নওশাদ ইস্যুতে এই রাজ্যের বাঙালি মুসলমান সমাজের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বাস যোগ্যতা হারাচ্ছেন! নেপথ্যে বিজেপি ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতারা?
বুলবুল চৌধুরী : পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান সমাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের বিজেপি ঘনিষ্ঠ নেতারা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন এ নিয়ে কোন সন্দেহ। ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা নওশাদ সিদ্দিকী একজন বিধায়ক হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ দলের জনপ্রতিনিধি হিসাবে এই রাজ্যের সাধারণ মানুষের নজর কেড়ে নিয়েছেন। আমাদের এই বক্তব্যের নেপথ্যে অনেকেই হয়তো বলবেন যে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে ভিলেন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিষয়টি হলো তৃণমূল কংগ্রেস দলের মধ্য থেকেই চেষ্টা হচ্ছে এই রাজ্যের মুসলমান সমাজের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে বিশ্বাসযোগ্যতা আছে সেই বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করে দেওয়ার। কয়েক মাস আগে নওশাদ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে ৪২ দিন জেলে রেখেছিল এই রাজ্যের পুলিশ।
তারপর কলকাতা হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করার পর কলকাতা পুলিশ এমন কোন তথ্য প্রমাণ হাইকোর্টের সামনে পেশ করতে পারেনি যাতে নওশাদকে আটকে রাখা যায়। হাইকোর্টের বিচারপতিদের সামনে রীতিমতো ধমক খান কলকাতা পুলিশের কর্মকর্তারা এবং জামিনে মুক্ত হন নওশাদ সিদ্দিকী। ইতিমধ্যেই যা হবার হয়ে গেছে ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা নওশাদ সিদ্দিকী শুধু পীরের সন্তান বলেই যে জনপ্রিয়তা তা নয় বরং তিনি রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে মূল্যবোধের কথা বলছেন তার জন্য ইতিমধ্যে এই রাজ্যের হিন্দু মুসলমান সব সম্প্রদায়ের কাছে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন নওশাদ সিদ্দিকী।
প্রখ্যাত সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, নওশাদ হলেন লম্বা রেশের ঘোড়া। ৪২ দিন জেলে ঢুকিয়ে নওশাদ সিদ্দিকীকে হাইকোর্টের নাকানি চোবানি খাওয়ার পর রাজ্য সরকার কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে কোনোরকম অনুশোচনা দেখা যাচ্ছে না। ৪২ দিন জেল রাখার খেসারত হিসাবে সমগ্র রাজ্য জুড়ে মুসলমান সমাজে বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম সমাজের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে।
এই প্রেক্ষাপটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন নিজে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে দলকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছেন ঠিক তখনই তারই দলের কিছু বিজেপি ঘনিষ্ঠ নেতারা আবার নওশাদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে এক মহিলাকে ধর্ষণের অভিযোগ আনলেন। আর মহিলা ধর্ষণের অভিযোগ যেকোনো সময় যে তৈরি করা যায় তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ওই মহিলা নিউ টাউন থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন সঙ্গে ছিলেন একসময়ের বিজেপির নেতা ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে বিধাননগর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপির প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সব্যসাচী দত্ত, শোনা যায় তিনি নাকি আরএসএস ঘনিষ্ঠ। তিনি একজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত পলিটিক্যাল সাইন্স এ মাস্টার ডিগ্রী মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন কোথায় করেছেন নিউটাউন থানায়। বলা হচ্ছে ওই মহিলার বাড়ি নাকি? এয়ারপোর্ট থানায় এলাকায় তাহলে এয়ারপোর্ট থানায় ডায়েরি করা হলো না কেন কিংবা এফআইআর করা হলো না কেন? এবার দেখা গেল তৃণমূল নেতা সব্যসাচী দত্ত নিউ টাউন থানায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এফ আই আর করালেন। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা পুলিশ মন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমাদের প্রশ্ন আমরা যদি কলকাতায় বসে হুগলি কিম্বা হাওড়া জেলার কোন বাসিন্দার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানাতে যায় তাহলে কি থানা অভিযোগ নেবে? তাহলে ওই মহিলার অভিযোগ কোন ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে?
যদিও জানা গিয়েছে নিউ টাউন থানা ওই অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার পর বউবাজার থানায় অভিযোগ পাঠিয়ে দিয়েছেন এই থানাতে এফআইআর হয়েছে নওশাদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে। দেড় বছর আগে বউবাজার থানা এলাকার কোন একটি বাড়িতে ওই মহিলাকে নাকি ধর্ষণ করেছিলেন নওশাদ সিদ্দিকী। দেড় বছর পর কার যুক্তিতে, কার নির্দেশে কোন উদ্দেশ্যে ওই মহিলা অভিযোগ জানাতে গেলেন? রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান সমাজের কাছে রয়েছে তাকে বিনষ্ট করার জন্য কি বিজেপি ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতারা সক্রিয় নন!
এফআইআরে অভিযোগকারিণী জানিয়েছেন, দেড় বছর আগে তাঁকে বিবি গাঙ্গুলি স্ট্রিটে নিজের অফিসে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছেন নওশাদ। পরে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও বেশ কয়েক বার সহবাস করেছেন আইএসএফ বিধায়ক। অভিযোগ, এর পর অভিযোগকারিণী বিয়ের জন্য চাপ দিলে তাঁকে এড়িয়ে যেতে থাকেন নওশাদ। বিধায়ক কখনও নিজে, কখনও সহকারীদের দিয়ে তরুণীকে হুমকি দিয়েছিলেন বলেও অভিযোগকারিণী জানিয়েছেন।
বুধবার নিউ টাউন থানায় প্রথম অভিযোগ দায়ের করেন ওই তরুণী। থানা থেকে বেরিয়ে সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখনই কিছু বলতে চাইছি না। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। জিডি (জেনারেল ডায়েরি) করেছি। শারীরিক হেনস্থা করা হয়েছে। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভঙ্গ করেছেন নওশাদ সিদ্দিকি।’’ এর পরেই বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (নিউটাউন) একটি চিঠি-সহ তরুণীর অভিযোগ বউবাজার থানায় পাঠিয়ে দেন। সেখানেই এফআইআর হয়। নিউটাউন থানায় অভিযোগকারিণী যখন যান, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিধাননগর পুরসভার চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত। তৃণমূলের তরফে ভাঙড়ে পঞ্চায়েত ভোট প্রচারের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি। তিনি কেন থানায় উপস্থিত, প্রশ্ন করা হলে সব্যসাচী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘এই তরুণীর তরফে আমাদের কাছে অভিযোগ জানানো হয়। ওঁর ভাই এসে বলেন। এঁরা তো সাধারণ মানুষ। কোন থানায় যেতে হবে, কী করতে হবে, এগুলো জানেন না বলে নিউটাউনে এসেছিলেন। এমনিতে তিনি এয়ারপোর্ট থানার অন্তর্গত এলাকায় থাকেন। উনি আমার কাছে আসেন। ভারতের আইনে রয়েছে, কোনও মহিলা যে কোনও নিকটতম থানায় গিয়ে অভিযোগ করলে, যে থানার অভিযোগ, পুলিশ সেখানে পৌঁছে দেবে। আমার নিকটতম থানা যে হেতু নিউটাউন, তাই এখানে আসি।’’
এসব অভিযোগ শোনার পর নওশাদ বলেছেন, ‘‘এখনও আমার কাছে কোনও অভিযোগের কপি আসেনি। পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়নি। দেখি, কী অভিযোগ করেছে আমার বিরুদ্ধে।’’ গোটা বিষয়টি নিয়ে নওশাদ আঙুল তুলেছেন রাজ্য সরকারের দিকে। তাঁর কথায়, ‘‘রাজ্য সরকার আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেছে। কখনও খুনের চেষ্টা, কখনও অস্ত্রসমেত খুন— বিভিন্ন মামলা দায়ের করেছে। এমনকি, ৪২ দিন জেলেও রেখেছিল। এটা ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। সময় এলে এ নিয়ে মুখ খুলব। অপেক্ষা করছি।’’
পঞ্চায়েত ভোটের শেষ লগ্নে এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা সব্যসাচী দত্ত ওই মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে নিউটাউন থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার ফলে রাজ্যজুড়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে বার্তা ছড়িয়ে গেল যে তৃণমূল নওশাদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। যদিও তদন্ত চলছে ওই মহিলার অভিযোগ সম্পর্কে বাংলার জনরবের কিছু বলার নেই। কিন্তু একজন শিক্ষিত উচ্চশিক্ষিত পলিটিকাল সাইন্সের মাস্টার ডিগ্রি প্রাপ্ত মহিলা নিজের আত্মীয়-স্বজনকে সঙ্গে না নিয়ে বাবা মাকে সঙ্গে করে না নিয়ে তৃণমূল নেতা সব্যসাচীকে কেন নিলেন তা বাঙালি মুসলমান সমাজের প্রশ্ন ? অভিযোগ দায়ের এর ক্ষেত্রে ওই মেয়েটির কি কোন আত্মীয়-স্বজন সঙ্গে যেতে পারত না ভাই বলে যাকে বলা হচ্ছে তিনিও মুখ ঢেকেছেন মুখোশে কেন? ডাল মে কুচ কালা হে!
সবশেষে আমরা এটা জোর দিয়েই বলতে পারি বিজেপি ঘনিষ্ঠ ও তৃণমূল নেতা ওই মহিলার সঙ্গে গিয়ে নিউ টাউন থানায় নওশাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়ে প্রকৃতপক্ষে এই রাজ্যের বাঙালি মুসলমান সমাজের কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতাকে হারিয়ে দিলেন। এ কথা বলতে বাধা নেই সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের পর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যের মুসলমান সমাজের কাছে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মুখ ছিলেন কিন্তু যেভাবে নওশাদ সিদ্দিকীর মত একজন পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির বিধায়কের পেছনে বার বার কালিমা লিপ্ত করতে তৃণমূলের একটা গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তারা চেষ্টা করছেন তাতে আর যাই হোক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিশ্বাসযোগ্যতা বাঙালি মুসলমান সমাজে চলে যাচ্ছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। আর এই পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের মুসলিম নেতারাও এখন সংশয়ের মধ্যে পড়েছেন নওশাদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ জমা পড়ার পর এ রাজ্যের বাঙালি মুসলমান সমাজ যে মমতার কাছ থেকে এবং তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চলেছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।