তুঝে সাব হ্যায় পাতা, মেরি মা : মন ছুঁয়ে গেল অনুসন্ধান কলকাতার উদ্যোগে আয়োজিত ‘মাতৃ দিবসের’ আলাপচারিতায়
বিশেষ প্রতিনিধি: একটি মাত্র অক্ষরের শব্দ ‘মা’। তাতেই এত শক্তি নিহিত। সব কিছুতেই তিনি, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। তুঝে সাব হ্যায় পাতা, মেরি মা……
গত রবিবার ১৪ মে ছিল এবারের বিশ্ব মাতৃ দিবস। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘মাতৃ দিবস’। অনুসন্ধান কলকাতার উদ্যোগে এদিন অনলাইনে আয়োজন করা হয়েছিল মাতৃ দিবসের অনুষ্ঠান। বিষয় ছিল, বিশ্বায়ন ও অগ্রগতির যুগে নাড়ির টান কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে না তো! প্রত্যেকের আলোচনা এদিন এত উচ্চাঙ্গের ছিল, যা উপস্থিত সকলের মন ছুঁয়ে গেল।
এদিন অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি ড. অমরেন্দ্র মহাপাত্র। মা বলিতে প্রাণ, করে আনচান…….. কবিতার এই ক’টি লাইন বলে শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, মা আমাদের সর্বক্ষণের, সর্বমুহুর্তের সঙ্গী। মায়ের প্রতি যথাযজ্ঞ মর্যাদা প্রদানের মাধ্যমেই আমরা মর্যাদাশালী হই। এই কথাটা মনে রাখতে হবে, আমাদের পরের প্রজন্মকে বলে যেতে হবে।
বিশিষ্ট নাট্যকার লেখক ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক সোমনাথ মুখোপাধ্যায় ভূমিকা বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন আজকের প্রেক্ষিত অনেক বদলে গিয়েছে, কাজের সূত্রে যেতে হচ্ছে দেশ বিদেশে। তাতে কী সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্কের শিথিলতা আসছে? বোধহয় তা সত্য নয়। এই প্রশ্ন তিনি তুলে ধরেছেন সকলের কাছে।
এদিন প্যানেল বক্তাদের মধ্যে প্রথম বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের এক্স প্রেসিডেন্ট অধ্যাপিকা চৈতালি দত্ত। তিনি নানা উদাহরণ দিয়ে বলেন মায়েদের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক চিরন্তন, তার কোন ক্ষয় হয় না। মা মা-ই থাকেন, সন্তান সন্তান-ই। যে যেখানেই থাকুন না কেন। আর এগিয়ে তো আমাদের যেতেই হবে।
অনুষ্ঠানের পরবর্তী বক্তা বিশিষ্ট বিজ্ঞানী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপিকা এণা রায় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক নিয়ে চিন্তার কারণ নেই বরং পরিবর্তনশীল সমাজে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা প্রয়োজন। আজও পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে মায়েদের ভূমিকার কথা ভাবতে পারে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মায়েদের সাফল্য আজ তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। মনুষ্য সমাজের পাশাপাশি প্রাণীকুলেও এই সত্য আজ প্রতিভাত। বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বলেন অধ্যাপিকা এণা রায় বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রকাশনা জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব দেব সাহিত্য কুটির-এর কর্ণধার রূপা মজুমদার এদিন সিঙ্গেল প্যারেন্টিং বা একক অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সন্তান পিছিয়ে পড়ে বলে ধরা হয়, এমন ধারণার অপনোদন করে বলেন, পিছিয়ে পড়ার আসল কারণ খোঁজা দরকার, তা সিঙ্গেল প্যারেন্টিং এর জন্য, এ কথা কিভাবে জানা গেল! মাতৃ দিবসের এই আলোচনায় রূপা মজুমদার সকলকে অনুরোধ করে বলেন, মা একজন মানুষ, তিনি দেবী নন। সুতরাং পিতার মতো একজন মায়েরও শখ-আহ্লাদ সবকিছুই থাকবে। এগুলো যাতে যথাযথভাবে পূরণ হতে পারে সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। সাধারণত আমাদের সমাজে এ বিষয়গুলি খুবই অবহেলিত হয়।
এদিন আলোচনার শেষ বক্তা ছিলেন আসামের মার্গারিটা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা বিশিষ্ট সমাজকর্মী দীপশ্রী দাস সরকার। আমাদের পারিবারিক সিস্টেমে যৌথ দায়িত্বের কথা না ভেবে মায়েদের উপর বেশ কিছু বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যালেন্স নষ্ট হয়। বিশেষ করে ওয়ার্কিং মাদার বা কর্মরতা মায়েদের ক্ষেত্রে তার সম্ভাবনা আরো প্রবল। হাজার বোঝা মাথায় নিয়ে সমস্ত দায়িত্ব পালন করার পরও যথাযথ রিকগনিশন বা মান্যতা কিন্তু পাননা মায়েরা, এমনকি সহানুভূতিটুকুও নয়। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন নিজস্ব পরিচয় নিয়ে কেন থাকতে পারবেন না একজন মা আজও আধার কার্ডে একজন স্ত্রীকে স্বামীর নাম লিখতে হয় অথচ স্বামীকে স্ত্রীর নাম লিখতে হয় না। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে মায়েদের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার আর্জি জানান তিনি অভিজ্ঞতার নিরিখে তিনি বলেন, রাজনীতির ময়দানে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নাম কা ওয়াস্তে মহিলারা থাকেন, কাজ করেন পুরুষেরা। এই ব্যবস্থাপনার অবসান হওয়া জরুরি।
ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে গিয়ে অনুসন্ধান কলকাতার মুখ্য উপদেষ্টা বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী অধ্যাপক মতিয়ার রহমান খান বলেন সমাজে আমরা সকলেই একে অপরের পরিপূরক, পরিবারও তা থেকে পৃথক কিছু নয়। দায়িত্ব ও অধিকারের সুন্দর এক মেলবন্ধন গড়ে উঠুক আমাদের পরিবারে। এগিয়ে চলুক গোটা বিশ্ব। ভুল ত্রুটি সংশোধন করে নিশ্চয়ই আগামী দিনে আমরা উপহার দিতে পারব উজ্জ্বলতর একটি সমাজ।
এদিন শিশু শিল্পী আর্য্যা, আলেয়া, সুমেধাদের নাচ ও কবিতা-গানে মন ভরিয়ে দিয়েছিল মাতৃ দিবসের অনুষ্ঠান। ঘোষণায় ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষিকা শর্মিষ্ঠা শীল, সঙ্গে নাফিসা ইসমাত।