“ আওয়াজ “ সংগঠন যা করা যেতে এক দশক পূর্বে , তাই-ই হলো অবশেষে ! এ-ও কি এক মহা ভুল ? : ড. আবদুস সাত্তার
১ লা ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুবকেন্দ্রে মূলত বামপন্থী সংখ্যালঘু সমাজের বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে ‘ আওয়াজ ‘ নামে এক সংগঠনের জন্ম হলো । ২০০৬ সালে সাচার প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল সিপিআই( এম)-র সংখ্যালঘু নেতাদের একাংশ দাবি করেছিলেন দলের অভ্যন্তরে শাখা সংগঠন হিসাবে এক সংগঠন গড়ার ; কিন্ত শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের চাপেই তা সম্ভব হয়নি । এমনকি জ্যোতিবাবু নিজেও দলের অভ্যন্তরে মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা ফোরামের পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন । তা সত্ত্বে আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, হাসিম আবদুল হালিম, মুহাম্মদ মসিহ ও আবদুস সাত্তারদের দাবি মেনে ‘ আওয়াজ ‘ নামে সংগঠন করতে দেওয়া হয়নি । আজ পার্টি ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা । রেজ্জাক মোল্লা দলে নেই , নেই মইনুল , নেই আবদুস সাত্তার , নেই হালিম সাহেব এমতাবস্থায় জন্ম হল সেই কাঙ্খিত ‘ আওয়াজ ‘-এর । এই প্রেক্ষাপটেই আমরা কথা বলেছিলাম ‘ আওয়াজ ‘ সংগঠন গড়ে তোলার নেপথ্যের অন্যতম কারিগর ড. আবদুস সাত্তারের সঙ্গে । তাঁর দেওয়া এ বিষয়ের সাক্ষাৎকারটি দুটি কিস্তিতে প্রকাশিত হবে । আজ শেষ কিস্তি ।
প্রথম কিস্তির পর –
ছয় . রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্য বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতেন । সংখ্যালঘু মুসলিমরা যে পিছিয়ে আছেন , তাদের জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে সেই বিষয়টি বারংবার বলতেন । বহুক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র , তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অর্থ বরাদ্দ কাটছাঁট করে সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরকে দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন । এমন কী পার্টির সব থেকে বড়ো সংখ্যালঘু নেতার আপত্তি অগ্রাহ্য করে ভারতের সব থেকে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসাকে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । তাঁর সদিচ্ছার বিবরন লিপিবদ্ধ আছে –‘ সংখ্যালঘু উন্নয়ন ‘ শীর্ষক সরকার কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকায় । গবেষক-অনুসন্ধানী পাঠক স্বাধীনতা পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে যতগুলি মন্ত্রিসভা হয়েছে , তার মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন ২০০৬-২০১১ মন্ত্রিসভা সংখ্যালঘু উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন ব্যতিক্রমী তার বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা অবশ্যই করতে পারেন । শিক্ষিত-সংস্কৃতিপ্রবণ এই মানুষটির প্রশংসা অবশ্যই প্রাপ্য । অথচ নিয়তির পরিহাস এই যে , সংখ্যালঘু মুসলিমদের দ্বারা তিনিই সবথেকে বেশি নিন্দিত হলেন !
তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আট বছর অতিক্রম করেছে । এটাই তো সূবর্ণ সময় তুলনামূলক আলোচনা করার । হোক না বস্তুনিষ্ঠ সামগ্রিক আলোচনা ; ইতিহাসের কষ্ঠিপাথরে সবই যাচাই হয়ে যাবে । নিউটাউনে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও তৃতীয় হজ্ব হাউস নির্মাণ ছাড়া সংখ্যালঘু মুসলিমদের জীবন মানের আর কোন উন্নয়ন এই সরকার করেছে ? আবার এ-ও মনে রাখতে হবে, নিউটাউনের শহর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারেরই দান । সংখ্যালঘু মুসলিমদের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা বির্তক থাকতেই পারে । কিন্ত একটি বিষয়ে বির্তকের কোন অবকাশ নেই যে , তৃণমূল সরকারের এই আট বছরের কাজ-কর্মে মৌলবাদ সাম্প্রদায়িক শক্তি রাজ্যে এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশা বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে । এর ফলে সংখ্যালঘুদের জান -মাল ঈমানের নিরাপত্তা আজ এক বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখোমুখি ।
সাত . একদিকে সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে বামফ্রন্টের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম অপরদিকে এই সমস্ত গঠনমূলক কাজকে সাচার প্রতিবেদন-এর মাধ্যমে ‘ কিছুই হয়নি ‘-এর তত্ত্বকে সামনে রেখে বিরোধী দলগুলি পুঁজি-পোষিত সংবাদ-মাধ্যমে মানুষকে নানা ভাবে ভুল বোঝানোর কাজ করে চলেছে ।
জোর কদমে শুরু হয়েছে ধর্মকে রাজনীতির আঙিনায় যুক্ত করার খেলা । এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরার জন্য পার্টির ‘ অনুমোদনহীন ‘ একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্ম আমি দিতে বাধ্য হলাম । নাম : আওয়াজ । যদিও এটি সরকারী নিবন্ধীকরন কোনো সংগঠন ছিল না ।
আট . অবিভক্ত অন্ধপ্রদেশ সি.পি.আই (এম) সংখ্যালঘু মানুষের নিরাপত্তা, উন্নয়ন সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ‘ আওয়াজ ‘ নামে একটি সংগঠন গঠন করেছিল । সেই সংগঠনের সভায় বার কয়েক আমন্ত্রিত হয়ে আমি গিয়েছিলাম । এমন কী হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত গান্ধী ভাবনে রাজ্যব্যাপী কনভেনশনেরও উদ্বোধন করেছিলাম । সেই নামেই এই রাজ্যের ক্ষেত্রেও নামকরণ করেছিলাম । এক সময়ে বামফ্রন্ট সরকারের প্রবল বিরোধী পশ্চিমবঙ্গ মাদ্রাসা ছাত্র ইউনিয়নের রাজ্যস্তরের পদাধিকারীগণ পরবর্তীকালে সংখ্যালঘু ও মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নের কাজকর্মে উৎসাহী হয়ে তাঁরা আমার সাথে যুক্ত হন । আমার পরামর্শ , সাহায্য-সহযোগিতায় শহিদুল ইসলাম , ড. ফজলুর হক মন্ডল ,আতিয়ার রহমান , শাহনওয়াজ হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘ আওয়াজ ‘ ।
বসিরহাট-এর পীরসাহেব সরফুল আমিন ও তাঁর পুত্র খোয়াইব আমিনও এর সঙ্গে যুক্ত হন । নেপথ্যে থেকে উৎপল দাসও নানাভাবে সাহায্য করেন। নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায় শহিদুল ইসলাম । তাদেরই উদ্যোগে মুখ্যত উত্তর ২৪ পরগণার ব্লক স্তরে এই সংগঠন ভালোই সাড়া জাগিয়েছিল । সীমিত সামর্থ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বেশ কিছু সভার আয়োজন করাও সম্ভবপর হয় । ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে কেন্দ্রীয়ভাবে বসিরহাট টাউন হলের মাঠে ও বারাসতের রবীন্দ্র ভবনে বামফ্রন্টের সমর্থনে এক উপচে পড়া জমায়েত হয়েছিল ।
গৌতম দেব , অমিতাভ বসু , অমিতাভ নন্দীসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলেন । বসিরহাটের সভায় হজরত মহম্মদ (সাঃ)কে নিয়ে গৌতম দেবের করা একটি উক্তি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে সেই সময় বিরোধীরা বিরূপ প্রচারের অঙ্গও করেছিল ।
নয়. ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর সন্ত্রাস কবলিত হাড়োয়া বাজারে আওয়াজ-ই প্রথম এগিয়ে এসে সভা করেছিল । সভায় সাহিত্যিক আবুল বাশারও হাজির ছিলেন । কেননা, সেই সময় পার্টির ব্যানারে সভা করা সম্ভবপর হচ্ছিল না । পরবর্তীকালে এই সংগঠনকে আরো বিস্তৃততর রূপ দেওয়ার জন্য রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর এক সদস্যকে দু‘বার লিখিত প্রস্তাব প্রদান করা হয়েছিল । ‘ সমানাধিকার ‘-এর বিষয়টি ‘ প্রস্তাবিত নোট ‘-এ গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় আমাকে শুনতে হয়েছিল – মনে রেখো মুসলিমদের সমানাধিকার দিলে , এ দেশটাকে তারা পাকিস্থান বানিয়ে ছাড়বে ।মুসলিমরা তো কারো সঙ্গে থাকতে পারে না । দেখছ না পাকিস্থান, বাংলাদেশের কী অবস্থা ? মুসলমানরা তো তিনটে বিয়ে করে ইত্যাদি ।
দশ. ইতোমধ্যে রাজ্যের মানুষের মতামত নিয়ে বামফ্রন্ট সরকার : একটি পর্যালোচনা ‘ শীর্ষক দলিল রাজ্য সম্মেলনে গৃহীত হলো । সংখ্যালঘু প্রশ্নে উপার্জনশীল কাজে , রাজনৈতিক –সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সম্মিলিত করার ক্ষেত্রে খাটতির কথা উল্লেখ করে লেখা হলো-আসলে ষাটের দশক থেকে নিরাপত্তাজনিত বিষয়কে যে গুরুত্ব সহকারে আমরা বুঝলাম, নব্বই-এর দশকের পরবর্তী সময়ে ‘ পরিচয় ‘ ও ‘ অংশীদারিত্বে‘র যে দাবি উঠে আসে সে বিষয়ে যথার্থ অনুসন্ধান সাপেক্ষে রাজনৈতিক সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দূর্বলতা দেখা দেয় । এখন প্রশ্ন হলো, তারপরে আরো একটি রাজ্য সম্মেলন হয়েছে । রাজনৈতিক- সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কোনো দিক পরিবর্তন হয়েছে কি ?
এগোরো . পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সম্ভবত বছর দুই পূর্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল , দেশের সমস্ত রাজ্যে সংখ্যালঘুদের নিয়ে সমাজের অন্যান্য অংশের মতো একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলা হবে । বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে কেরালায় এই ধরনের সংগঠনের জন্ম হয় ও নির্বাচনে পার্টি প্রভূত পরিমানে লাভবান হয় । অথচ এখানে তা করা যায়নি । কেন এবং কী কারণে ?
বারো . যা করা যেতে এক দশক পূর্বে , তাই-ই হলো অবশেষে ! এ-ও কি এক মহা ভুল ? আবার, মূল্যায়ন হলেও রাজনৈতিক –সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সদিচ্ছা নীতিজনিত দৃষ্টিভঙ্গির কোনো মৌলিক পার্থক্য বিগত প্রায় চার বছরে রাজ্যের মানুষ বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিমরা দেখতে পেল না । দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি প্রকাশিত পুস্তিকায় আগামীদিনে রাজ্য সরকারে আসীন হলে কি করা হবে , তার কোনো দিকনির্দেশ কি আছে ? সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে যাবতীয় মৌলিক কাজ বামফ্রন্ট সরকার করেছে , তৃণমূল কংগ্রেস সরকার সেই অর্থে কিছু করেনি বলেই কি চুপ থাকবেন ! তৃণমূল কংগ্রেসের ইশতেহার-এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি কে , কোনদিন গুরুত্ব সহকারে দেখেছে ? তৃণমূল কংগ্রেস যা বলে তা করে না , যা বলে না তাই করে , এই তো অবস্থা ! সর্বোপরি নিরাপত্তার বিষয়টি । রাজ্যের বর্তমানে যা পরিবেশ তাতে করে সংখ্যাগুরুকেই ধরে রাখা যাচ্ছে না । বামফ্রন্টের ভোট শতাংশের হার তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের এই আট বছরের রাজনৈতিক রূপান্তরে এখন বিজেপি-র ঝুলিতে , অন্যদিকে বিজেপি-এর ভোট শতাংশের হার একটু কমবেশি বামফ্রন্টের ঝুলিতে ! আর সংখ্যালঘু মুসলিমদের কথন ! তবু , শতাব্দীর এক অন্তহীন আগুন নিয়ে আশায় বুক বাঁধি !