শারদ সংকলন -২০২৩/২
আমাদের কথা
শারোদৎসব দুর্গাপুজো বাঙালির অন্যতম মহৎসব। এই উৎসবে আপামর বাঙালি এক অনাবিল আনন্দ যজ্ঞে ডুবে যায় প্রতিবছর। এবারও তার ব্যতিক্রম যে নয় তাই বলাই বাহুল্য। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে চারদিকে সাজো সাজো রব। উৎসবকে ঘিরে সবার মধ্যেই একটা উন্মাদনা। চাষি, চামার, কামার,কুমার যে যার পেশায় নেশায় বুদ উৎসবকে নিয়ে। কবি সাহিত্যিকদের মধ্যেও সৃষ্টির উন্মাদনা। শারোদৎসবে বিভিন্ন শারদীয় পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁদের লেখা মালা এক অনন্য তৃপ্তি দেয়। তাঁরা প্রতিবছর মুখিয়ে থাকেন কখন হাতে আসবে তাঁর প্রিয় শারদ সংকলন যার মধ্যে ছাপা হয়েছে তাঁর লেখা। নতুন পত্রিকা হাতে পেয়েই নিজের লেখার পাতায় পৌঁছানোর আগেই পত্রিকা নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেয় পরম তৃপ্তিতে।
কালক্রমে আমরা পৌঁছে গেছি ডিজিটালের দরজায়। ছাপা অক্ষরের পরিবর্তে অনলাইনে পড়ছি মনমাতানো হরেক ই-পত্রিকা। তাই পিছিয়ে নেই বাংলার জনরব নিউজ পোর্টাল। আমরা আমাদের বহুল প্রচারিত পোর্টালের সাহিত্য শাখার তরফেও পাঠক পাঠিকাদের জন্যে সাজিয়েছি শারদীয়ার ডালি। যে ডালি ভরে উঠেছে দেশ বিদেশের একগুচ্ছ কবি সাহিত্যিকদের মূল্যবান সৃষ্টিতে। সবাইকে শারদীয়ার হার্দিক শুভেচ্ছা সহ নিবেদিত হলো শারদ সংকলন-২ ।
সেখ ইবাদুল ইসলাম সেখ আব্দুল মান্নান
সম্মানীয় সম্পাদক সাহিত্য সম্পাদক
বাংলার জনরব বাংলার জনরব
শংকর কুমার ঘোষ এর দুটি কবিতা
— চন্দ্র যান ( তিন) —
সেলাম তোমাকে শতকোটি
হে বীর চন্দ্র যান- তিন,
তোমার কথা যতই ভাবি
ততই অবাক আমি দিন দিন।
যত প্রশংসা করি আমি
তা ততই হবে কম,
তাই তোমার বিশেষণ তুমিই কেবল
“ একম্ অদ্বিতীয়ম্ ”।
বহু নিখুঁত নিরীখন শেষে
উন্নত করে শির,
চন্দ্রের পথে যাত্রা করেছ শুরু
হে সৃষ্টির মহাবীর।
স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে
খোদিত হোক তাই,
স্মরণে বরণে তেইশের সাক্ষ্য-বাহক
পঁচিশে আষাঢ়, চোদ্দই জুলাই।
তারপর থেকে একলা চলেছ
মহাশূন্যের বুকে ভেসে,
ধ্যানস্থ ঋষির মত
মহাকাশ ভালবেসে।
কাঙ্খিত পৃথিবী— প্রতি পলে পলে
তোমার খবর চায়,
তাকিয়ে আছে শৃঙ্গ জয়ের বাণী পেতে
আকণ্ঠ তৃষ্ণায়।
বিজয়ের পথ মাড়াতে মাড়াতে
কাঁপিয়ে রণাঙ্গন,
সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দিতে
করতে চলেছ অমৃত মন্থন ।
তবু তারই মাঝে যখন ঝঞ্ঝা হঠাৎ এসে
রুদ্ধ করেছে পথ,
তখন সেখানে আমল না দিয়ে
শুধু দেখেছ ভবিষ্যৎ ।
এমনই ক‘রে চাঁদের কক্ষে গিয়ে
দূয়ারে নেড়েছ কড়া,
দেখেছ অজানা হাজারো তথ্য
গোপনে রয়েছে মোড়া।
ইসরোতে যত বিজ্ঞানী আছেন
প্রণাম স্বীকার করুন,
ভরা শ্রাবণের ধারার মত
অবিরাম শুধু ঝরুন।
তেইশ সালেরই তেইশে আগষ্ট-
পাঁচই ভাদ্র ফের,
গর্বিত যেহেতু – চাঁদের বুকে উড়লো
পতাকাটা ভারতের।
যত প্রশংসা করি আমি আজ
সব বিশেষণই হবে কম,
তাই শুধু প্রণাম জানাই তোমাকে
“ ওগো বীর ল্যান্ডার বিক্রম ”।
— দেবতা —
ফিরে গেছে দেবতা আবার
তোমার দূয়ারে এসে,
এসেছিল সেই আগেরই মত
তেমনই ছদ্মবেশে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে একান্তে
তোমার কুটির দ্বারে,
এখনও তুমি অন্ধ রয়েছ
পূর্ণ অহংকারে।
যমকের জাঁকে জ্বালিয়ে দিয়েছ
পিলসুজ তুমি বীর,
আলোর ঝলকে সজ্জিত আজও
বন্দিনী মন্দির।
শঙ্খের ধ্বনি- ঘন্টা- উলুতে
যেন সাহারায় পড়ে বাজ,
ভূষণ চমকে গম্ভীর হয়ে গেছ
হে মহাধিরাজ ।
মঙ্গল ঘটে স্বস্তিক আছে,পল্লব আছে,
গর্ভে নেইকো বারি ,
তবু বিক্রমে হুংকার ছাড়ে দেবাসুর
অন্ধ অহংকারী ।
তমসায় ঢাকা রাজসিক উপাচারে
রূদ্ধ দূয়ার দেখে,
ফিরে গেছে দেবতা আবার
জীর্ণ বসন রেখে।
২.
বন্ধু
নাসিরুদ্দিন আহমেদ
(গুয়াহাটি,অসম)
বন্ধু যদি বন্ধু হয়ে থাকতো পাশে আজ,
সব সুখ উজাড় করে দিতাম ভুলে লাজ।
নাইবা তুমি রইলে কাছে আছো সাগর পারে,
স্বপ্ন হয়ে এসো বন্ধু রাতের অন্ধকারে।
হঠাৎ যদি কখনো আমি একলা হয়ে যাই,
তোমার নামের প্রদীপ জ্বেলে একাকিত্ব ঘোচাই।
৩.
অনুগল্প :
জিরেন কাটের রস
জারিফুল হক
রাখাল রাতে ফোন করে বলল, ‘খেজুর রস খেতে যাবি?’
আমি ওকে বলি “এত রাতে?”
রাখাল বলল,“ভেবে দেখ, তিন-চারদিন খেজুর গাছকে জিরেন দিয়েছিল আকিলচাচা। গাছ কেটে নতুন চ্যানেল তৈরি করে রসের হাঁড়ি বেঁধেছে। জিরেন কাটের রস, ভালোই হবে ।”
এমন নৈশ অভিযানে আগেও বেরিয়েছি রাখালের সঙ্গে এবারো বেরিয়ে পড়লাম।
ভোরের আজান শুনে নামাজ পড়তে যাবার আগে গাছ পাহারা দিতে আসে বুড়ো।
গাছে উঠে . পেঁপের নল ঢুকিয়ে সবে টানতে শুরু করেছি রাখাল তার মধ্যেই হাঁড়ির সব রস সাবাড় করে দিয়ে বলল,“ চল এবার পালাই?”
এইটুকুতে আমার মন সায় দিলনা। রাখাল অনেক টা খেয়েছে , বললাম ,“ আরো খাব ।”
“আর না বুড়ো এসে পড়বে।”
আমি ওর কথা না শুনে অন্য ভাঁড়ে কাঠি গলিয়ে টানতে থাকি। একপাশ দিয়ে কাঠি গলিয়ে খাচ্ছি, অন্যপাশ দিয়ে কাঠি গলিয়েছে রাখাল । একটু রেখে আমি ছেড়ে দিলাম , রাখাল তখনও টানছে।
আমরা নেমে পড়লাম
রাস্তায় টর্চ পড়ছে, একটু আড়াল হয়ে দাঁড়ালাম। লোকটা এগাছে ওগাছে টর্চ মেরে দেখে চলে গেল।
ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।
ঘুমটা আসছিল, রাখাল ফোন করল। বলল,“ আমার খুব পেট ব্যথা করছে ,বমি হচ্ছে।”
আমি বললাম,“ অমন রাক্ষুসে খাওয়া খেলে এমনই হয়।‘”
রাখাল কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,“ মনে হচ্ছে বুড়ো রসের হাঁড়িতে বিষ মিশিয়ে রেখেছিল।”
“দ্যুত! যত আজেবাজে কথা তোর? রসের হাঁড়িতে কেউ বিষ মেশায় ?”
বললাম বটে কিন্তু ভয়ে আমারও বুক টিপ টিপ করতে লাগলো । মনে হল হতেও পারে।
বারান্দায় পায়চারি করছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনে মা । আমাকে দেখে মা বললেন,“ কী হয়েছে রে খোকা,এত ভোর রাতে পায়চারি করছিস কেন?”
ভয়ে ভয়ে মাকে সব বললাম ।মা বললেন,“ সে কিরে! করেছিস কী?”
আমি পেটে হাত দিয়ে বললাম, “ ও মাগো!”
মা বললেন ,“ তাড়াতাড়ি হাসপাতাল যেতে হবে , তোর বাবাকে বলি সব।”
মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলি,“ বাবাকে বলোনা প্লিজ ।”
মা শুনল না ।বাবাকে বলে আমাকে নিয়ে হাসপাতালে এল।
রাখালও সেখানে উপস্থিত । একটা বালতিতে জল আর একটা মগ দেয়া হয়েছে । রাখাল যতটা পারছে তার চেয়েও বেশি জল খাচ্ছে একবার, আর বমি করে করে বিষ বের করে দিচ্ছে।
বিষ খাওয়া রোগীদের প্রথমে এটাই করতে বলে থাকেন ডাক্তারেরা ।তারপর ইনজেকশন আর পেটের মধ্যে নল ঢুকিয়ে ওয়াস করে বিষ বের করবে। সে আরো কঠিন কাজ।
জল আর মগ টেনে নিলাম আমিও। রাখালের পিসি দৌড়ে এলেন হাসপাতালে সঙ্গে আকিলচাচাও ।
পিসি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন-“ ওরে থাম তোরা , রসের ভাঁড়ে বিষ ছিলনা। আকিলভাইকে ধরে নিয়ে এসেছি, ওর মুখ থেকেই শোন।”
আকিলচাচা বলল, “বিষ দিইনি, অমন গুনাহর কাজ আমি করতে পারি?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমারা।
৪.
সোহেল মাহবুব (রাজশাহী,বাংলাদেশ) এর ২টি কবিতা
ক)
গ্যালারির নকশা
রাতের নামতা গুণতে গুণতে হেলে গেছে স্বর
নিয়মের সংক্রান্তি পুড়ে গেছে ব্যাধির ধোঁয়ায়
এখন সকালের রোদের অপেক্ষা আমার,
চোখের তারায় ফুটতে চায় আনবিক বোমা
নিঃশ্বাসের ঘামে ভিজে গেছে ঘুমের রুমাল।
উগ্রবাদী মাঘ বোঝেনা পেয়ারি থাপ্পড়
চোখের নদী যতই বাঁকা হোক
ডাক দিলেই লাফিয়ে ওঠে অতীত
একবার আঁতুর ঘরে বন্যা হয়েছিল
একবার বোবা মুখে কথাফুটেছিল
একবার বুকপুকুরের সিঁড়ি ভেঙ্গে
চাঁদ উঠেছিল
একবার সিন্দুকের নকশায়
পোড়ার ঘ্রাণ উঠেছিল
একবার ভিটামিনের বায়োগ্রাফিতে
খাম খেয়ালিপনায় মেতেছিল বর্ষা
একবার মুক্তির জন্য যুদ্ধ হয়েছিল।
যন্ত্র থেকে যন্ত্রণাংশ বাদ দিতে সকারের সাক্ষাৎকার চাই।
নির্মম বিশেষণা সাজানো মাদুরের ফিলোসোফি
ক্ষুধার্ত পেয়ালায় চুমুর বৃত্তান্ত লিখে হলদে কাক,
সরষের মেঘ উড়িয়ে প্রশান্ত বারুদে আগুন দিতে
এবার তোয়াক্কাহীন রোদ চাই… রোদ।
খ).
তৃষ্ণা
সকালের সূর্যোদয়ের মত উদ্ভাসিত
তোমার সেবা পরায়ণ মুখ
পুরনো চিঠির মত আগলে রেখেছি বুকে
একটাই আশা ভালোবাসি তোমাকে
ভালোবাসি তোমার হাসি, ভালোবাসি
তোমার নীল শাড়ি
আমার সে ভালোবাসায় বুকের কাছে
স্পষ্ট হয়ে আসে
হিমালয়ের মুকুটপরা তোমার সৌরভ,
পেছনে ফিরতে পারিনা বলে ভালোবাসি
কে জানত তোমার ভাঁজ করা পাখনার নীচে লুকিয়ে রেখেছ
শত শত জটিল করতালি…
ছুঁতে চাই তোমার গালে জেগে ওঠা
ওই কালো তিল
ভালোবাসি তোমার অনুচ্চারিত ঠোঁট
কিশোরী মেয়ের মত যেদিন স্বপ্ন ঢেলেছিলে আমার আঙ্গিনায়
সেদিন থেকে সোনার শিকলে
বেঁধে রেখেছি চিতাবাঘ
যেন তোমার তন্বী শরীর রজনীগন্ধ্যায় ভরে থাকে,
ভালোবাসি তোমার বিস্ফারিত তাজা চোখ
যেখান থেকে ভালোবাসার অশ্রু গড়ায়,
ভালোবাসি তোমার তপ্ত নিঃশ্বাস
যেখান থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের হয়ে বুকে পড়ে
আর প্রতিটি লোমকূপে জন্মায় একেকটি স্বপ্ন
তোমাকে ভালোবাসি প্রতিটি সকাল সন্ধ্যা দুপুর
বলে যাই ভালোবাসি বারে বারে ভালোবাসি
ভালোবাসি ভালোবাসি এবং ভালোবাসি
অফুরান..
৫.
— আমার বাড়ির দুর্গা —
অদ্রিজা সাহা
(ষষ্ঠ শ্রেণী, কলকাতা)
সবাই বলে দুর্গা মা নাকি
পুজোর পরে চলে গেছে,
কিন্তু আমি বলি —“ না, দুর্গা যে
এখনও এখানে আছে। ”
আমার বাড়ির দুর্গা কে ?
জানিস কি কেউ ? কে — সে ?
সে যে আমার-ই দুর্গা—
আমার-ই যে ‘ মা ’ সে।
৬.
বিদায়
ডালিয়া মুখার্জী
গ্রেটার নয়ডা (উত্তর প্রদেশ)
ফিরে গেলাম অতীত
কে সাথে নিয়ে,
কত যুগ পেরিয়ে গেলো অপেক্ষারত রাত গুলোতে আর নোনা জল নামে না,
শুধু শোনা যায় নিরন্তর ঝিঁঝির ডাক,
প্রহর গুনি, আর গুনতে থাকি ঝমঝম করে চলে যাওয়া ট্রেনর শব্দ।
বাম অলিন্দে চিনচিন করা ব্যাথাটা রাত বাড়ার সাথে সাথে তিব্রতর হয়ে ওঠে।
আমার তো হারানোর ভয় নেই
ভয় নেই মৃত্যুরও,
ভয় শুধু মানুষের দেওয়া ক্ষতকে,
কর্কট রোগের মত সারা শরীরে ছড়াতে থাকে।
৭.
প্রতিবাদ
সেখ আব্দুল মান্নান
যেদিন থেকে সুস্থ বেঁচে থাকার অধিকার
তোমরা কেড়ে নিতে শুরু করেছ
সেদিন থেকেই জানিয়ে আসছি তীব্র প্রতিবাদ।
তোমাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি
আমাদের বিন্দু আওয়াজ
দিনে দিনে তোমাদের নির্মমতা
বেড়ে চলেছে ভ্রুক্ষেপহীন।
পরিবেশবিদরাও নানা অশনি সংকেত
তোমাদের শুনিয়ে আসছে বারংবার
তবুও তোমরা বেপরোয়া
সভ্যতার নামে বিলাসবহুল আধুনিকতায়।
বিলাসীতার অহংকারে তোমাদের মজ্জায়
গেঁথে গেছে আমাদের মতো দুর্বলদের
প্রতিবাদ ফু-দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া।
পরিবেশের গুরুত্বকে তোয়াক্কা না করে
মুখে স্তোকবাক্যের বন্যা বইয়ে
নিচুতলার মানুষকেও তোমরা
মানুষ বলে গন্য করতে ভুলে গেছ।
তারা তাদের ন্যাহ্য অধিকারের কথা
হাজার বললেও তোমরা বধিরের ভান করে
অট্টহাসির ফোয়ারায় মত্ত থাক নিভৃতে।
যেদিন নিপীড়িতদের হারাবার কিছু থাকবে না
তখন সর্ব শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে তারা
পালাবার পথ খুঁজে পাবে না তোমরা।
তাই এখনও সময় আছে সাবধান হও
নইলে বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হবে জীবকুল
আর আতম্ভরিতার মসনদে বসে
সেদিন শুধু আঙুল চুষবে তোমরা…।
_______________________________