চলে গেলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সমর বাগচী
নায়ীমুল হকের প্রতিবেদন : চলে গেলেন বিজ্ঞান জনপ্রিয়করনের এক আশ্চর্য রকমের প্রাণবন্ত মানুষ সমর বাগচী। বৃহস্পতিবার সকালে দক্ষিণ কলকাতায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস করেন তিনি। খুব অসুস্থ ছিলেন তিনি বেশ কয়েক মাস ধরে। বয়স ৯০ এর কোটা পেরিয়ে গেলেও তার কাছে হার মানতে চাইতেন না তিনি কখনও। এমনকী বার কয়েক হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়েও থেমে যাননি তিনি। বরং কাজের মাত্রা তার পর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বলতেন, কতদিন আর সুযোগ পাবো জানিনা, ওদের (ছাত্র ছাত্রীদের) জন্য কাজ করার সেরা সময় তো এটাই। অসম্ভব মনের জোর ছিল তাঁর। অসুস্থতা নিয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কতবার পৌঁছে গিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। একবার দার্জিলিং-এ বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ছাত্রছাত্রীদের কর্মশালায় তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই বলে তাঁর যে কর্মসূচি, সেখানে তিনি কোনো রকম বিঘ্ন ঘটতে দেননি। বলতেন, দেখো যখন ডাক পড়বে, তখন যেতেই হবে। তবে তার আগে মিছিমিছি থেমে থাকা কেন!
কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তিনি ছড়িয়ে দেন ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার আদর্শ রূপ কেমন হবে তা। পাঠ্যের বিষয়কে কী করে হাতের নাগালের জিনিস দিয়ে বোঝা সম্ভব, তা দেখানোর জন্য শিক্ষকদের নিয়ে বিরামহীন কাজ করে গিয়েছেন তিনি। বিড়লা মিউজিয়ামের কোলমাইনটি তিনি বানিয়েছিলেন মাটির তলার দৃশ্যকে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরার তাগিদ নিয়েই। ধানবাদে ইন্ডিয়ান স্কুল অফ মাইন্স-এ পড়াশোনার সময় থেকেই এই স্বপ্ন তাঁর তৈরি হয়।
আশির দশকে কলকাতা দূরদর্শনে বিজ্ঞানের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘কোয়েস্ট’ করার পর খ্যাতী ছড়িয়ে পড়ে দেশ বিদেশের মাটিতে। কিন্তু অহংকার তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি কখনোই। অত্যন্ত সরল সাধারণ জীবন যাপন ছিল আর সকলের সাথে মিশে যাওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। আসলে মানুষকে ভালবাসতেন তিনি খুব বেশি। লকডাউনে কর্মহারা মানুষেরা যখন লাখেলাখে অন্য রাজ্য থেকে ফিরছে তখন সমস্ত কাজ ফেলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতে।
অনাথ শিশুদের জন্য মৈত্রেয়ী দেবী প্রতিষ্ঠিত ‘খেলাঘর’ পরিচালনার দায়িত্বে দীর্ঘদিন ছিলেন তিনি। বন্ধুপ্রতিম বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী মিহির সেনগুপ্তের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দমদম, কাশিপুর, পুরুলিয়াতে কিশোর ভারতী সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে সর্বতোভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে নিয়মিত সেখানে যেতেও হত তাঁকে। অত্যন্ত যত্ন সহকারে আনন্দভরে জীবনের শেষ ভাগেও এই কাজ তিনি নিরলস ভাবে করে গিয়েছেন, সংযুক্ত করেছেন অন্যান্য প্রথিতযশা শিক্ষকদেরকেও। অধ্যাপক বি এন দাস, বিজ্ঞানী গৌতম বসু, অধ্যাপক অরিন্দম রানা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
মাত্র মাস সাতেক আগে বন্ধু মিহির সেনগুপ্তের প্রয়াণে ব্যথাতুর হন তিনি, মনে মনে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েন, ভেতর থেকে শুরু হয় ক্ষয়। কিন্তু একদিনের জন্যও তা বুঝতে দেননি তিনি।
নানা রকম উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা ও কাজ ছিল তাঁর চিরজীবনের সঙ্গী। ভিন্নমুখী দিশায় প্রেরণা পাওয়া যেত তাঁর কাছ থেকে সদা সর্বদা। অসংখ্য গুণগ্রাহী, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন আজ অভিভাবকহারা।
সমর বাগচীর প্রয়াণে গভীর শোক ব্যক্ত করেছেন এস ডি পি আই এর রাজ্য সভাপতি তায়েদুল ইসলাম। তিনি এক শোক বার্তায় লিখেছেন :
সমর বাগচীর মৃত্যু সংবাদ আমাদেরকে বিচলিত করেছে। প্রিয় সামাজিক কর্মীর প্রয়াণের খবর স্বদেশের সকল মানুষের মধ্যে একটি অপূর্ণ গভীর ঘোর তৈরি করেছে। তাঁর জীবনের কার্যকলাপ, সহানুভূতি, ও পরিবেশ সচেতনতা তাঁকে এক অনন্ত ভূমিকার জায়গায় নিয়ে গেছে। তিনি সামাজিক, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও জন-আন্দোলনের জন্য অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মাইল স্টোন বা দিক নির্দেশনা রেখে গেলেন।
সমর বাগচী একজন ভালো শিক্ষক, সমাজকর্মী এবং পরিবেশ কর্মী ছিলেন, তাঁর বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মনোভাব তাঁকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রমাণ করে। তাঁর নির্ভীক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা ও আদর্শগত আনুষ্ঠানিকতা বৃদ্ধি করেছে।
সমর বাগচীর মুক্তমত, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর সামাজিক কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাভাবিক অংশ ছিল। তাঁর বিশেষ লক্ষ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে রাখা জন জাতিকে এগিয়ে নিয়ে আসা। সমাজে চেতনার বিস্তার ঘটানো। তাঁর এই প্রচেষ্টা সমাজে একটি নতুন পরিবর্তনের উপযোগী রাস্তা নির্মাণের সূচনা করেছে।
তিনি এনআরসি বিরোধী আন্দোলন, নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন সহ অনেক অন্যান্য গণআন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে ছিলেন, যা সমাজে অবদান রাখে এবং দেশের বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সমর বাগচীর স্বাস্থ্য ,বয়স এবং ব্যক্তিগত কাজ এই ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠেনি। তাঁর এই প্রয়াণে আমরা এসডিপিআই দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি।