দেশ 

মোদী শাহর হিন্দু মেরুকরণের সব তাস ব্যর্থ কর্নাটকে, কোন পাঁচ ফর্মুলায় জয়ের হাসি হাসলেন রাহুল, প্রিয়াঙ্কা, সোনিয়া?

শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সেখ ইবাদুল ইসলাম : দক্ষিণ ভারত থেকে কার্যত বিজেপি মুছে গেল। অথচ বিজেপির রাজনৈতিক ম্যানেজাররা প্রায় দু’বছর ধরে কর্নাটকে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তা সত্ত্বেও হেরে গেল কোন মন্ত্রে কংগ্রেসের এই সাফল্য তা ভাবাচ্ছে রাজনৈতিক মহলকে।

কংগ্রেস এবারের নির্বাচনে সরাসরি উন্নয়নের পক্ষে ভোট চেয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভোট চেয়েছিল মানুষের জন্য ভোট চেয়েছিল সুশাসন দেওয়ার জন্য ভোট চেয়ে ছিল। রাহুল প্রিয়াঙ্কারা প্রতিটা সভাতে নিয়ম করে সুশাসনের কথা বলেছেন মানুষের কথা বলেছেন মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে তুলে ধরেছে কংগ্রেস। নির্বাচনের ঠিক মুখে মুসলিমদের জন্য ৪ শতাংশ সংরক্ষণ তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত যখন ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার নেয়, সেদিনই সন্ধ্যায় কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস অফিসে বসে দলের রাজ্য সভাপতি ডি কে শিবকুমার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলে মুসলিমদের এই সংরক্ষণ ফিরিয়ে দেয়া হবে। কংগ্রেসের এই সরাসরি বিজেপিকে চ্যালেঞ্জিং মানসিকতা এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ মানুষকে আপ্লুত করেছিল তাই শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকেই তারা বেছে নিয়েছে।

Advertisement

দ্বিতীয়ত ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি কংগ্রেস দল এবার সরাসরি কোন হিন্দুত্ব প্রচার করেনি বরং তারা বলেছিল পপুলার ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়াকে যেমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে একই রকম ভাবে হিংসাত্মক কার্যাবলীর জন্য বজরং দল কেউ নিষিদ্ধ করা হবে। আর এই প্রচারকে সামনে রেখে বিজেপি যত হিন্দু মেরুকরণ করতে গিয়েছিল ততই তাদের ভোটব্যাঙ্ক নষ্ট হয়েছে।

তৃতীয়ত নন্দিনী দূত বনাম আমুল দুধ এই লড়াইকে সামনে রেখে কর্ণাটক জাতীয়তাবাদকে জাগিয়ে তুলেছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস তার সাফল্য পেয়েছে।

চতুর্থ তো কোনভাবেই বিতর্কিত কোন মন্তব্য এবারের প্রচারে কংগ্রেস করেনি। বরং রাহুল গান্ধীর সাংসদ পথ কেড়ে নেওয়ার প্রচার এই রাজ্যে হলেও সেভাবে কংগ্রেস প্রচার চালাইনি। রাহুলের প্রতি যে সহানুভূতি উঠেছিল কর্নাটকে তা সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখলেই বোঝা যেত। এছাড়া রাহুল গান্ধী যেভাবে প্রচারের স্টাইল বদল করেছে তাতে ওই এলাকার জনগণ খুশি হয়েছে কংগ্রেসের প্রতি।

পঞ্চমত স্থিতিশীল সরকার উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দুর্নীতিমুক্ত সরকার উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি এবং কংগ্রেসের প্রতি আস্থা রাখতে অনুরোধ করা। দেশের সংহতি ও সম্প্রীতির স্বার্থে কংগ্রেসী একমাত্র ভরসার জায়গা বলে এই নির্বাচনে কর্ণাটক জুড়ে প্রচার করেছিল কংগ্রেস।

অন্যদিকে বিজেপি কংগ্রেসের উন্নয়নমুখী প্রচারের ধারে কাছে না গিয়ে শুধু বলে যাচ্ছিল হিন্দুত্বের কথা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মত একজন ব্যক্তিত্ব নির্বাচনী প্রচারে দাঁড়িয়ে বজরংবলির জয় বলে স্লোগান দিয়েছিলেন। উন্নয়ন এবং দুর্নীতির প্রশ্নে কোন উত্তর না দিয়ে বিজেপির একমাত্র মুখ নরেন্দ্র মোদি, যেভাবে হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করেছিলেন সেটা মেনে নিতে পারেনি দেশের অন্যতম শিক্ষিত রাজ্য কর্ণাটকের বাসিন্দারা।

দ্বিতীয়ত সরাসরি সম্প্রদায়িক প্রচার সিদ্দারামাইয়াকে টিপু সুলতানের বংশধর বলে যেভাবে আক্রমণ করেছিলেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা তা মেনে নিতে পারেননি কর্নাটকের বাসিন্দারা। মুসলিম সমাজকে নিশানা করে বিজেপির হেভিওয়েট নেতারা যে প্রচার করেছিলেন তা মেনে নিতে পারেননি কর্নাটকের সাধারণ মানুষ সেজন্যেই দেখা গেল কংগ্রেস প্রায় ১৩৭টা আসন পেয়ে ক্ষমতা দখল করতে।

দু’বছর আগে হিজাব ইস্যুতে যেভাবে সমগ্র কর্ণাটক জুড়ে মুসলিমদের টার্গেট করা হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ায় এবারের নির্বাচনে মুসলিমরা এক জোট হয়ে কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম ভোট একজোট হওয়ার কারণেই কংগ্রেস মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়যুক্ত হয়েছে। দেশের মুসলিমরা মনে করছে এখন কংগ্রেসই একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যে তাদের নিরাপত্তা দিতে পারে।

‘জয় বজরংবলী’ স্লোগান থেকে ‘কেরালা স্টোরি’, ‘ভারত থেকে কংগ্রেস কর্নাটককে বিচ্ছিন্ন করতে চায়’, তাঁকে ‘৯১ বার কংগ্রেস অপমান করেছে’— সব তাসই এ বার খেলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। এমনকি, ভোটের আবহে বিতর্কিত ছবি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র সমর্থনে মুখ খুলে বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস আসলে সন্ত্রাসবাদকে মদত দিতে চাইছে। সেই কারণে এই ছবিকে নিষিদ্ধ করতে চাইছে। তারা আদতে সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করছে।’’ অন্য দিকে, ভোটের আগে কর্নাটকে ওবিসি মুসলিমদের ৪ শতাংশ কোটা বাতিল করে রাজ্যের দুই প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী লিঙ্গায়েত এবং ভোক্কালিগাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার যে পদক্ষেপ কর্নাটকের বিজেপি সরকার করেছিল, প্রকাশ্যে তা সমর্থন করেছিলেন শাহ।

কর্নাটকে কংগ্রেসের ভোটের প্রচারে আগাগোড়া প্রাধান্য পেয়েছিল, বিজেপি সরকারের দুর্নীতি-অপশাসন এবং জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ৪০ শতাংশ কমিশনের অভিযোগের পাশাপাশি, তুলে ধরা হয়েছিল কর্নাটক সরকারের দুগ্ধপ্রকল্প ‘নন্দিনী’কে পিছনে ঠেলে মোদীর রাজ্যের ‘আমূল’কে নিয়ে আসার প্রসঙ্গ। রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়ঙ্কাও ধারাবাহিক ভাবে প্রচার চালিয়েছেন রাজ্য জুড়ে। কিন্তু সন্তর্পণে মেরুকরণের ‘ফাঁদ’ এড়িয়েছেন তাঁরা।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপির তাবড় তাবড় নেতাদের হিন্দুত্বের স্লোগান কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কাজে লাগেনি। এ থেকে স্পষ্ট যে দেশের মানুষ উন্নয়ন ও সংহতিতে বিশ্বাস করে ধর্মীয় ভেদাভেদকে প্রশ্রয় দেয় না। বিজেপি ধর্মীয় বিভাজন বা হিন্দুত্বের তাস খেলতে গিয়ে মেরুকরণ তো হলোই না উপরন্ত বুমেরাং হয়ে গেল দক্ষিণ ভারত থেকে কার্যত বিজেপি শূন্য হয়ে গেল। আগামী লোকসভা নির্বাচনে দেশের জনগণের মধ্যে যদি কর্নাটকের এই জনা দেশ প্রভাবিত হয় তাহলে দিল্লি থেকেও বিজেপি যে বিদায় নেবে তা আর বলার অপেক্ষায় রাখেনা।


শেয়ার করুন
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ