অখন্ড বাংলার সমাজ-চিত্র বাঙালির সাহিত্যে উঠে আসেনি : অনুসন্ধান আয়োজিত ভাষা দিবসের আলোচনায় মিলন দত্ত
নিজস্ব প্রতিবেদন : ভাষা দিবসের ভরা সন্ধ্যায় এক অসাধারণ আলোচনার সাক্ষী হয়ে রইল বাঙালি সমাজ। প্রযুক্তির বদান্যতায় অনলাইনের হাত ধরে ‘বাঙালি লেখক ও বাঙালির সাহিত্য’ শীর্ষক এই আলোচনা অবশ্য পৌঁছে গেল ওপার বাংলা সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে প্রশ্ন উঠে গেল বাঙালির সাহিত্যে বাংলার সমাজ-চিত্র কী সত্যিই যথাযথভাবে পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়া গেছে, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের জনপ্রিয়তা কীভাবে আবার ফিরবে কিংবা লোকগান-জারিগান কী বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়! এই সমস্ত বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান কলকাতার এ দিনের আয়োজনে মন খুলে কথা বলেন আলোচকবৃন্দ। শুরুতেই মিলন দত্ত বলেন, একজন লেখক মূলত সমাজের ছবি আঁকেন এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছবি বিধৃত হয় তাঁর হাতেই, এটাই আমাদের বিশ্বাস। এখন তিনি যদি গোটা সমাজের ছবি না আঁকতে পারেন, তাঁর লেখায় যদি সমাজের সমস্ত অংশ প্রতিফলিত না হয়, তাহলে তাঁকে গোটা লেখক বলা যায় কীভাবে! একটা সমাজ তৈরি হয় বিভিন্ন গোষ্ঠী, বর্ণ, ধর্ম নিয়ে। আমাদের বাঙালি সমাজে হিন্দু, মুসলমান, দলিত এবং একটি ছোট্ট অংশ খ্রিস্টান আছে। অথচ বাঙালি লেখক হিসেবে আমরা যাদেরকে পাই, তাঁদের লেখায় সকল শ্রেণির সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায় না। কবিগুরুর সহজ পাঠ-এর মতো শিশু পাঠ্যেও তার অনেক খানি অমিল। সম্পূর্ণ বইয়ে মাত্র দুজন মুসলমান চরিত্র – তামিজ মিয়া আর জয়নাল। তিনি আরো বলেন, আধুনিক কালের লেখকদেরও অবস্থায় যে খুব একটা হেরফের ঘটেছে, এমনটা বলা যায় না।
মিলন দত্ত
গ্রাম-অঞ্চলের ছবিও তেমনভাবে পাওয়া যায় না তাঁদের লেখায়। কারণ লেখা শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা চলে এসেছেন কলকাতায় বা বিভিন্ন শহরাঞ্চলে। ফলে তাঁদের লেখনীতে কখনোই সমাজের সামগ্রিক চালচিত্র ধরা পড়ে না। বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসের এই আয়োজনে মিলন বাবু সকলের নিকট বিনীতভাবে প্রশ্ন করেন, তাহলে সম্পূর্ণ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন এমন বাঙালি লেখক কে আর তেমন বাংলার সাহিত্যই বা কোথায়! কেন এই অবস্থা! আমরা কী খন্ডিত এই সমাজ চিত্রে সত্যিই লজ্জিত? এই প্রসঙ্গে তিনি ফাদার দ্যাতিয়েনের কথা তুলে ধরেন। সুদূর বেলজিয়াম থেকে যিনি কোলকাতায় এসে বাংলা শেখেন এবং বাঙালি সমাজের সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটান তাঁর সাহিত্য রচনায়। ফাদার দ্যাতিয়েনের নিষ্ঠা, পর্যবেক্ষণ, পরিবেশন, সৃজনশীলতা আমাদেরকে অনেক কিছু শেখায়।
দিব্য গোপাল ঘটক
এদিন আলোচনাচক্রে উপস্থিত ছিল বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকেরা। ফলে বারবার উঠে আসে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের বর্তমান হাল-হকিকত নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা। পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বলতেন, বাংলা শিখতে গেলে ততোধিক ইংরেজি শিখতে হবে। এই কথার রেশ ধরে বিশিষ্ট শিক্ষা আধিকারিক (অবসরপ্রাপ্ত) দিব্য গোপাল ঘটক বলেন শুধু কথা বললে হবে না, বাংলা মাধ্যমের পড়াশোনা জনপ্রিয়করণে কাজ করতে হবে, প্রয়োজনে এর জন্য আন্দোলন করতে হবে। মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করছি খুব সোরগোল করে অথচ বাংলা ভাষার বিদ্যালয় ক্রমশঃ ক্ষিয়মান।
বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত
এদিন আলোচনায় অংশ নেন ড. দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ দে, বিশ্বনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ। লোকসংগীত পরিবেশনে ছিলেন প্রদ্যুৎ বিশ্বাস এবং সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক শুভজিৎ পাত্র।
ড. দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
এদিন অনলাইনেই প্রকাশিত হয় ভাষা দিবসের বিশেষ একটি সংখ্যা। বিশিষ্ট প্রধান শিক্ষক এবং অনুসন্ধান কলকাতার সহ-সভাপতি শেখ আলী আহসান এই সংখ্যাটির সম্পাদনা করেছেন।
পার্থ দে
অবশেষে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা করেন অনুসন্ধান কলকাতার সহ-সম্পাদক শুভজিৎ মাইতি। বিজয়ী প্রত্যেককে উপহার পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে এদিনের অনুষ্ঠানের যবনিকা টানেন তিনি।