‘দেশকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন’ – রাজনৈতিক দলগুলোকে আত্মসমীক্ষার আহ্বান জামাআতে ইসলামীর
বিশেষ প্রতিনিধি : সদ্য সমাপ্ত কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইস্তেহারে যেসব কথা বলেছে এবং ভোটের ফলাফলের নিরিখে জাতীয় রাজনীতি কোন অভিমুখে এগোচ্ছে – সে সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জামাআতে ইসলামী হিন্দ। প্রতি মাসের মতো ডিসেম্বরেও দিল্লিতে জামাআতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রুটিন সাংবাদিক বৈঠক হয়ে গেল। উপস্থিত ছিলেন জামাআতের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক সেলিম ইঞ্জিনিয়ার, সহ-সভাপতি মালিক মুতাসীম খান ও মিডিয়া সেক্রেটারি কে.কে সুহাইল প্রমুখ।
মিজোরামকে বাদ দিয়ে বাকি চার রাজ্যের নির্বাচন প্রসঙ্গে মালিক মুতাসীম খান বলেন, আমরা বিজিত এবং পরাজিত উভয় পক্ষকেই তাদের রাজনৈতিক দর্শনের মূল্যায়ন বা আত্মবিশ্লেষণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। কারণ, দেশের সাংবিধানিক মূল্যবোধের ওপর এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে যেভাবে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও বিভাজনের কৌশল নেওয়া হয়েছে তা গভীর উদ্বেগজনক। যে বিজেপি তিনটি রাজ্যে জয়ী হয়েছে, তারা কোথাও একজনও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি। জাতপাত ও ধর্মের ভিত্তিতে ভোটারদের আড়াআড়ি বিভাজন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে শীর্ষ নেতারা লাগাতার সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েছেন। বিরোধীরা কেবল তাদের প্রতিক্রিয়া দিয়েই দায় সেরেছে এবং গুরুতর এই বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্বই দেয়নি। এতে তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্কতা বা অদূরদর্শিতা প্রকট হয়েছে। পরিণতিতে বিরোধীরা পরাজিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পূর্ব প্রস্তুতির অভাব, গাফিলতি, নির্বাচনী প্রচারে বক্তা বাছাইয়ে ত্রুটি এবং সর্বোপরি প্রার্থী বাছাইয়ের মানদণ্ডে ভুল থাকায় বিরোধীদের দুর্বলতা প্রকট হয়েছে। দাক্ষিণাত্যে তেলেঙ্গানায় বিপুল সাফল্য পেলেও হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে ব্যর্থতা থেকে কংগ্রেসকে শিক্ষা নিতে হবে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য দিক হল সাংবিধানিক মূল্যবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতি-ধর্ম ও শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকার এর মতো ইস্যুগুলিতে প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে অটুট থাকতে না পারলে বিরোধীরা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে না। তাঁর কথায়, শরিকদের মধ্যে সুষ্ঠু আসন সমঝোতা বা আসন বণ্টন সুনিশ্চিত না হওয়া এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
পাশাপাশি বিজেপিকে তাদের পলিসি এবং দেশ ও জাতি গঠনের পথ-পদ্ধতি সম্পর্কে আত্মবিশ্লেষণ করার আহ্বান জানিয়ে মুতাসীম খান বলেন, আপনারা সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা এবং মুসলিম তথা সংখ্যালঘুদের প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষমূলক নীতি পরিহার করুন। একইসঙ্গে এক আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণে মুসলিমদেরকে সর্বাত্মক প্রয়াস চালানোর আরজিও জানান তিনি।
এদিকে উচ্চশিক্ষায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়া প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে জামাআতের মিডিয়া সেক্রেটারি কে.কে সুহাইল বলেন, ১৮ থেকে ২৩ বছরের মুসলিম পড়ুয়ারা উচ্চশিক্ষা থেকে বিমুখ হচ্ছে। এহেন নেতিবাচক প্রবণতায় জামাআতে ইসলামী চিন্তিত। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই মুসলিমদের একাংশ স্কুলছুট হচ্ছে, বড়জোর নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত তারা এগোচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম পড়ুয়াদের এমন নিম্নমানের প্রতিনিধিত্ব বা অংশগ্রহণ খুবই দুঃখজনক বলে অভিহিত করে তিনি বলেন, আপার প্রাইমারিতে যেখানে দেশের সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ৬ কোটি ৬৭ লক্ষ, সেখানে মুসলিমদের ভর্তির হার মাত্র ১৪.৪২ শতাংশ। মাধ্যমিক স্তরে ১২.৬২ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আরও কম, ১০.৭৬ শতাংশ। রিপোর্ট বলছে, উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও মুসলিম পড়ুয়াদের ১৮.৬৪ শতাংশ ড্রপ আউট বা মাঝপথে স্কুল ছেড়ে দিচ্ছে। অথচ ড্রপ-আউটের ক্ষেত্রে জাতীয় গড় ১২.৬ শতাংশ। অর্থাৎ মুসলিমদের ক্ষেত্রে জাতীয় গড়ের থেকেও ৬ শতাংশ কম।
সুহাইল সাহেব বলেন, এই নিম্নগামী পরিসংখ্যানকে মাথায় রেখে জামাআতে ইসলামী হিন্দ মনে করছে, যেসব মুসলিম পরিবার অর্থাভাবে তাদের ছেলেমেয়েদেরকে উচ্চশিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে না পারায় শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে বাধ্য হচ্ছে, তাদেরকে আর্থিক সাহায্য করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের কাছে তাঁর আবেদন যাতে শিক্ষায় স্কলাপশিপ, ভাতা, বৃত্তি বা অন্যান্য সহায়তা প্রকল্প আরও বাড়ানো যায়, রাজ্য এবং কেন্দ্র উভয় সরকার এ ব্যাপাকে সদর্থক পদক্ষেপ করুক। যাতে আর্থিকভাবে অনগ্রসর মুসলিম পরিবারগুলোর অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা কিছুটা দূরীভূত হয়।
জামাআতের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি অধ্যাপক সেলিম ইঞ্জিনিয়ার মারকাযী মজলিসে শূরা বা কেন্দ্রীয় পরামর্শ পরিষদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এই সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। উল্লেখ্য, ২৪-২৬ নভেম্বর গুজরাটের আহমেদাবাদে তিনদিন ধরে শূরার মিটিং হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘকে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপে আহ্বান জানানো হয়। দেশীয় পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর আয়ের উৎসের ব্যাপারে ইলেক্টোরাল বন্ডে স্বচ্ছতা আনা এবং আমলাদের রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার রুখতে কেন্দ্রীয় সরকারকে আবেদন জানানো হয় বলে জানান তিনি।