সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হলো ‘ তোমরা শুধু মুসলমান মুসলমান করছো , হিন্দুদের কথা তো একবারও ভাবছো না ? ‘ অতঃপর আর কিছু হওয়ার ছিল না : ড. আবদুস সাত্তার
১ লা ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুবকেন্দ্রে মূলত বামপন্থী সংখ্যালঘু সমাজের বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে ‘ আওয়াজ ‘ নামে এক সংগঠনের জন্ম হলো । ২০০৬ সালে সাচার প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল সিপিআই( এম)-র সংখ্যালঘু নেতাদের একাংশ দাবি করেছিলেন দলের অভ্যন্তরে শাখা সংগঠন হিসাবে এক সংগঠন গড়ার ; কিন্ত শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের চাপেই তা সম্ভব হয়নি । এমনকি জ্যোতিবাবু নিজেও দলের অভ্যন্তরে মুসলিমদের জন্য আলাদা একটা ফোরামের পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন । তা সত্ত্বে আবদুর রেজ্জাক মোল্লা, হাসিম আবদুল হালিম, মুহাম্মদ মসিহ ও আবদুস সাত্তারদের দাবি মেনে ‘ আওয়াজ ‘ নামে সংগঠন করতে দেওয়া হয়নি । আজ পার্টি ক্ষমতা হারিয়ে দিশেহারা । রেজ্জাক মোল্লা দলে নেই , নেই মইনুল , নেই আবদুস সাত্তার , নেই হালিম সাহেব এমতাবস্থায় জন্ম হল সেই কাঙ্খিত ‘ আওয়াজ ‘-এর । এই প্রেক্ষাপটেই আমরা কথা বলেছিলাম ‘ আওয়াজ ‘ সংগঠন গড়ে তোলার নেপথ্যের অন্যতম কারিগর ড. আবদুস সাত্তারের সঙ্গে । তাঁর দেওয়া এ বিষয়ের সাক্ষাৎকারটি দুটি কিস্তিতে প্রকাশিত হবে । আজ প্রথম কিস্তি ।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গে সব অংশের মানুষের জন্য থাকলেও সংখ্যালঘুদের বিষয়ে কথা বলার মতো সংগঠন বামপন্থীদের বিশেষত সিপিআই(এম)-এর ছিল না বলে আক্ষেপ করেছিলেন এবার ‘আওয়াজ‘ নামের সংগঠন তৈরি হলো । আবার ২০০৮ সালে রাজ্যে এই ‘ আওয়াজ ‘-এর জন্মও আপনি দিয়েছিলেন। কি বলবেন ?
ড. আবদুস সাত্তার : ঠিকই । আক্ষেপই বটে ! সম্ভবত প্রথম প্রকাশ্যে ২০১৬ সালের শারদীয়া ‘ গণশক্তি ‘তে ও আপনার গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকারভিত্তিক লেখায় বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম । রাজ্যে ‘ আওয়াজ ‘ নামাঙ্কিত সংগঠনটির একটা ইতিবৃত্ত রয়েছে । বিখ্যাত ইতিহাসবিদ এফ. ডব্লিউ মেইটল্যান্ড তাঁর ছাত্রদের বারংবার মনে করিয়ে দিতেন ‘ এখন যা অতীত তা এক সময় ছিল ভবিষ্যতে ।‘ এক্ষেত্রে তা হলো –
এক. সাচার প্রতিবেদন স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের মুসলিম মানসের এক করুণ অধ্যায় । শাসক দলের নিয়ত ও নীতির ক্ষেত্রে এক বড়ো প্রশ্ন চিহ্নও বটে । সারা দেশজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে উন্নয়নহীনতার এক সার্বিক ও বেদনা-বিধূর নির্মমতার তথ্যচিত্র । স্বভাবতই , প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশব্যাপী চারিদিকে আলোড়ন শুরু হয় । এই আলোড়নের ঢেউ পুঁজিবাদী সংবাদমাধ্যমের পরিকল্পিত লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে ভয়ঙ্করভাবে আছড়ে পড়ে । প্রচার করা হয় , বামপন্থীদের দীর্ঘ শাসনে মুসলিমরা সব থেকে বেশি অবহেলিত , সব থেকে বেশি বঞ্চিত । এও বলা হতে থাকে , কুখ্যাত দাঙ্গা পরবর্তী গুজরাটের মুসলিমরাও পশ্চিমবঙ্গের থেকে উন্নয়নের নিরিখে ভালো আছেন । অতএব সকলেই মুখর হলেন । শাসক দলের নেতারাও নানা মুখে নানা কথা বলতে থাকলেন । সব মিলিয়ে মুসলিম জনমানসে বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে এক ধরণের অনাস্থার পরিবেশের জন্ম হলো ।
দুই . এই ধরনের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বামফ্রন্টের সুপরিচিত মুসলিম নেতৃত্বের মধ্যেও কপালে ভাঁজ পড়ে যায় । কেননা , তাদের তো সংখ্যাধিক্য মুসলিম ভোটেই জিতে আসতে হয় । সিপিআই ( এম)-এর সংখ্যালঘু উপসমিতিতেও বিষয়টি আলোচিত হয় । আবার এও সত্য যে , দাঙ্গা ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ , ৮০ লক্ষের মতো ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষের পুনর্বাসন, পশ্চিমবঙ্গের সামজিক- অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল । অপরদিকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের শিক্ষিত সম্পন্ন, মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী অংশ পূর্ব পাকিস্থানে চলে যান । এই প্রেক্ষিতে ২৯ বছরের কংগ্রেসী শাসন ও শ্রেণির পথে চালিত বামফ্রন্ট সরকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী করতে পেরেছে আর কী করতে পারেনি তার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন হওয়া একান্তই প্রয়োজন ছিল কিন্ত যন্ত্রণার বিষয় হলো, প্রচারের বাহুল্যে ‘ কিছু হয়নি ‘-এর আওয়াজটাই বড়ো হয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে হাজির হলো । এই প্রচারের ঝড়ে বামপন্থীরাও একমত হয় কোনো নির্দিষ্ট নীতি , পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের পথ খুঁজে পেলেন না । নাকি তাদের সদিচ্ছার অভাব ছিল ? দেশভাগ পরবর্তী রাজ্যের রাজনীতির মানসিক গঠন কি এক্ষেত্রে বড়ো বাঁধা হয়ে উঠেছিল ?
তিন , আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের ইতিহাস সামাজিক সংঘর্ষের এক আখ্যানমালাও । সংঘর্ষের এই আখ্যানে নানা কুঠরি । জাতপাত , ধর্ম, ভাষা ও শ্রেণির বিষয়কে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতা উত্তর ভারতীয় জনমানস আলোড়িত হয়েছে । কোনো সন্দেহ নেই , এই সংঘর্ষের মানচিত্র ভারতকে এক প্রধান ব্যতিক্রমী দেশ হিসাবেও রূপান্তরিত করেছে । শ্রেণির আলোকে ত্রিশ বছর একটি অঙ্গরাজ্যে সরকার পরিচালনা করার আত্ম অহংকারে বামপন্থীরা কি বিষয়টিকে গুরুত্বহীন মনে করেছিলেন ? নাকি মুসলিমদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ,পার্টির নেতারা তার খোঁজই পেলেন না ? এর জন্য কি পার্টির নেতৃত্বের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক মুসলিম প্রতিনিধি না থাকাই কি দায়ী ? অথবা এই ধরনের আলোচনার কোনো পরিবেশ কী দলের মধ্যে ছিল না ?
চার. সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে জিতে আসা পার্টির নেতা-মন্ত্রীরা বিষয়টি বুঝতে পারছিলেন এবং করনীয় বিষয় সম্পর্কে আলোচনাও করতে থাকেন । অগ্রণী অংশ মনে করেন , পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য একটা সংগঠনের প্র্রয়োজন । যে সংগঠনের মধ্যে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার কী করতে পেরেছে, আর কী করতে পারে নি , বস্তুনিষ্ঠভাবে দেশভাগ পরবর্তী সামগ্রিক প্রেক্ষাপটসহ সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে তুলে ধরতে হবে । তাঁরা এও মনে করেন যে, পার্টির মধ্যে দিয়ে এই কাজ করা যাবে না ।
পাঁচ. আমাদের মধ্যে আলোচনায় স্থির হয় যে , হাসিম আবদুল হালিম ও আবদুর রেজ্জাক মোল্লা পার্টির প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব জ্যোতি বসু‘র সঙ্গে এমত পরিস্থিতিতে এই ধরনের সংগঠনের আবশ্যিকতা সম্পর্কে আলোচনা করবেন । দু‘জনের সঙ্গে আলোচনাতেই জ্যোতিবাবু সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং পার্টিকে তাঁর মতামত জানাবেন বলে তাঁদের জানান। পরবর্তী সংখ্যালঘু উপসমিতির সভায় এই বিষয়টি উত্থাপিত হলে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হলো ‘ তোমরা শুধু মুসলমান মুসলমান করছো , হিন্দুদের কথা তো একবারও ভাবছো না ? ‘ অতঃপর আর কিছু হওয়ার ছিল না । ( চলবে )