অন্যান্য 

স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস দলের সবথেকে বড়ো অবদান হলো , যাবতীয় ছুতমার্গ সরিয়ে ধর্ম, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও প্রথাকে সমাজজীবন সর্বোপরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে তারা সমর্থ হয়েছে : ড. আবদুস সাত্তার

শেয়ার করুন
  • 323
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

আমাদের দেশ ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের পর ৭২ টি বছর পার করেছে। আজও দেশের সাধারণ মানুষ সেই অর্থে স্বাধীনতা পেয়েছে কী ? ৭২ বছর পর হিসাব মেলাতে গিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির সংখ্যাটাই বেশি করে চোখে পড়ছে। ৭২ বছর পরও এদেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সামনের সারিতে আনার প্রতিশ্রুতি এখনও দেওয়া হয় দলিতসংখ্যালঘুরা এতদিন ধরে যে অর্জিত স্বাধীনতার সম্পদ ভোগ করে আসছিল তা আগামী দিনে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদ এমন জায়গায় পৌছে গেছে যে আজ দেশের সব রাজনৈতিক দলই মন্দিরমুখী হয়ে পড়েছে স্বাধীনতার ৭২ বছর পর এদেশের দলিতসংখ্যালঘুদের নানা বিষয় নিয়ে বাংলার জনরব নিউজ পোর্টালের মুখোমুখি নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক এবং রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী . আবদুস সাত্তার । আজ চর্তুদশ ‍কিস্তি । 

স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস দলের সবথেকে বড়ো অবদান হলো , যাবতীয় ছুতমার্গ সরিয়ে ধর্ম, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও প্রথাকে সমাজজীবন সর্বোপরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে তারা সমর্থ হয়েছে । অবশ্য, রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক দলকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে আমদানি করতে হয়নি । পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রাজনীতি নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকতা ফল্গুধারার মতো বহমান থেকেছে । মতার্দশগত সরকার নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গে যুগের পর যুগ ধরে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন-পালন করা হয়েছে , কখনো নীরবে , কখনো সরবে ।

Advertisement

প্রশ্ন : তৃণমূল কংগ্রেস-এর নেতৃত্বাধীন এই সরকার গঠনে সংখ্যালঘু  মুসলিমদের ভুমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো , বলা যায় প্রশ্নাতীত । মুসলিমদের মধ্যে তৃণমূল দল ও এই সরকারকে ঘিরে বহু প্রত্যাশা ছিল । তা পূরণ হয়েছে কি ?

ড. আবদুস সাত্তার : এক . কংগ্রেস (আই) ভেঙে বেরিয়ে আসা দেশের আর পাঁচটা বুর্জোয়া , আঞ্চলিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দলের মতোই তৃণমূল কংগ্রেস দল । ব্যক্তির লড়াই –আন্দোলন-সংগ্রাম , জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতের নানা রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির জন্ম ও উত্তরোত্তর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে । স্বভাবতই নির্দিষ্ট অঞ্চল , ভূখন্ডে ক্ষমতাসীন এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলি সর্বভারতীয় ক্ষেত্রেও নির্নায়ক শক্তি হিসাবে উঠে আসছে । রাজ্যে রাজ্যে প্রশাসন পরিচালনা করছে । সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির বিপরীতে এই সমস্ত দলগুলির নিজ রাজ্যে মানুষের বিপুল সমর্থনলাভ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ।

দুই. বামপন্থী আরএসএস-বিজেপি-এর মতো এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলি ক্যাডারভিত্তিক নয় । কোনো নির্দিষ্ট নীতি,মতাদর্শের পথিকও এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলি নয় । শোষণমুক্ত সমাজ গঠন সর্বোপরি সমাজতন্ত্রের কথা তাদের স্বপ্ন-ভাবনাতে নেই । সেই লক্ষ্যে তারা দলও পরিচালনা করেন না । ফলত, আন্তর্জাতিক বিষয় , সমগ্র ভারতের নানাবিধ বিষয় থেকে নিজের রাজ্যের কথাই তাদের রাজনীতিতে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে ।

তিন . রাজনীতির এই নির্মাণে ব্যক্তিই হয়ে ওঠেন দল সর্বস্ব । ব্যক্তি মহাত্ম্য , ব্যক্তির কাজকর্ম, ব্যক্তির জনপ্রিয়তাই এই রাজনীতির প্রধান উপায় ও অবলম্বন হিসাবে জনমানসে হাজির হয়ে থাকে । স্বভাবতই ব্যক্তিই নীতি, ব্যক্তিই আদর্শ, ব্যক্তির চলন , বলন, কাজকর্মই রূপান্তরিত হয় দলীয় কর্মসূচিতে। আর কে না জানে, ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যক্তি মাহাত্ম্য ব্যক্তি পূজা‘র প্রচার ও প্রসার সর্বাধিক । সামন্ততন্ত্র , পুঁজিবাদ , সাম্রাজ্যবাদ এই ‘ব্যক্তিপূজার‘ অপরিসীম মাহাত্ম্যে সযত্নে লালিত-পালিত হয়ে চলেছে । ক্ষমতার গবেষণাগারে আপোষ- বোঝাপড়া, নানা বিপরীতমুখী, পারস্পর-বিরোধী পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংসদীয় ব্যবস্থপনায় টিকে থাকার লক্ষ্যে সহনীয় হয়ে উঠেছে । এই ধরনের দলীয় মঞ্চে বহুরূপের সমাহার তো হয়েই থাকে । আবার এও সত্য যে , ভারতের নানা প্রান্তের ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজ্য-ভিত্তিক শাসক দল/ দলগুলিতে উত্তরাধিকার-এর বিষয়টিও নতুন কিছু নয় । এতদসত্ত্বেও সাধারন মানুষ যেন বিষয়গুলিকে সহজাতভাবে গ্রহণ করছেন, ভোট বৈতরনী পার করে ক্ষমতার অলিন্দে লালন-পালন করে চলেছেন , এ-ও তো কম কথা নয়।

চার . রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস-এর সম্ভবত এক এবং একমাত্র কর্মসূচি ছিল যে-কোনো মূল্যে বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে । সেই লক্ষ্যে তারা সফল হয়েছে । অতঃপর ? পরিকাঠামোগত উন্নয়নসহ নানা ধরনের শ্রী‘যুক্ত প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারন মানুষকে ‘ রিলিফ ‘ দিয়ে ক্ষমতায় থাকা । অবশ্য , বামপন্থীররাও  সরকারে থাকাকালীন সময়ে বহুবার বলেছেন যে, একটা অঙ্গরাজ্যে ক্ষমতাসীন হয়ে ‘ মৌলিক পরিবর্তন ‘ করা খুবই কঠিন বিষয় । তাই মানুষকে যতটা সম্ভব ‘ রিলিফ ‘ দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে ।

পাঁচ . তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে আট বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে । ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাতাবরন , মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন, তপশিলী জাতি , তপশিলী উপজাতি  এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সাফল্য –ব্যর্থতার পরিমাপ তো একটা প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে করা সম্ভব নয় । এর জন্য একটা স্বতন্ত্র সিরিজের আবশ্যকতা রয়েছে ।

ছয়. সমগ্র বিশ্বজুড়েই সময়টা বড়ো অস্থির ও জটিল । আরএসএস-বিজেপি বিগত সাড়ে চার বছর  ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে এই অস্থিরতাকে  বহুকৌণিক রূপদানে সক্ষম হয়েছে । তাদের সৃষ্ট মতাদর্শ ‘ হিন্দুত্বের রাজনীতি‘র রঙে রাঙিয়ে জীবনের সব স্তরে রূপান্তরের এক অসহনীয় কর্মযঞ্জ দ্রূত গতিতে চালিয়ে যাচ্ছে ।  রাজনীতির এই পট পরিবর্তনে দেশের রাজনৈতিক দলগুলিও  তাদের রণকৌশল সাময়িকভাবে হলেও পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে । আরএসএস –বিজেপি –এর এটা একটা বড়ো সাফল্য-ও বটে । এই প্রেক্ষিতে দেশ তথা রাজ্যের রাজনীতিকে বোঝার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেই আমার মনে হয় । এক কথায় যা ‘অস্বাভাবিক‘ মনে হতো, সরকারী প্রযোজনায় , নবনির্মাণে তাই যেন নতুনভাবে ,  নতুন পথে‘ স্বাভাবিক‘ রূপে দেশের মানুষের কাছে উপস্থাপিত করা হচ্ছে । এ বড়ো কঠিন সময় !

সাত . আমাদের মনে রাখতে হবে , স্বাধীনতার পর তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের শাসনাধীন এই সময়ে বামপন্থী দলগুলি ও কংগ্রেস ( আই) –এর প্রতিনিয়িত শক্তি ক্ষয় হচ্ছে । পাশাপাশি আরএসএস-এর ছত্রছায়ায় থাকা নানা ধরণের সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে । সাম্প্রতিককালের উপনির্বাচনগুলির ফলাফলে দেখা যাচ্ছে বিজেপি রাজ্যের দ্বিতীয় স্থান দখল করতে সমর্থ হয়েছে । অপরদিকে এ আই এম আই এম সহ ছোটো ছোটো রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলির প্রভাবও বাড়ছে । বিশেষত শিক্ষিত ছাত্র –যুবদের মধ্যে । বলা যেতে পারে, রাজ্যের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে ।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে , স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেস দলের সবথেকে বড়ো অবদান হলো , যাবতীয় ছুতমার্গ সরিয়ে ধর্ম, ধর্মীয় ঐতিহ্য ও প্রথাকে সমাজজীবন সর্বোপরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করতে তারা সমর্থ হয়েছে । অবশ্য, রাজ্যের কোনো রাজনৈতিক দলকেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে আমদানি করতে হয়নি । পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রাজনীতি নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িকতা ফল্গুধারার মতো বহমান থেকেছে । মতার্দশগত সরকার নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গে যুগের পর যুগ ধরে সাম্প্রদায়িকতাকে লালন-পালন করা হয়েছে , কখনো নীরবে , কখনো সরবে ।


শেয়ার করুন
  • 323
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

Leave a Comment

nine − 2 =