অন্যান্য কলকাতা 

‘আস সওমু লি,রোজা আল্লাহর জন্য’ : এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব বর্ণনা করলেন ড.আবু তাহের কামরুদ্দিন

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সল্টলেকে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ভবনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের অফিস বিল্ডিং। এরই বেসমেন্টে রয়েছে একটি নামাজ ঘর। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন ডক্টর আবু তাহের কামরুদ্দীন। প্রতি শুক্রবার জুম্মার নামাজে খুতবা দেওয়ার আগে তিনি দেশ তথা বিশ্বের সমকালীন পরিস্থিতি, জাতি গঠনে শিক্ষা গুরুত্ব , বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আধুনিক চিন্তা চেতনা, মনন, সামাজিক ধ্যান-ধারণা এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে কোরআন হাদিসের আলোকে মানবিকবোধ সম্পন্ন জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিয়ে থাকেন। এবছর রমজান মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় জুম্মায় তিনি বলেছেন, আরবি বারোটা মাসের মধ্যে নবম মাস রমজান । এটি একটি পবিত্র মাস, এক মর্যাদাপূর্ণ মাস, এক ইবাদতের মাস ও এক আত্মশুদ্ধির মাস।এই পবিত্র রমজানুল মোবারক এর ফজিলত, তাৎপর্য ও গুরুত্বের বিষয় বলতে গিয়ে তিনি বলেন ,এই রমজান সম্পর্কে আল্লাহ কি বলেছেন । আল্লাহর কি উদ্দেশ্য রয়েছে এবং বান্দাকে তিনি কিভাবে পরিশুদ্ধ করিয়ে নেবেন।

এই রমজান মাসে আল্লাহ প্রত্যেক সুস্থ স্বাভাবিক মুসলিম নরনারীর জন্য রোজাকে ফরজ করেছেন। এবাদত আমরা অনেকগুলো করি যেমন কলেমা, নামাজ, হজ ,যাকাত ইত্যাদি।তবে একমাত্র রমজান ছাড়া আর কোন এবাদতের কথা আল্লাহ কুরআনে এত বিস্তারিত বলেন নি। তিনি এর ব্যাখ্যা স্বরূপ বলেন ,আল্লাহর নামাজের আদেশ দিয়েছেন কিন্তু কোরআনের কোথাও বলা নেই ফজর, যোহর ,আসর, মগরিব এবং এশার কত রাকাত নামাজ হবে। আমরা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক হজ পালন করি কিন্তু আল্লাহ কোরআনে কোথাও বলে দেননি হজ করতে গেলে সাফা মারওয়া পাহাড়ে যাতায়াত করা, সাতবার তাওয়াফ করতে হবে, শয়তানকে ঢিল মারতে হবে ইত্যাদির কথা । আমরা যাকাত দিই। যাকাতের হিসাব সয়ে আড়াই পারসেন্ট অর্থাৎ ১০০ টাকায় আড়াই টাকা। এই হিসাবটা কোরআন পাকে কোথাও নেই। এখন প্রশ্ন হল তাহলে এগুলো পেলাম কি করে ?তিনি বলেন, হযরত মুহাম্মদ সা: যিনি আল্লাহর পরম বন্ধু এবং শরীয়তের প্রণেতা তিনি আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক যেভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ,বলেছেন ঠিক সেই ভাবেই আমরা নামাজ, হজ্জ ,যাকাত পালন করে আসছি।

Advertisement

তবে বিস্ময়ের বিষয়ে এই যে একমাত্র রোজা যার সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে বিস্তারিতভাবে বলেছেন। এর জন্য সম্পূর্ণ একটা রুকু ব্যয় করে দিয়েছেন আল্লাহ। সূরা বাকারায় রমজান সম্পর্কে বেশি বেশি বলা আছে ।১৩৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন ,যে আমি আমার পূর্ববর্তী উম্মতদের মতো তোমাদের উপর রোজাকে ফরজ করে দিলাম যাতে করে তোমরা তাকওয়া এবং মুত্তাকী অর্জন করতে পারে। তারপরে রয়েছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা। কখন রোজা রাখবেন, কখন রাখবেন না, সফরে থাকলে কিভাবে রোজা রাখবেন, অসুস্থ থাকলে তার জন্য কি বলা হয়েছে ,কখন রোজা শুরু করবেন, কখন শেষ করবেন, কিভাবে ইফতার করবেন ইত্যাদি সবিস্তারে আল্লাহ কোরানে বর্ণনা করেছেন। কোরানে আল্লাহ নামাজ হজ্জ-যাকাত সম্পর্কে বলেছেন তবে এত বিস্তারিতভাবে বলেননি। আর সেজন্যই রোজার এত গুরুত্ব।

পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের দফতরে আয়োজিত জুম্মার নামাজের খুতবা দিচ্ছেন সভাপতি ড. আবু তাহের কামরুদ্দীন

তিনি বলেন, খুব স্বাভাবিকভাবে আমাদের মনে প্রশ্ন এসে যায় নামাজ ,হজ, যাকাত নিয়ে আল্লাহ এত বিস্তারিতভাবে বললেন না কিন্তু রোজা নিয়ে কেন এত বিস্তারিত ভাবে কোরানে বললেন। কারণ রোজার সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন , “আস সওমু লি” অর্থাৎ রোজা আমার জন্য কিন্তু আল্লাহ কোরআনের কোথাও বলেননি আস সালাতু লি , অর্থাৎ নামাজ আমার জন্য। আল হাজ্জো লি অর্থাৎ হজ আমার জন্য। আজ জাকাতু লি অর্থাৎ জাকাত আমার জন্য । যদিও সব এবাদতই আল্লাহর জন্য।

‘আস সওমু লি অর্থাৎ রোজা আল্লাহর জন্য ‘কথাটি তাৎপর্য বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন রামাদান শব্দটি এসেছে রামস ধাতু থেকে। রামস ধাতুর অর্থ হল পুড়িয়ে দেওয়া, জ্বালিয়ে দেওয়া অর্থাৎ যদি কেউ আল্লাহর নির্দেশিত পথ ও মতকে অনুসরণ করে সঠিকভাবে রোজা পালন করতে পারে তাহলে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহকে ওইভাবে ভস্মিভূত করবে যেমন আগুন কাটতে জ্বালিয়ে দেয়। অন্যান্য এবাদতের থেকে রমজানুল মোবারকের গুরুত্ব আল্লাহর কাছে অনেক বেশি । তবে যে কোন এবাদতের দুটি দিক থাকে। একটা বাহ্যিক আর অপরটি হল আভ্যন্তরীণ। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন কোন বেনামাজি হঠাৎ করে কোন একটা মজলিসে উপস্থিত হয়ে পড়েছেন। পরিস্থিতির চাপে পড়ে অজু থাক আর না থাক সে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় লোক লজ্জার খাতিরে। কারো কাছে অনেক টাকা-পয়সা ধন সম্পদ রয়েছে যদি হজ না করেন তাহলে লোকে কি বলবে এই ভেবে হজ পালন করলেন । আল্লাহর জন্য করলেন এবং লোক দেখানোর জন্য ও করলেন। যাকাত যদি না দিই তাহলে লোকে কি বলবে। বলবে এত টাকার মালিক গরিবদের যাকাত দেয় না। তারপর শাড়ি কাপড় কিনে গরিবদের ডেকে মহা আড়ম্বরের সাথে আমরা বিলি করতে থাকি, ছবি তুলি, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করি। তাহলে এটা একদিকে যেমন লোক দেখানো হলো আবার অন্যদিকে আল্লাহর জন্য হলো। কুরবানীর জন্য আমরা খাসি, উট কিংবা গরু কিনে গলায় মালা দিয়ে মহল্লা ঘোরাচ্ছি যাতে লোকে বলে অমুকের কুরবানীর জীব। এর পেছনে সুপ্ত ভাবে লুকিয়ে থাকে আমাদের নাম কামানো এবং আত্ম অহংকারের সুপ্ত বাসনা।

তবে একমাত্র রোজা এমন এক ইবাদত যার বাহ্যিকতা নেই । এ পৃথিবীতে কেউ বা কোন পাগল ও না খেয়ে সারাদিন থাকবে না । কেউ যদি রোজা না করে, তাহলে লুকিয়ে খেয়ে নেবে এবং তার পরিবারের এমনকি কেউই জানতে পারবে না। কিন্তু আমরা তা করি না। হয় রোজা রাখি, তা না হলে রাখি না। তাই রমজান হলো একমাত্র সেই এবাদত যার মধ্যে লোক দেখানো নেই আর সেই জন্যই আল্লাহ বলেছেন রোজাটা আমার জন্য। রমজান মাসে রোজা যারা রেখে থাকে তারা আল্লাহর জন্যই রেখেছেন তারা লোক দেখানোর জন্য রাখেননি কারণ লোক দেখানো সে নামাজ পড়তে পারে, হজ করতে পারে, যাকাত দিতে পারে, কুরবানী দিতে পারে, কিন্তু লোক দেখিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খালি পেটে কোন পাগল থাকতে পারবে না। তাই আল্লাহ কোরআনে বলেছেন রোজাদারদের জন্য আমি নিজ হাতে পুরস্কার দেব আবার কোন কোন আয়াতে রয়েছে ,আল্লাহ বলেছেন রোজাদারদের জন্য আমি স্বয়ং নিজেই পুরস্কার। সমস্ত দপ্তর আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন।একমাত্র রোজাদারদের নেকি আল্লাহ বলেছেন আমি নিজে দেবে। আমার যা খুশি উজাড় করে দেব আমার রোজাদার বান্দাদের ।তাহলে বুঝুন ,আল্লাহ কত তার দয়ালু এই রোজাদারদের উপর। সূরা রহমান এ বলা আছে, রোজাদারদের সম্মানে আল্লাহ জান্নাতের রায়হান নামে একটি গেট বানিয়েছেন ।সেই গেট দিয়ে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করতে পারবে। আমরা সৌভাগ্যবান কারণ সেই রমজান মাসে আমরা অবস্থান করছি। তিনি আরো বলেন শুধু খালি পেটে থাকা মানেই রোজা নয়। যেহেতু এই রমজান মাসে কোরআন নাজিল হয় তাই বেশি বেশি করে কোরআন পাঠ করা, নামাজ পড়া এবং অন্যান্য এবাদতে নিযুক্ত রাখা প্রত্যেক রোজাদারদের উচিত।

এই বিজ্ঞান প্রযুক্তির ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান এর যুগে রোজার গুরুত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন ২০২০ সালে জাপানের বিজ্ঞানী অটোপসি রোজাকে নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন । তিনি তার গবেষণায় বলেছেন,মানব শরীরে মৃত কোষ থাকে যেগুলো শরীরে জমে ক্যান্সারের মতো জটিল কঠিন রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। রোজায় উপবাস থাকার ফলে অন্যান্য কোষ ওই ক্ষতিকর কোষগুলোকে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে। এর ফলে আমরা অনেক শারীরিক রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পাই। রোজার উপর এই গবেষণা করে জাপানের জীববিজ্ঞানী আজ নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। অথচ আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আল্লাহপাক তার রাসূলের মাধ্যমে রমজানুল মোবারকের মধ্যে একদিকে আধ্যাতিকতা ,আত্মশুদ্ধি ,তাকওয়ার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি অন্যদিকে প্রিয় বান্দারা যাতে সুস্থ সবল থাকে তার কথা চিন্তা করে রোজার বিধান দিয়েছেন। পরিশেষে তিনি বলেন দয়াময় আল্লাহ আমাদের সকলের রোজাকে কবুল করুন।

অনুলিখন মতিয়ার রহমান।

বক্তা পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি। বক্তব্যটি লিখেছেন বিশিষ্ট শিক্ষক মতিয়ার রহমান।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ