির এই ‘সংশোধিত’ পাঠ্যপুস্তিকা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ে চোখে পড়ার মতো সংশোধনী আনা হয়েছে অযোধ্যার অধ্যয়ে। পুরনো বইয়ে অযোধ্যার ইতিহাসের যে বিবরণ ছিল চার পাতা জুড়ে, নতুন বইয়ে তা শেষ করে দেওয়া হয়েছে দু’পাতাতেই। বাদ গিয়েছে বাবরি মসজিদ নাম। এবং আরও অনেক কিছু।এনসিইআরটি হল কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের অধীন একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা।
শুধু বাবরি মসজিদের ইতিহাস নয়, বাদ দেওয়া হয়েছে বিজেপির সোমনাথ থেকে অযোধ্যার রথযাত্রার কথা বাদ দেওয়া হয়েছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পেছনে কর সেবকদের ভূমিকার কথা, আর রথযাত্রারকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি হয়েছিল সেই ইতিহাসও বাদ দেওয়া হয়েছে এনসিইআরটির পাঠ্যপুস্তক থেকে। বাবরি মসজিদ ভাঙার দায়ে তৎকালীন বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ রাজ্যে কেন্দ্র সরকার যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছিল এমনকি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তৎকালীন বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন সেই ইতিহাসও বাদ দেওয়া হয়েছে।
এনসিআরটির নয়া ইতিহাসে বলা হয়েছে, ১৯৮৬ সালে ওই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপত্যের তালা খোলার পর যখন সেখানে কিছু মানুষকে প্রার্থনার অনুমতি দেয় ফৈজাবাদ আদালত, তখন হিন্দুরা অবহেলিত বোধ করেছিলেন। বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘হিন্দুরা মনে করেছিলেন, রাম জন্মভূমি এবং ভগবান শ্রীরামকে নিয়ে তাঁদের আবেগকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অন্য দিকে মুসলিম সম্প্রদায় চেয়েছিল ওই স্থাপত্যের উপর তাঁদের অধিকার কায়েম করতে।’’
উল্লেখ্য এনসিইআরটির পাঠ্যক্রম পুরোপুরি মেনে চলে সিবিএসই বোর্ড। আইসিএসই এবং আইএসই বোর্ডও কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে। একইসঙ্গে বর্তমান সময়ে দেশের সমস্ত রাজ্যের নিজস্ব বোর্ডগুলো এনসিআরটি তৈরি করা সিলেবাসকে অনুসরণ করেই পাঠ্যপুস্তক রচনা করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে প্রভাব না পড়লেও অন্যান্য রাজ্যের বোর্ডগুলির সিলেবাসেও এর প্রভাব পড়া সম্ভবনা রয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, বাবরি মসজিদের ইতিহাসকে ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে বা আগামী প্রজন্মের কাছে নতুন বার্তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এনসিআরটি নির্ধারিত দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যক্রমে অযোধ্যার অধ্যায়ে ফলাও করে লেখা হয়েছে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চের রায়ের কথা। অথচ পুরনো বইয়ে যেখানে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১৯৯২ সালে তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের সরকারকে আদালতের ভর্ৎসনার কথা লেখা ছিল, তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে দু’টি সংবাদপত্রের ছবিও। যার একটির শিরোনামে লেখা ছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য কল্যাণ-সরকারকে বরখাস্ত করা হল। অন্যটির শিরোনামে ছিল বাজপেয়ীর বক্তব্য। যেখানে তিনি বলছেন, ‘‘অযোধ্যা হল বিজেপির সবচেয়ে বড় ভুল’’।
রয়েছে শুধু শীর্ষ আদালতের রায়, যেখানে আদালতের বেঞ্চ বলছে, ‘‘যে কোনও সমাজেই দ্বন্দ্ব বা সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যে দেশে বহু জাতির বাস, সেখানে এই ধরনের সংঘাতের সমাধান হয় আইনি প্রক্রিয়ায়। দেশের সংবিধান সর্বধর্ম এবং বিশ্বাসের মানুষের প্রার্থনা করার অধিকারকে সম্মান করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অযোধ্যায় মসজিদ তৈরির অনেক আগে থেকেই ওই এলাকার সঙ্গে হিন্দুদের রাম জন্মভূমির বিশ্বাস জড়িয়ে ছিল। তার প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে।’’
বইয়ে লেখা হয়েছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হয়েছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ তৈরির জন্য দেওয়া হয়েছে আলাদা জমি। আর এই সিদ্ধান্ত সমাজের অধিকাংশ মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন। স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে কী ভাবে দু’পক্ষের সম্মতিক্রমে গণতান্ত্রিক ভাবে সমাধান করা যায়, তার ধ্রুপদী উদাহরণ হল অযোধ্যার রায়।’’
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের পর এই নিয়ে চতুর্থ বার সংশোধন করা হল এনসিইআরটির দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক।
মোদি সরকার যেভাবে দেশের ইতিহাসকে বদলে দেওয়ার চেষ্টা করছে তার বিরুদ্ধে সাধারন নাগরিকদের সরব হওয়া প্রয়োজন বলে সুশীল সমাজ মনে করছে। বাবরি মসজিদের ইতিহাস থাকা উচিত বলে আমাদের মনে হয়েছে। যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে আজকের রাম মন্দির তৈরি হয়েছে তা অবশ্যই আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন বলে আমাদের মনে হয়েছে। কিন্তু এনসিআরটি কর্তৃপক্ষ যেভাবে ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে বর্তমান সময়ের ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে রাম মন্দির আন্দোলনের ইতিহাসকে তোলা হয়নি। তাতে আর যাই হোক সেই সকল রামভক্ত কর সেবকদের অপমান করা হয়েছে যারা রক্ত দিয়ে রাম মন্দির তৈরি করার চেষ্টা করে গিয়েছেন। যারা পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন রাম মন্দির তৈরি করার জন্য বাবরি মসজিদকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে সেই সকল মহান শহীদদেরকে অপমান করেছে এন সি ই আর টির কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উচিত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠা। কারণ দীর্ঘ আন্দোলন করে রক্ত দিয়ে যারা রাম মন্দির তৈরি করলেন তাদের নাম কেন ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে না? এটাই হচ্ছে নয়া ভারতের নতুন ট্রাজেডি।